জ্বলদর্চি

আবৃত্তিকার প্রদীপ ঘোষ স্মরণে/ সাহানারা খাতুন

আবৃত্তিকার প্রদীপ ঘোষ স্মরণে


সা হা না রা খা তু ন


তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম। তাঁর খুব পছন্দের কবিতা ছিল "বিপদে মোরে রক্ষা করো, নহে মোর প্রার্থনা।" আবৃত্তি জগতে যাঁর নাম উজ্জ্বল দিনলিপি হয়ে থাকবে তিনি হলেন আবৃত্তিকার শ্রদ্ধেয় প্রদীপ ঘোষ। 

"তবুও মরিতে হইবে, এও সত্য জানি, মোর বাণী একদিন বাতাসে ফুটিবে না, মোর আঁখি আলোকে লুটিবে না...", যাঁর কণ্ঠে কথাগুলো শুনে মন্ত্রমুগ্ধ হওয়া যায়, তিনি আবৃত্তিকার প্রদীপ ঘোষ। একদিন দুপুরে তাঁর দৃপ্ত কন্ঠে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা 'কামাল পাশা' শুনতে শুনতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হল বুঝতে পারিনি, অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি ছিল সেদিন।

একবার বেহালায় শরৎ সদনে শিল্পীর পা ছুঁতে গিয়ে তাঁর বসার চেয়ারটির হাতল আমার মাথায় লেগে যায়, সাথে সাথে তাঁর মুখে 'আহা' শব্দটি আজও আমার কানে বাজে। শিল্পীকে তো এমনি হতে হয়। মানুষকে ভালোবাসাই তো সবচেয়ে বড় শৈল্পিক গুণ। 

তাঁর ছোট ছোট কথার ফাঁকে মৃদুমধুর হাসি আর কি ভীষণ বিনম্র ভাব, প্রতি মুহূর্তে মানুষটি শ্রদ্ধার আসন দখল করেন। তাঁকে দেখে শেখা যায় সম্মান কিভাবে আদায় করে নিতে হয়। তাঁর কন্ঠের আবৃত্তি প্রতি আবৃত্তিকারের কাছে সম্পদ হয়ে থাকবে। এই শিল্পের সাথে যুক্ত অসংখ্য মানুষের শ্রদ্ধা ভক্তি যেমন তাঁর সম্পদ ছিল এতদিন। 

"মন দিয়ে কাজ করো, ঠিক লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে একদিন " - এই কথাগুলো তাঁর সান্নিধ্যে আসা সবাইকেই বলতেন তিনি। মৃদুভাষী এই মানুষটি ছিলেন নিপাট, সহজ সরল এবং ঘরোয়া। কোন আভিজাত্যের অহংকার বা খ্যাতিকে ভর করে কোনদিন তিনি দূরত্ব রাখতেন না কারোর সাথে। তাঁর অতি কাছের অতি ঘনিষ্ঠ মহল থেকে আজ যে সুর ভেসে আসছে তা স্বজনহারানো কান্না হয়ে বাজছে। তিনি যে কত সহজেই শিক্ষক হয়ে যেতে পারতেন সবার, তিনি আমাদের কাছে চিরঅমর হয়ে থাকবেন। যেমন বিদায় নেই রবীন্দ্রনাথের, বিদায় নেই বিদ্যাসাগরের, তেমনি আবৃত্তির জগতে বিদায় নেই তাঁরও।


আমার মতো তাঁর স্মৃতিচারণ করলেন তাঁর স্নেহভাজন আরো দুই ব্যক্তিত্ব, আবৃত্তিশিল্পে যাঁরা এখন শিক্ষকের ভূমিকায়-

"আমার আবৃত্তি চর্চার শুরু থেকেই যাঁদের একটু একটু করে চিনতে জানতে শিখেছি প্রদীপদা তাঁদেরই অন্যতম, পরবর্তী সময়ে যত এই শিল্পের সঙ্গে বেড়ে উঠেছি ততো একটু একটু করে কাছে এসেছি আর মুগ্ধ হয়েছি কি আবৃত্তি, কি তার মর্মস্পর্শী শব্দ চয়নের উচ্চারণে !! একেকটি শব্দ যেন কর্ণমূল থেকে মণিকোঠায় মুহূর্তে আসন বিছিয়ে বসতো আর দোলা দিয়ে যেত ক্ষণে ক্ষণে অনুষ্ঠানের সূত্রে মিলিত হবার সুযোগ ঘটেছে যতবার ততবারই শুভেচ্ছা আর আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত করেননি... আর গল্প করতে বসলে তো মনে হতো সব কাজ খিদে ঘুম ফেলে মুগ্ধ হয়ে শুনি ঘন্টার পর ঘন্টা,..! যাঁরাই আবৃত্তি করেন তাঁদেরই প্রদীপদা পরিবারের আত্মীয় মনে করতেন, বহুবার তাঁর মুখে শুনেছি কাজী নজরুল ইসলাম এর সঙ্গে শেষ কদিনের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের কথা... আজ অনেক স্মৃতি প্রদীপ দা কে নিয়ে মনের মধ্যে উথাল পাথাল... শেষ দেখা আলাপন সূত্রে তাঁর বাড়িতে প্রায় ঘন্টা দুয়েক... মন বড্ড অস্থির লাগছে, আজ শেষ দেখাটুকু করতে পারলাম না এমনই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে আমরা... দাদা যেখানেই থাকবেন ভালো থাকবেন, শ্রদ্ধা আমার আলাপন পরিবারের সকলের...।"    

-- মলয় পোদ্দার (শিক্ষক, আলাপন আবৃত্তি সংস্থা)


"প্রদীপদা এক মহীরুহের নাম, প্রদীপদা দিগন্ত প্রসারিত এক ব্যাপ্তির নাম, প্রদীপ ঘোষ এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। সেই কবে নব্বইয়ের দশকে যখন কলকাতার মঞ্চে পা রাখতে শুরু করেছিলাম, তখন থেকেই পরিচয়। কত আপন করে নিতেন যখনই দেখা হয়েছে। স্নেহ, ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়েছেন বারবার। কতকিছু শিখেছি ওনার কাছে তা বলার নয়। শব্দের উচ্চারণ কত সুন্দর করে করা যায়, তা ওনার আবৃত্তি শুনে বুঝেছি। বটের ছায়ার মতো ছিলেন আমাদের মাথার উপর, সরে গেল সেই ছায়া, রয়ে গেল তাঁর উচ্চারণ। আজীবন তা কানে বাজবে, হৃদয়ে থাকবে।"

---নরেশ নন্দী (রূপান্তর আবৃত্তি সংস্থা) প্রশিক্ষক, কাব্যায়ন/ব্রততী পরম্পরা।

সাহানারা খাতুন ও প্রদীপ  ঘোষ 


Post a Comment

0 Comments