Spoken language of the fishing community of East-Medinipur district / Bimal Mondal
পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা
বি ম ল ম ণ্ড ল
পর্ব-৫
ধ্বনিতত্ত্ব
২.ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণ ও পরিবর্তন
পূর্ব-মেদিনীপুর জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের আঞ্চলিক ভাষায় ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণ ও অবস্থান চলিত বাংলার মতো। ব্যঞ্জনধ্বনির যে পাঁচটি বর্গ আছে,যেমন- ক,চ,ট,ত,প - এই বর্গ গুলির মধ্যে যে ধ্বনিগুলির অবস্থান আছে। তা এই জেলার মৎস্যজীবী মানুষদের কথ্যভাষায় ক্ষেত্র বিশেষে পরিবর্তন হয় । এই ধ্বনিগুলির পরিবর্তন হলো—
ক- বর্গ :
ব্যঞ্জনধ্বনির অঅন্যতম 'ক' বর্গের ধ্বনিগুলি হলো-ক,খ,গ,ঘ,ঙ। এই বর্গের ধ্বনিগুলির উচ্চারণ ও অবস্থান পূর্ব-মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষায় আঞ্চলিক বাংলা ভাষার মতো ব্যবহৃত হয়। এই বর্গের ধ্বনিগুলির পরিবর্তন হলো—
ক>খ—
শামুক>শামুখ, কানকুঁয়ো>কানখুয়া, পুকুরে>পুখুড়>পুখুর, ফুলকো>ফুলখা,
কোকতুল>কোখতুল,হোক>হখ্, তাক>তাখ্,পাক>প্যাখ্, লোক>লোখ্,খিড়কি>খিড়খি, বৈঠক>বৈঠখ, ভেটকি>ভেটখি,
খ>ক—
চোখ>চোক্, রাখ>রাক্, দেখ>দ্যাক্, সুখ>সুক্
ক>গ—
মুক>মুগ্, ঠিক>ঠিগ্ , কাক>কাগ্ বক>বোগ,লোক>লোগ্
গ>ক—
রোগ>রোক্, গাঁথা>কাঁথা, ডোগা>ডোকা, ভোগ>ভোক্, রাগ>রাক্,যোগ>যোক্,
খ>গ—
বৈশাখ>বৈশাগ্, চোখ>চোগ্,
ঘ>ক—
মাঘ>মাক্, বাঘ>বাক্
গ>ব—
সাগু>সাবু,গোনা >বুনা,
ব>গ—
বোতাম>গুতাম
এই জেলায় 'ঙ' ধ্বনিটি নাকের সুরে সুরে উচ্চারিত হয়। বিভিন্ন বয়স ভেদে এই 'ঙ' ধ্বনিটি নাসিক্যধ্বনি হিসেবে আঞ্চলিক কথ্য ভাষায় লক্ষ্য করা যায়। যেমন-
রং>রোঙ, চোঙ্গা>চোঙ, সং>সঙ,নোঙর>নঙর, নোংরা>নোঙরা
'চ' বর্গ :
এই বর্গের ধ্বনিগুলি হলো -চ,ছ,জ,ঝ,ঞ। এই জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের যে মৌখিক কথ্যভাষা আছে, তা এই বর্গের ধ্বনিগুলির উচ্চারণ ও অবস্থান সেই চলিত বাংলার মতো ব্যবহৃত হয়। এই বর্গের ধ্বনিগুলির যে রূপান্তর ঘটেছে আঞ্চলিক কথ্যভাষায় তা সেই ধ্বনির রূপান্তরিত রূপগুলি হলো -
চ>ছ—
চামচ>চামুছ, ছুঁচ> সুঁছ, নাচ>নাছ, ম্যাচ>ম্যাছ, নাচ>লাছ, কচি>কোছি, লুচ্চা>লুচ্ছা, লুচি>লুছি, লাচ্চা>লাচ্ছা, বাচ্চা>বাচ্ছা
ছ>চ—
মিছরি>মিচরি, মাছ>মাচ্, জোছনা>যোচনা,
জ>চ—
কাগজ>কাগচ , কাজ>কাচ্, লেজ>ল্যাচ,রোজ>রোচ্,
জ>ঝ—
গাঁজা> গ্যাঁঝা,গঞ্জ >গঞ্ঝ,রোজ>রোঝ, গোঁজা>গঁঝা, খোঁজ>খঝ/খুঁঝ , কাজু>কাঝু,আজ>আইঝ
ঝ>জ—
ঝাঁঝ>ঝ্যাঁজ, ঝাঁঝি>ঝাঁজি, মাঝি>মাজি,বোঝা> বজা/বুজি , সাঁঝ>সাঁজ,মাঝনদী>মাজুনদী
'ট'- বর্গ:-
পূর্ব-মেদিনীপুর জেলার বেশিরভাগ অঞ্চল জুড়ে মৎস্যজীবী মানুষের কথ্যভাষায় ' ট' বর্গের বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।শিষ্ট চলিত বাংলার মতো এখানে এই 'ট' ধ্বনির উচ্চারণ পরিবর্তনের যে ভিন্নতা আছে, তা হলো-
ট>ঠ—
একটা>একঠা, মাটি>মাঁঠি,ঠোঁট>ঠোঠ, ঘাট>ঘাঠ,লাট>লাঠ,কষ্ট>কষ্ঠ, স্পষ্ট>পোষ্ঠ, ভোট>ভঠ/ভোঠ,সুস্পষ্ট>পস্ঠ, নষ্ট>নোষ্ঠ, ভাটা>ভাঠা
ঠ>ট—
কাঠ>কাট, মাঠ>মাট, পাঠ>পাট, জ্যৈষ্ঠ >জ্যেষ্ট,
ড>দ—
ডাল>দাল>দাই>ডাই, ডাক্তার>দাক্তার,পাণ্ডা>পনদা,
'ত' বর্গ:-
পূর্ব-মেদিনীপুর জেলার কথ্যভাষায় 'ত' বর্গের ব্যবহার বেশ চোখে পড়ে। নারী-পুরুষ ও শিশুদের কথোপকথনের মধ্যে 'ত'বর্গ অর্থাৎ 'ত', 'থ', 'দ', 'ধ' ও 'ণ' -এর পরিবর্তন চলিত বাংলার মতো ভিন্ন ভিন্ন উচ্চারণ ও অবস্থান অনুযায়ী পরিবর্তন গুলি হলো—
ত>থ—
নামতা>নামথা, ভোঁতা>ভঁথা, পুঁতে>পুথে, পুতুল>পুথুল, বহুত>বহুথ,ভাত>ভাথ, রাত>রাথ, পান্তা>পানথা
থ>ত—
থুঁতনি>থুথনি, বুথ>বুত, কাঁথ(দেওয়াল)> কাঁত, নাথ>নাত,
ত>দ-
চিৎ>চিদ, শীত>শীদ, রাত>রাদ, ভাত>ভাদ
দ>ত-
চাঁদ>চাঁত,সুদ>সুত,ননদ>ননত, হ্রদ>হত/হরত
ধ>দ—
দুধ>দুদ, বোধ>বোদ,শোধ>শোদ
দ>ধ-
দূর>ধুর, রোদ>রোধ, নগদ>নোগোধ
ন>ল-
ন্যাংটা>লাংকটা, নোঙর>নঙর, নাচ>লাচ, নাতি>লাতি, নাপিত>লাপিত, নৌকা>লৌকা, নাতনি>লাতনি, নাড়ী>লাড়ি, নিত>লিত, নাড়ু>লাড়ু,
'প' বর্গ:-
পূর্ব-মেদিনীপুর জেলায় সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় যে সব মৎস্যজীবীরা বসবাস করেন তাদের কথ্যভাষার সঙ্গে পূর্ব - মেদিনীপুর জেলার অনান্য সম্প্রদায়ের মানুষও শিষ্ট ভাষার ন্যায় 'প' বর্গের ধ্বনিগুলি অর্থাৎ 'প', ' ফ','ব', 'ভ' ও 'ম' উচ্চারণ ও অবস্থান অনুযায়ী মৌখিক কথ্যভাষায় রূপান্তরগুলি হলো—
প>ফ—
সুপ্রিম>সুফ্রিম, কোপ>কোফ, চাপ>চাফ,পেঁপে>পিফা, ফাঁপি>ফাফি,বাপন>বাফন, ফুঁপিয়ে>ফঁফিয়ে,কাপ>কাফ, চুপচাপ>চুফচাফ
ফ>প—
ফোঁফরা>ফঁপরা, গোঁফ>গোপ, কফি>কোপি,
প>ব-
চোপ>চোব, কাপ>কাব,চাপ>চাব
ব>প-
সব>সপ, ক্লাব>কেলাব, বাল্ব>বাল্প, বাব>বাপ
ব>ভ-
ডোবা>ডোভা, ডাব>ডাভ, দাবা>দাভা, লম্বাটে>লম্ভাঠে,
এই জেলার কথ্যভাষায় মাঝেমধ্যে দুটি স্বরের 'ব' ধ্বনি লুপ্ত হয় কখনো কখনোও।
যেমন- শ্রাবণ>শায়োন,উপবাস>উপোস, বিবাহ> বায়া/বিয়ে
অন্তঃস্থ ধ্বনি :-
'য','র,'ল' 'ব' - এই চারটি ধ্বনি এই জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষায় উচ্চারণ ও অবস্থান শিষ্ট চলিত বাংলার মতো। এই ধ্বনি চারটির মধ্যে 'য'ও 'ব' অর্ধস্বর, 'র' ও 'ল' তরলস্বর অনুযায়ী ব্যবহৃত হয়। এখানে এই ধ্বনিগত পরিবর্তন হলো—
র>ল-
করলা>কল্লা, রোদন>লদন/লোদন, রাত>লাত, রাঁড়>ল্যাড়,
কখনো কখনো এই জেলার কথ্যভাষায় 'র'যুক্ত ব্যঞ্জনের 'র' ধ্বনির লুপ্ত হয়। যেমন - চৈত্র>চইত /চৈত, ভর্তি>ভত্তি, কর্তা>কত্তা, রাত্রি>রাইত
ল>ন-
লাঙ্গল>নাঙল, লজ্জা>নজ্জা, লোক>নোক, লেজ>ন্যাজা, আস্ লে>আইনে,
কোন কোন অঞ্চলে 'ল' যুক্ত ব্যঞ্জনের 'ল' ধ্বনিটি পদান্তে লোপ পায় এই জেলার কথ্যভাষায়। যেমন-
আলু>আউ, জল>জ, চুল>চু,কুল>কু,
উষ্মধ্বনি :-
পূর্ব-মেদিনীপুর জেলার সমগ্র মানুষের কথ্যভাষায় শিষ্ট চলিতের মতো উষ্মধ্বনির উচ্চারণ শিষের মতো ধ্বনি সৃষ্টি করে। বাংলায় উষ্মধ্বনি গুলি হলো চারটি। তা হলো- 'শ','ষ','স''হ'। এই জেলায় মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষায় 'শ',' ষ','স' - এই তিনটি ধ্বনি 'শ' ও 'স' রূপে উচ্চারিত হয়। সেই উচ্চারণের পরিবর্তনগুলি হলো—
ষ/শ/স>ছ-
বৎসর>বছর, উৎসব>উচ্ছব/মচ্ছব, সামনের দোয়ার>ছামু দুয়ার, সাঁচি তেল>ছাঁচিত্যাল,
শোঁয়া পোকা>ছুয়াপকা, সূঁচ>ছুঁচ,
এই জেলার কথ্যভাষায় প্রায়শই 'হ' উষ্মধ্বনির আগম চোখে পড়ে। যেমন-অই>অহি,দুধ দোয়ানো> দুত দুহাটে,আমাদের>আমাহারে, তোদের>তোহারে, কাদের>কাহার, লুকানো>লুকাটেহ, লোকের ঘরে>লোকে হারে
আবার কখনো কখনো এই 'হ' উষ্মধ্বনিটি 'ন্ন' কিংবা 'ণ্ণ' রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন- চিহ্ন>চিন্ন, কাহ্ন>কাণ্ণ, সায়াহ্ন>সায়ান্ন
এই জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা অনুনাসিক ধ্বনির ব্যবহার দেখা যায়। যেমন- হংস>হাঁস, মাথা>মাঁথা, ব্যাথা>ব্যাঁথা, ছাই>পাঁউস, গুড়ি>গুঁড়া, জেঠাইমা>খুঁড়িমা, পেয়ারা>পেঁহারা, লুঙ্গি>লোঁঙ্গি, মাছ>মাঁচ
--------------------------------
ক্লিক করে আরও পড়ুন।
পূর্বমেদিনীপুর জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের মানুষদের কথ্যভাষায় প্রায়শই 'ঐ'এবং' ঔ' -এই দুটি যৌগিক স্বরধ্বনির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
0 Comments