জ্বলদর্চি

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত - ১৯ / সুদর্শন নন্দী

পর্ব-১৯
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত  

সুদর্শন নন্দী

১৮৮৫, ১১ই মার্চ। শ্রীরামকৃষ্ণ বলরাম বসুর বৈঠকখানায় বসে আছেন। ভক্তরা সব তাকিয়ে রয়েছেন তিনি কি বলবেন। ঠাকুর এমন সময় গান শোনার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। গান শুরু করলেন  প্রথমে “কেশব কুরু করুণা দীনে, কুঞ্জকাননচারী...” গানটি ( আগে উল্লেখ করেছি) গাইলেন। 
 শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশের প্রতি) বললেন- আহা, বেশ গানটি! তুমিই কি সব গান বেঁধেছ? একজন ভক্ত উত্তর দিলেন- হাঁ, উনিই চৈতন্যলীলার সব গান বেঁধেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশের প্রতি) জবাব দিলেন - এ গানটি খুব উতরেছে।
এরপর তারাপদকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ “নিতাই-এর গান গাইতে পারো?”

আবার গান শুরু হল, :
কিশোরীর প্রেম নিবি আয়, প্রেমের জুয়ার বয়ে যায়।
বইছে রে প্রেম শতধারে, যে যত চায় তত পায়...
 
(গানটি গিরিশ ঘোষের চৈতন্যলীলার গান। এই গানটি গিরিশ ও কালীপদ শ্যামপকুরের বাড়িতে ৬ই নভেম্ভর ১৮৮৫ ঠাকুরকে শুনিয়েছিলেন)   

এরপর শ্রীগৌরাঙ্গের গান হল -

কার ভাবে গৌর বেশে জুড়ালে হে প্রাণ।
প্রেমসাগরে উঠলো তুফান,
 থাকবে না আর কুল মান...
এই গানটিও গিরিশ ঘোষের চৈতন্যলীলার গান।

১১ই মার্চ ১৮৮৫। ঠাকুর বলরাম বসুর বাড়ি থেকে গিরিশচন্দ্র ঘোষের বাড়ি এসেছেন। রাম, বলরাম, চুনিলাল, মাস্টার সবাই উপস্থিত। গিরিশ আর নরেন্দ্রর তরক চলছে ইশ্বর নিয়ে। শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্রকে কাছে বসিয়ে একদৃষ্টে দেখছেন, হঠাৎ তাঁর সামনে আরও সরে গিয়ে বসলেন। নরেন্দ্র অবতার মানেন না — তায় কি এসে যায়? ঠাকুরের ভালবাসা যেন আরও উথলে পড়ল। গায়ে হাত দিয়ে নরেন্দ্রকে বলছেন
 ‘মান কয়লি তো কয়লি, আমরাও তোর মানে আছি (রাই)!’
এটি রায়শেখরের একটি গানের অংশ যা ঠাকুর উল্লেখ করলেন। 
শ্রীরামকৃষ্ণ  নরেন্দ্রের মধ্যে সাক্ষাৎ নারায়ণ দর্শন করছেন? এরই নাম  মানুষে ঈশ্বরদর্শন। নরেন্দ্রের পায়ের উপর হাত — যেন ছল করিয়া নারায়ণের পা টিপছেন —আবার গায়ে হাত বোলাচ্ছেন।  দেখতে দেখতে ঠাকুরের ভাবান্তর হল।  নরেন্দ্রকে বলছেন — “একটা গান (গা) — তাহলে ভাল হবো; — উঠতে পারবো কেমন করে! গোরাপ্রেমে গরগর মাতোয়ারা (নিতাই আমার) —” 
আবার ভাবে বিভোর! 
ঠাকুর বলছেন — 
দেখিস রাই-যমুনায় যে পড়ে যাবি-
কৃষ্ণ প্রেমে উন্মাদিনী। 

এবার নরেন্দ্র গান গাইলেন:
সব দুঃখ দূর করিলে দরশন দিয়ে — মোহিলে প্রাণ।
সপ্তলোক ভুলে শোক, তোমারে পাইয়ে —
কোথায় আমি অতি দীন-হীন ৷৷
গান শুনতে শুনতে শ্রীরামকৃষ্ণের বহির্জগত ভুলে যাচ্ছেন।  সমাধিস্থ!
এই গানটি নরেন্দ্র আরেকবার ( ১৮ই এপ্রিল ১৮৮৬) কাশীপুর উদ্যানে ঠাকুরকে শুনিয়েছিলেন।   


১৮৮৫, ৬ই এপ্রিল। ঠাকুর দেবেন্দ্রনাথ মজুমদারের বাড়িতে ভক্তদের সাথে বসে আছেন। ছোট নরেন, রাম, মাস্টার, গিরিশ, দেবেন্দ্র, উপেন্দ্র, উপস্থিত।খোল-করতাল নিয়ে সংকীর্তন হচ্ছে।  কীর্তনিয়া গাইছেন:

কি দেখিলাম রে, কেশব ভারতীর কুটিরে,
অপরূপ জ্যোতিঃ, শ্রীগৌরাঙ্গ মূরতি,...
ঠাকুর গান শুনতে শুনতে ভাবাবিষ্ট হয়েছেন। কীর্তনীয়া শ্রীকৃষ্ণবিরহবিধুরা ব্রজগোপীর অবস্থা বর্ণনা করছেন।
ব্রজগোপী মাধবীকুঞ্জে মাধবের অন্বেষণ করছেন --
রে মাধবী! আমার মাধব দে!
(দে দে দে, মাধব দে!)
 
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মাঝে মাঝে আখর দিচ্ছেন, --
( এই কীর্তনটির রচয়িতা অজ্ঞাত)

(সে মথুরা কতদূর! যেখানে আমার প্রাণবল্লভ!)
ঠাকুর সমাধিস্থ! স্পন্দহীন দেহ! অনেকক্ষণ স্থির রইলেন।

পরের গানের উল্লেখ পাই ১৮৮৫, ১২ই এপ্রিলে। ঠাকুর বলরাম বসুর বাড়ি গেছেন। ভক্তরা আসছেন যাচ্ছেন। জয়গোপাল, ত্রৈলোক্য, ছোট নরেন এলেন। ত্রৈলোক্যনাথকে বললেন গান শোনাতে। তাঁর গান ঠাকুর খুব পছন্দ করেন। ত্রৈলোক্য নিজের লেখা গান গাইলেনঃ   

জয় শচীনন্দন, গৌর গুণাকার, প্রেম-পরশমণি, ভাব-রস-সাগর।
   কিবা সুন্দর মুরতিমোহন আঁখিরঞ্জন কনকবরণ,
 
গানটি গিরিশচন্দ্র ঘোষ আসার পর ঠাকুর পরিচয় করিয়ে দিয়ে আরেকবার গাইতে বললেন ত্রৈলোক্যকে। তিনি আরেকবার গেয়েছিলেন গানটি। ত্রৈলোক্য এদিন আর কয়েকটি গান গেয়েছিলেন যা অন্যত্র গাওয়ায় আগে আলোচনা করেছি।  

১৮৮৫, ২৪শে এপ্রিল ঠাকুর গিরিশের ঘরে। ভক্তেরা সব রয়েছেন ঠাকুর গিরিশ ও মহিমাচরনকে বললেন বিচার ( ইশ্বর চর্চা)করতে। রাম আপত্তি জানিয়ে বললে এখন কীর্তন হোক। 
কীর্তনিয়া দলবল নিয়ে  উপস্থিত। ঠাকুরের ইঙ্গিত হলেই কীর্তন আরম্ভ হয়। ঠাকুর অনুমতি দিলেন।
রাম (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) -- আপনি বলুন এরা কি গাইবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ -- আমি কি বলব? -- (একটু চিন্তা করে) আচ্ছা, অনুরাগ।
কীর্তনিয়া পূর্বরাগ গাইছেন:
আরে মোর গোরা দ্বিজমণি।
রাধা রাধা বলি কান্দে, লোটায় ধরণী......

এটি বৈষ্ণব পদাবলী বাসুদেব ঘোষের রচনা। 
 
কীর্তন চলতে লাগল -- শ্রীমতীকে সখীগণ বলছেন:
কহ কহ সুবদনী রাধে! কি তোর হইল বিরোধে।।
কেন তোরে আনমন দেখি। কাহে নখে ক্ষিতি তলে লিখি......
 
(গানটি যদুনন্দনের লেখা।) 

কীর্তনিয়া আবার গাইলেন - শ্রীমতী বংশীধ্বনি শুনে পাগলের ন্যায় হয়েছেন। সখীগণের প্রতি শ্রীমতীর উক্তি:
কদম্বের বনে, থাকে কোন্‌ জনে, কেমন শবদ্‌ আসি।
এক আচম্বিতে, শ্রবণের পথে, মরমে রহল পশি......
 
( গানটির রচয়িতা উদ্ধব দাস)

গান চলতে লাগল। শ্রীমতীর কৃষ্ণদর্শন জন্য প্রাণ ব্যাকুল হয়েছে। শ্রীমতী বলছেন:
পহিলে শুনিনু, অপরূপ ধ্বনি, কদম্ব কানন হৈতে।
তারপর দিনে, ভাটের বর্ণনে, শুনি চমকিত চিতে......
 
( এই গানটির রচয়িতা উদ্ধব দাস)

মাধুর্যময় কৃষ্ণনাম শুনে ঠাকুর আর বসতে পারলেন না। একেবারে বাহ্যশূন্য, দণ্ডায়মান। সমাধিস্থ!  
কীর্তনিয়া আবার গাইছেন।  
যে দেখেছি যমুনাতটে। সেই দেখি এই চিত্রপটে।।
যার নাম কহিল বিশাখা। সেই এই পটে আছে লেখা......
 
(এই গানটির রচয়িতা ঘনশ্যাম দাস)
ঠাকুর আবার উঠলেন, নরেন্দ্র সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে এবার উচ্চস্বরে সংকীর্তন শুরু করলেন।

আসি পরের গানে। ১৮৮৫, ৯ই মে বলরাম বসুর বাড়িতে  ঠাকুর গেছেন। রয়েছেন ভক্তেরা। বলরাম বসুর শরীর খারাপ। তাই তিনি মুঙ্গের গেছেন জলবায়ু পরিবর্তনে। তাঁর বড় মেয়ে উৎসবের আয়োজন করেছেন। এদিন নরেন্দ্র অনেকগুলি গান গেয়েছিলেন। 
গান --      পরবত পাথার।
ব্যোমে জাগো রুদ্র উদ্যত বাজ।
 
( রচয়িতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর)

গান --  সুন্দর তোমার নাম দীনশরণ হে,
বহিছে অমৃতধার, জুড়ায় শ্রবণ, প্রাণরমণ হে।
( গানটির পূর্বে উল্লেখ রয়েছে) 

গান -- বিপদভয় বারণ, যে করে ওরে মন, তাঁরে কেন ডাক না;
মিছে ভ্রমে ভুলে সদা, রয়েছ, ভবঘোরে মজি, একি বিড়ম্বনা।
 
( গানটি যদুভট্টের রচনা)
 গান-
দেখিলে তোমার সেই অতুল প্রেম-আননে,
কি ভয় সংসার শোক ঘোর বিপদ শাসনে......
 
(রচয়িতা গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর)
সেদিন মাস্টারের অনুরোধে নরেন্দ্র অনেক গান গাইলেন। গানগুলি একাধিকবার গেয়েছেন। পূর্বে উল্লেখ করেছি।
এবার নারাণের অনুরোধে আবার নরেন্দ্র গাইছেন:

এসো মা এসো মা, ও হৃদয়-রমা, পরাণ-পুতলী গো।
হৃদয়-আসনে, হও মা আসীন, নিরখি তোরে গো...।
 
(গানটির রচয়িতা পুণ্ডরীকাক্ষ মুখোপাধ্যায়। গানটি নরেন্দ্র ১৪ই জুলাই ১৮৮৫ বলরাম মন্দিরেও গেয়েছিলেন)
পরের গানের উল্লেখ পাই ১৩ই জুন ১৮৮৫ দক্ষিণেশ্বরে। শরীর ভাল নেই ঠাকুরের। রোগের সুত্রপাত। ভক্তসঙ্গে রয়েছেন। ত্রৈলোক্যের গান ভাল লাগে ঠাকুরের। ত্রৈলোক্য তানপুরা নিয়ে গান গাইলেন- 
তুঝসে হামনে দিল কো লগায়া, যো কুছ হ্যায় সো তুহি হ্যায়
এক তুঝকো আপনা পায়া, যো কুছ হ্যায় সো তুহি হ্যায়... গানটি। 
গানটি সম্ভবত জাফর আলীর লেখা। গানটি নরেন্দ্রও দুবার গেয়েছেন ২৪শে অক্টোবর শ্যামপুকুরের বাড়িতে এবং ২২শে এপ্রিল ১৮৮৬তে কাশীপুর বাগান বাড়িতে। 
১৮৮৫, ১৪ই জুলাই রথযাত্রা। ঠাকুর আগের দিন থেকে বলরাম বসুর বাড়িতে আছেন।ঠাকুর রথের দড়ি টেনেছেন। নাম সংকীর্তন করেছেন।আজ ঘরে বসে আছেন ভক্ত সঙ্গে। নরেন্দ্র অনেক গুলি গান গাইলেন। 
 গানগুলি একাধিকবার  গাওয়ায় পুনরুল্লেখ করা হল না। তবে কবিগুরুর এই গানটি আজ প্রথম গাইতে দেখি কথামৃতে। 
তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা।
 এ-সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা ৷৷
গানটি ২৪শে অক্টোবর ১৮৮৫ শ্যামপুকুরের বাড়িতে আবার ঠাকুরকে শুনিয়েছিলেন।
উল্লেখ্য, রথের দিন বলরাম বসুর বাড়িতে বৈষ্ণবচরণ মধুকানের ( মধুসূদন কিন্নর) “বিফলে দিন যায় রে বীণে শ্রী হরির সাধন বিনে”  গানটি গেয়েছিলেন। ঠাকুর এই গানটি শুনে সমাধিস্থ হয়ে যান।

-------------------------------------------------


Post a Comment

0 Comments