জ্বলদর্চি

বাঙালির তৃতীয় ভুবনে মানসভ্রমণ ও দুর্গা পুজো দেখা / দীপক সেনগুপ্ত

বাঙালির তৃতীয় ভুবনে মানসভ্রমণ ও দুর্গা পুজো দেখা       
    
দীপক সেনগুপ্ত

ভারতের মানচিত্রকে চোখের সামনে মেলে ধরুন, ডান দিকে চোখ ফেরান দেখবেন একটা ল্যাজের মত উত্তর-পুর্বাঞ্চল ঝুলে রয়েছে মানচিত্রে। উত্তর-পুর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের প্রধান রাজ্য আসাম। চলে আসুন আসামের দক্ষিণ প্রান্তে চারদিকে পাহাড় ঘেরা এক সমতল ভূমিকে দেখতে পাবেন । বরাক এবং কুশিয়ারা নদী বিধৌত এই সমতল ভূমি পঞ্চদশ ভাষা শহিদের রক্তস্নাত। দেশভাগের অভিশপ্ত বিভাজন।  রাখায় খণ্ডিত সুরমা উপত্যকা থেকে বরাক উপত্যকার জন্ম হয়েছে দেশভাগের আগে বর্ধিত সুরমা উপত্যকার অবিচ্ছেদ্য অংশ কাছাড় জেলা দেশভাগের পরে তিন জেলায় ভাগ হয়ে বরাক উপত্যকা  নামক এক কল্পরাজ্যের জন্ম দিয়েছে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ও বরাক উপত্যকার অদৃশ্য বিভাজন রেখা ও দুই উপত্যকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের টানাপড়েনে আবর্তিত হয় আসামের রাজনীতি । ১৯৬১’র একাদশ শহিদের আত্মবলিদান ১৯৯৬ সালে পঞ্চদশ শহিদে উন্নীত হয়েছে। অভিশপ্ত দেশভাগের ব্যথা বেদনা ক্ষোভ ভিটে মাটি হারানো ছিন্নমূল প্রজন্মকে ভাষা আন্দোলন এবং সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় প্রেরণা যোগায়। ব্রাত্য একলব্যের মতই বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে দায়বদ্ধ সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজেদের আত্মপরিচয়কে বাঁচিয়ে রেখেছে। জি টিভির দৌলতে প্রচারের আলোয় উদ্ভাসিত অকাল প্রয়াত কালিকা প্রসাদ ভট্টাচার্য একাদশ শহিদের শহর শিলচরের। কালিকা প্রসাদের মত অনেকেই ছিলেন কিন্তু প্রচারের আলোয় উদ্ভাসিত হননি। শুধু মাত্র নিজেদের ভাষিক অস্তিত্ব বজায় রাখার মরণপণ সংগ্রামের আহ্বান ও প্রত্যাহ্বানে বরাক উপত্যকার বাঙালি যারা আনুপাতিক বিচারে আশি শতাংশের অধিক বহুভাষিক সংস্কৃতিকে মান্যতা দিয়েও নিজেদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরছে। এন আর সি , নাগরিকত্ব আইনে বিব্রত আসামের বাঙালি ( বরাক সহ) হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। ১৮৭৪ সালের প্রথম বঙ্গভঙ্গ বরাক উপত্যকাকে আসামের ল্যাজুড় করে সামাজিক সাংস্কৃতিক বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিল। ৪৭ সালের দেশভাগের সময় ‘রেফারেণ্ডারেম’ এর সুযোগ নিয়ে চা জনজাতি গোষ্ঠীকে ভোট দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে সিলেটকে পাকিস্তানের দিকে ঠেলে দেওয়া হল। বরাক উপত্যকা কার্যত নিসঙ্গ হয়েই ঐতিহ্যকে বুকে নিয়ে কন্টকাকীর্ণ বন্ধুর পথে হাঁটা শুরু করল। 
     দেশভাগের পরে সিলেট অঞ্চল থেকে অনেকেই দক্ষিণ আসামের সমতল ভুমি বরাক উপত্যকায় এসেছেন এই কথা যেমন সত্য ঠিক একই ভাবে এই উপত্যকার নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে। বরাক উপত্যকার শিলচর শহরে বসে রামকুমার নন্দী রচনা করেন ১৮৭২ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বীরাঙ্গনা কাব্যের উত্তরে ‘বীরাঙ্গনা পত্রোত্তর কাব্য’ নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র শিলচরে বসে ‘কমলে কামিনী’  নাটক লিখেন যা কলকাতায় প্রকাশিত হয় ১৮৭৩ সালে। বরাক উপত্যকার শিলচরের সুসন্তান অনিল চন্দ ও তাঁর স্ত্রী রাণী চন্দকে যে কোন রবীন্দ্র অনুরাগী মানুষ এককথায় চিনবেন। আসামের বাঙালি মানেই সব বাংলাদেশী এমন ধারণার বিপ্রতীপে উপরের তথ্যগুলো মোক্ষম জবাব। আসামের বাঙালির লিগ্যাসি ৭১ সাল বা ৫১ সালের মধ্যে না খুঁজে সুদূর অতীতে অনুসন্ধান করাই শ্রেয়।

     এবার আসা যাক দুর্গা পুজোর  কথায়। ১৭৪৫ সালে ডিমাসা রাজাদের (মহারাণী চন্দ্রপ্রভা পুত্র সুরদর্প নারায়ণ)বদান্যতায় এই ভৌগলিক স্থানে অর্থাৎ বরাক উপত্যকায় দুর্গা পূজা জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এই উপত্যকার বর্ধিষ্ণু গ্রাম বড়খলায় ১৭৯০ থেকে পুজো হয়ে আসছে। শিলচর শহরে দুর্গাশঙ্কর দত্তের বাড়ির পুজো সম্ভবত প্রাচীনতম শিলচর শহরের পারিবারিক পূজা ১৮৮৪ সাল থেকে ধারাবাহিক ভাবে চলছে। ১৮৫৫ সালে চা বাগান স্থাপিত হয় বরাক উপত্যকায়।প্রথম চা বাগানের নাম বড়সাঙ্গণ। চা বাগানকে কেন্দ্র করে বরাক উপত্যকার অর্থনীতি সাহিত্য সংস্কৃতি নূতন ভাবে প্রাণ সঞ্চার করল। দুর্গা পুজোকে কেন্দ্র করে বরাক উপত্যকার সাহিত্য সংস্কৃতি এবং অর্থনীতিতে জোয়ার আসে। কোটি কোটি টাকার ব্যাবসা বাণিজ্য হয়। নিম্ন মধ্যবিত্ত অনেক পরিবারের সারা বছরের রোজগার এই সময়েই হয়। পুজোকে কেন্দ্র করেই নিত্য নূতন গান লেখা হয়ে সুরারোপিত হয়ে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে  বাজতে থাকে। কত শত সাহিত্য পত্রিকা উন্মোচিত হয়। পুজোকে কেন্দ্র করেই শুরু হয় নাটকের মহড়া। পুলিশ রিজার্বে মঞ্চস্থ হয় যাত্রা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বরাক উপত্যকায় লোক সংস্কৃতি সহ যাত্রাপালা দুর্গা পুজোকে কেন্দ্র করেই নূতন ভাবে প্রাণ সঞ্চার করে। সাহিত্য পত্রিকা (শারদীয় ক্রোড়পত্র) উন্মোচিত হয়। বাঙালি প্রধান বরাক উপত্যকার প্রধান উৎসব দুর্গা পুজো ভাষিক বা ধর্মীয় পরিসরে আবদ্ধ না থেকে হয়ে উঠে সর্বার্থে সর্বজনীন। ১৪২৭ বঙ্গাব্দ অবশ্যই ব্যতিক্রম। আশা করব কয়েক দিন / মাসের মধ্যেই আমরা ফিরব জীবনের ধারাবাহিক ছন্দে এবং ১৪২৮ সালের দুর্গা পুজো আধুনিকতা নান্দনিকতা এবং ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে হয়ে উঠবে এক মহোৎসব। কলকাতা কিংবা আগরতলার সঙ্গে শিলচর সহ বরাক উপত্যকার নাম উচ্চারিত হবে দুর্গা পুজোর আড়ম্বরে।

Post a Comment

0 Comments