জ্বলদর্চি

দুগ্গা দুগ্গা/ সমরেশ মজুমদার, অনুপ রায়, ঋত্বিক ত্রিপাঠী


দুগ্গা দুগ্গা

গদ্য - সমরেশ মজুমদার 
চিত্র- অনুপ রায় 
পদ্য- ঋত্বিক ত্রিপাঠী 


পাঠ প্রতিক্রিয়া
 
কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার

বাঙালি মায়ের জাত, প্রসব না করতে পারলে তার অস্তিত্ব লােপ পাওয়ার ভয়ে ক্রমাগত মা হয়ে যায়। এই প্রসব কল্পনায়, পিতৃত্ব কেউ দাবি করবে না। বাঙালি প্রসব করে চলেছে নিজের মস্তিষ্ক এবং হৃদয়ের সঙ্গমের কারণে।

বড় বিপরীত আচরণ কিন্তু তাতে বাঙালির কিছু এসে যায় না। তারা স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় যে মহিলাকে জীবন্ত দগ্ধ করছে সেই মহিলার ছাই মাথায় মাখছে স্বর্গের দরজা যাতে খুলে যায়। সাড়ে চারশাে বছর আগে কোনাে এক জমিদার স্বপ্নে দেবীদর্শন করলেন, বাঙালি সঙ্গে সঙ্গে প্রসব করল তাঁকে। বোঁচা নাক, চেরা চোখকে টিকোলাে আর টানা করল। একা রাখলে খাঁ খাঁ লাগছিল বলে দুপাশে ছেলেমেয়ে সাজিয়ে দিয়েও দেবীর শরীরে বার্ধক্যের চিহ্ন রাখল না। মা ও মেয়েদের রূপ সমান চোখে গিলতে লাগল শতকের পর শতক। আবার তাঁদের বিদায় করে জলে ফেলে একমাত্র বাঙালি পারল দুঃখে না ভেসে আনন্দের কোলাকুলিতে মাততে। মাথায় থাকল হিমালয়, বাঙালি চাইল তাই দুর্গা দুগ্গা হয়ে গেল।

আর লিঙ্গ যা কিনা শিব, শিব মানেই সুন্দর, হতেই হবে। ঋত্বিক লিখল--

'এ তাে বাঙালি দম্পতি অহং জ্ঞানশূন্য শ্রাবণ 
ভয় ও অভয় দুয়ে মিলে পার্থিব সম্পদ'

দুগ্গা দুগ্গা পড়তে পড়তে মনে পড়ছে সত্যেন্দ্রনাথের সেই লাইন, 'আমরা হেলায় নাগেরে খেলাই, নাগেরি মাথায় নাচি।' এই কাব্যগ্রন্থের সঠিক পরিচিতি হল--

'শান্ত নয়, দাস্য নয়, সখ্যও নয়, বাৎসল্য 
শরীর ও মনের ওপর জ্বলে অভিমানের ধূপ' 

আসলে কি অবাকই না হতে হয়, কোনও এক বাঙালি যা কল্পনা করে প্রসব করল তা তার জাতভাইরা যুগ যুগ ধরে যে যার মতো লালন করে গেল। অজ্ঞানের বশে নিবেদন করে গেল ঐশ্বর্যপ্রসাদ।

ভয় তাে এখানেই। বাঙালির মা দাঁড়িয়ে আছেন সময়ের গলিপাটে, ভয়ে ও স্বভাবে আবার যা বাঙালি প্রসব করবে তা যদি অসুর হয়! 

ঋত্বিকের কাব্য শুরু করার আগে মনে মনে বলি, দুগ্গা দুগ্গা!
ঋ ত্বি ক  ত্রি পা ঠী 

দুগ্গা দুগ্গা


১. 
চোরাকুঠির অন্ধকার নিয়ে গলিপাট মায়া 
রাস্তা গেছে লম্বভাবে সামান্য তার বাঁক 
কিছু আম পিপলাস পাতার নগণ্য অজুহাত 
আমাদের ভুল বানানের ফের দুর্গা অভিসার

২. 
এই পথেই অপেক্ষায় ছােটোবেলার মা 
হঠাৎ হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে পুরাণকল্প 
ধর্মের নামে দেবী অসম্ভব দশ হাত 
সবুজ নখ সিংহ বিষদাঁত, সব তুচ্ছ নিতান্ত

৩. 
সকাল হলেই স্নান, ভয় উধাও, ভক্তি 
খড়ের ওপর মাটি, ক্ষতে দাও প্রলেপ 
রোদের নামে মানত, আরও চাই স্নেহ 
পলকহীন খুব সাবধান, তবেই নিষ্ঠা, চক্ষুদান

৪. 
আমরা আসলে মনকে করি বিশ্লেষণ 
অজ্ঞানের বশে নিবেদন করি ঐশ্বর্যপ্রসাদ 
তিনি তো সাংখ্যদর্শনের গুণময়ী প্রকৃতি 
যুগপৎ সৌম্য ও রুদ্র, লীলার মাধুর্য

৫.
ঘূর্ণিঝড়ে পড়ে থাকা আমরা, অতল 
হাতজোড় করে ছায়াহীন তাকিয়ে তাঁর দিকে 
পায়ের তলায় অসামান্য জলবিভাজন, আবর্ত 
ভূত পেতনিরাও পিঠে ঠেস দিতে চায় অল্প

৬.
তৃতীয় নেত্র মানে ঝড়ের প্রাণবিন্দু, শান্ত 
বিন্দু অথচ উৎস, জড়ের মধ্যে প্রাণসঞ্চার 
নিয়তি ছাড়িয়ে প্রাচীন লােকদেবতা, স্বস্তি 
শক্তির মূলে শূন্যমার্গ নির্ভার পরম্পরা

৭.
ব্রহ্মসদ্ভাব, মূর্তিপূজা পরমব্রহ্মে লীন 
রূপ বর্ণন, সাধকের দিব্যদৃষ্টি স্তুতি ও নাম 
ভীম ও কান্ত, খেটক-খর্পরধারিণী 
দুঃখ ও আর্তির আধার নিরপেক্ষ সাধন

৮.
তুলনায় কোমল স্তন সান্দ্রমুক্তা আশ্রয়ী 
বরফ শাদাকে শাসন করে লিঙ্গশিব 
এ তো বাঙালি দম্পতি অহং জ্ঞানশূন্য শ্রাবণ 
ভয় ও অভয় দুয়ে মিলে পার্থিব সম্পদ

৯.
বৎসরান্তে লৌকিকতা স্মরণযােগ্য আভরণ 
কৈলাসে কিন্তু আগুন জ্বলে সর্বরিক্ত স্মৃতি 
গিরিরাজ জানে এই একমাত্র, মেনকাও একমত 
স্মৃতিতে বেলপাতা সচন্দন গঙ্গাজলের ঢেউ

১০.
যথেষ্ট দু-হাত ভারসাম্যে রােদন-সংসার 
বড় বেশি সম্প্রদান সীমাহীন বৈরাগ্য স্নেহ 
শান্ত নয় দাস্য নয়, সখ্যও নয় বাৎসল্য 
শরীর ও মনের ওপর জ্বলে অভিমানের ধূপ

১১.
আগুন আগুনে মেশে, ভস্ম চিরকাল 
ভস্ম মানে মাটি, তত্ত্ব, গূঢ় ইঙ্গিত 
মিলনের নামে সঞ্চয়, চক্র অনুসরণ বিনির্মাণ 
উপমা দুর্যোগ কাটিয়ে তবেই আরাধনা

১২. 
এও তাে এক সমন্বয়, বৈষম্যের ব্যাকরণ 
শ্রেণিতে রূপক আর আড়ালে ধ্যানসংগীত 
আমরাই গড়েছি সুডৌল হৃদয় অনুপাত 
নূপুর-শােভিত বুক জুড়ে বাৎসল্য উদাস

১৩.
তিনদিন বাদে বৃষ্টি থামল এবার তবে 
রােদের প্রবাদে দাও খরা ফাটল রেখা 
শুশ্রূষার নিয়মে প্রকাশিত ভাব আগমনী 
জানালা দরজায় এসে বসে রঙিন প্রজাপতি

১৪.
ভাগ্যদোষে নেশাখাের স্বামী সতিন সংসার 
তবে বহন করাে আলেখ্য বৈচিত্রহীন দুর্ভাগ্য  
মেনকা তো সরল অন্তর, জানতে চাইবেনই 
স্বর্গের সঙ্গে মর্ত্যমিলন, বৈরাগ্য ও কল্যাণ

১৫.
যদিও বা দমন করেন অসুর, কালস্বরূপা 
নিজেই বন্দি নিজের মধ্যে মুণ্ডমালিনী 
অস্বীকার করেন পতিনিন্দা, সব মিথ্যা 
আসলে নির্বাক সমাজতন্ত্র, চিত্রের পদ্মে ভ্রমর
১৬. 
ভােগ ও মোক্ষ, করতলগত, উভয়ই আশ্চর্য 
নির্বিকার পুরুষপ্রকৃতি চঞ্চলা ক্রিয়াশীল 
এ তো অগ্নিসংযোগ রূপান্তর কৌশলমাত্র 
মান-বহ্নিতে পুড়ে মরা দ্বিবিধ তাৎপর্য

১৭.
প্রসন্ন হওয়া মাত্র কোটি ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি 
বিদ্যুদাকৃতি, তাই বামে দয়া ডানে দান 
চন্দ্রশুভ্র ভ্রূ-মধ্যে লীলা করছে আজ্ঞাচক্র 
তাঁর আছে ইড়া পিঙ্গলা কুণ্ডলিনী শক্তি

১৮.
একেই তো বলে ইচ্ছাশক্তি সহিষ্ণুতা প্রার্থনা 
অদ্বৈতবাদী বৈদান্তিকের মতে জীবমাত্রেই ব্রহ্ম 
তবু তিনিই আমাদের হৃদিপদ্ম অপূর্ব রেণু 
জ্ঞান ও ভক্তি-আশ্রয়ী, তবেই না ভবমুক্তি

১৯. 
সব তীর্থ সার, তুচ্ছ লােকাপবাদ 
ফেরাও গর্তে যন্ত্রীমুখ্য মাতৃপদে শরণ 
কালে কালে জন্মান্তর তবু ভয়যুক্ত ত্বরণ
পদতলে বিরাজিত পুণ্যতােয়া নদনদী

২০.
ভূষণে আড়ম্বর, উচ্ছিষ্টে শ্বাস কোনওক্রমে 
মা ও মেয়ে আসলে এক অঙ্ক বৈচিত্র্য 
অবশ্যম্ভাবী যা তা তো নিয়তির গ্রাস 
পুরাণের নামে সরল জীবন শৈলীবিজ্ঞান

২১. 
ক্রমশ জল বাড়ছে, বাড়ছে তাপমাত্রা 
প্রতিশােধ নিচ্ছে শেকড় এবার বলিদান 
মা তাকিয়ে জ্যোৎস্নায় ভাসছে চোখের জল 
পলাশরক্ত শুষে নিচ্ছে মাটি এক নিঃশ্বাসে

২২.
যাবতীয় মাটির রূপকে দেবী অনন্ত 
প্রাণ বাঁচাতে আমরা শিরস্ত্রাণ খুঁজি ফের 
ত্রিশূলের সামনে, যূপকাষ্ঠে সমান দ্বিত্ব 
বিপরীত দুই শব্দ অনুরাগেই এই জীবন

২৩.
অঙ্গে রূপ রঙ্গে ভূত কাল নিরবধি 
ছায়া আছে এই নেই কিংবা থেকেও নেই 
তৃতীয় শ্রেণির খাদক নির্বাক প্রতিধ্বনি 
উত্তর শূন্য অথচ জন্ম নিচ্ছে আরেক প্রশ্ন

২৪.
অন্যের নিয়তি নিজেরও তাে তাই 
আগমনী শেষে নবমী নিশি ওগাে 
না হইওগাে পার, প্রান্তে কুয়াশা 
বিজয়া তাে শেষ বাঁক অন্তর্হিত করুণাদৃষ্টি

২৫.
এ তাে বাংলার মেয়েদের দুঃখগাথা 
বাংলার বাইরে আছে আরও কত দেশ 
না জানি তাদেরও কে যে কবে সংজ্ঞা দিল 
কবে যে তারা আলাদা হল পৃথিবী থেকে
২৬.
তত্ত্ব ও ভাব সমূহ গৃঢ় ও অভিনব 
আপ্তবাক্যের মতো নিজেই স্থির গম্ভীর 
মাতৃভক্ত আমরা সবাই মায়ের নামে চিহ্নিত 
কীভাবে করি অস্বীকার লীলা, জ্বালামুখ 

২৭.
আসলে আশ্চর্য পৃথিবী আমাদের দুগ্গা মা 
অগ্নি আর দাহিকাশক্তি, উৎপন্ন ও সমগ্র 
ষট্ কর্মের মাঝেই হঠাৎ অধ্যাত্ম আয়ু 
হৈমবতী জিহ্বার নীচে ধরাশায়ী উৎস

২৮.
আমরা দাঁড়িয়ে আজও সমান্তরাল অসহায় 
বাজনা বাজিয়ে বিসর্জনের মূর্তি যায় 
বামে ডানে কার্তিক গণেশ রজ্জুতে তবু ভ্রম 
মুখরা লক্ষ্মী আর সরস্বতী বড্ড ইন্ট্রোভার্ট

২৯.
কী হবে এমন জীবন গুহাতে সহবাস 
বিষের আশায় শিব, ফণা তােলে সাপ 
সেই কবে থেকে জন্মমৃত্যু অলীক থার্ডআই 
দাও রশ্মি এফোঁড় ওফোঁড় হৃদয় উদ্ভাস

৩০.
ভালোবাসার অন্তত এক হাত দাও হে 
দশহাতের সমন্বয় অর্বাচীন জোট সরকার
দাও কিছু প্রাণ, নীলকণ্ঠকে সুধা
মায়ের মতাে কামনার মতাে বিশ্বস্ত পাঠশালা

৩১.
কত সংখ্যক ব্রহ্মাণ্ড! কল্পনা শুচি পায় 
কত সংখ্যক সন্তান ও অসুর নিধন শেষে 
আট হাত ছুড়ে ফেলে আমাদের দেবী কবে 
রাষ্ট্রসংঘের সদস্য, আমাদের মা হবে!

৩২.
শরতের আকাশে রং দিচ্ছেন বিভূতিভূষণ 
বাংলার ঘরে ঘরে বৃত্ত-চোখের দুর্গা 
উচ্চতার তুলনায় ওজন কম, ক্ষণজন্মা 
কত আর লেখা হবে পথের পাঁচালি

৩৩.
ছবি তােলাে, ছাপাে, নিলাম করাে দেহ 
রাস্তা জুড়ে এগিয়ে আসছে নগ্ন যন্ত্রণা 
মণিপুরের দুর্গা মা আজও অভুক্ত 
রাষ্ট্রসন্তান সাবালক হবে! তবে কবে!

৩৪.
অবশ্য কার্তিক দেখাচ্ছে উড়ানপ্রযুক্তি 
গণেশও কম যায় না অঙ্গ প্রতিস্থাপনে 
সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদ লক্ষ্মী জানিয়েছে
সরস্বতী জানে প্রাকপ্রস্তুতি, নিত্যনতুন কলা

৩৫.
বলতে হবে কথা সবচেয়ে বেশি তাদেরই 
যাদের কথা বলে না কেউ শুধু রূপ 
পৃথক লিঙ্গ নির্ণয় সে তাে আরেক জটিলতা 
বীরাঙ্গনা কাব্য পড়ি ফের মধুসঞ্চয়ে

৩৬.
বয়স স্থির, দেবী ও সন্তানের সংখ্যা বাড়ে 
বাংলা মা জ্ঞান হারান চোরাকুঠি অন্ধকারে 
মধুতে চণ্ডাল মাছি আমরা বলছি মায়া মায়া 
অনিবার্য নিরুদ্দেশে ব্যাপ্ত পদ্মরাগ

৩৭.
আজও দাঁড়িয়ে আমাদের মা গলিপাটে 
ভয়ে ও স্বভাবে আমরা করি বানান ভুল
শােক ও শ্লোক নির্মাণে আত্মসমর্পণ 
প্রেমে আতঙ্কে কাব্য করি শেষ। দুগ্গা দুগ্গা।



Post a Comment

6 Comments