জ্বলদর্চি

ঘোড়াডিহির অন্তর্ধান রহস্য(উপন্যাস)-২ / গৌতম বাড়ই


অলংকরণ- শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য
 

ঘোড়াডিহির অন্তর্ধান রহস্য

গৌ ত ম  বা ড় ই

(পর্ব-২)

সকালে রোদের ঝাঁঝে ঘুম ভাঙ্গলো। পুব দিকের জানালা খোলা। আমাদের বাড়িটা একতলা।বাপ মা সবাই একটা নিয়ম করে টাটা বাই-বাই করেছে।একতলা হলেও বাড়িটি বড়।মাঝখানে ছাদে ওঠার সিঁড়ি।একপাশে মেজদা থাকে তার গোটা পরিবার নিয়ে।আর একপাশে আমি।দিদি আর বোন বাইরে থাকে মানে ওদের পরিবারের সাথে কলকাতার বাইরে আছে।যখন আসে আমার দিককার ঘরগুলি ব্যবহার করে।আর দু দাদা প্রবাসে প্রতিষ্ঠিত।মাঝে মাঝে ফোন করে জেনে নেয়- ক্যামন আছিস?তারপর আলছালের কথার পরে আসলি কথা-এতো জায়গা জমি নিয়ে বাড়ি।তোরা কি আর ধরে রাখতে পারবি?আর এমনিতেই তোদের দুভাইয়ের কোন স্ট্যাবল ইনকাম নেই। প্রোমোটারের সাথে কথা এগোলো?

শালা !এতো ভড়ং মাড়ানোর কী দরকার ছিলো গান্ডু।মনে মনে বললাম।

আমিও লাস্টবারে জানিয়েছি - নো প্রোমোটার। 
বাপের মেহনতের তৈরী এ বাড়ি।যে শালা প্রোমোটার এ বাড়িতে ঘুঁসবার চেষ্টা করবে লুঙ্গি খুলে হাতে ধরিয়ে দেবো।জান ও নিয়ে নিতে পারি।


যে বাড়ি আমরা দুভাইয়ে আগলে রয়েছি সেটা বেমালুম ভুলে গিয়ে নেকুপুসু কথা-তোরা কি রক্ষা করতে পারবি?শালা এই উত্তরাধিকার পৃথিবীর যেখানেই যতই ভালো থাক সম্পত্তির লোভ ছাড়তে পারে না!মেজদাকে বলে দিয়েছি আমি বেঁচে থাকতে এই বাড়ি ভাগ বাঁটোয়ারা কিস্যু হবে না।একে রক্ষা করেই যাবো।তুমি তাই আগ বাড়িয়ে বড়দা আর সেজদাকে কিছু বলতে যেওনা।

সেজদা ফোনে শেষবারে আমার কথা শুনে বললো-দিনে দিনে তোর নেশার মাত্রাটা যে বেড়েছে বুঝতে পারছি।

আমি ফোন রেখে দিয়ে বললাম-আমার ড্যাশ!

জানলা খোলা এই সম্বিৎ ফিরে আসতেই খাটের ওপর দেখলাম আমার মোবাইল ব্যাগ কাগজ পত্তর সালতামামির ডায়েরী সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।ঘরের লাইট ও জ্বলছে।তাহলে পৃথিবীটা এখনও চোরে ভরে যায়নি।এই আবহাওয়ায় এই পরিবেশে লাখো লাখো বে রোজগেরে লাখো খিদের মাঝেও।আমার তিন চারটে মাস্ক ও ঝুলছে দেয়ালে।চকিতে উঠে মোবাইল দেখলাম। হাঁ যা ভেবেছি একগাদা মিসড্ কল।মেঘের সাতটি।তবে কি সালতা ফিরে এলো? মোবাইলে পর্যাপ্ত চার্জ নেই।চার্জার লাগিয়ে মেঘরোদকে ফোন লাগালাম।

সকাল সাড়ে এগারোটা এখন।

আরে কি ব্যপার বলতো?আমি ভাবলাম টেঁসে গেলি নাকি!একটা তো লাপাত্তা হয়েই আছে।যা ঝোলাঝুলির কেস এখন শুনছি।কার যে কখন ঝুলে পড়তে বাধ্য হতে হয়!

শালা!নাটক ছেড়ে আগে বল তোর নাগর ফিরেছে?

ধুর!মালটা যে কোথায় খিল্লি মারাচ্ছে কে জানে?নো নিউজ!হরাইবল ম্যাটার।তবে ঝুলবে না ভাই বুদ্ধু আমার মনে হয়।আর একটু এগিয়ে বলি এটাই তো রহস্যময়।এমন একটা সময়ে রে!

তুই বাড়িতে যদি থাকিস আমি সন্ধেবেলা আসছি।আর আজকেও না ফিরলে একটা মিসিং ডায়েরী করতেই হবে বুঝলি।এর আগে একবার দুদিন পরে ফিরে এসেছিলো তো?

হাঁ।দেড়দিনের মাথায়।ভাবছি তাই।কোথায় গেলো?

ঠিক আছে।আমি সন্ধেবেলায় আসছি।

ফোন রেখে দিয়ে ঝটপট ফ্রেস হয়ে নেবো ঠিক করলাম।ডিম আর শাকসবজি যা আছে দুদিন চলে যাবে।উঠে পড়লাম।এরপর সালতামামির ডায়েরী নিয়ে  বসবো।মন পড়ে আছে ওখানে।উহানে। হাঁ ওখান থেকেই তো এই ভাইরাসের সৃষ্টি।নিজেই নিজেকে তাড়া লাগালাম।ডায়েরীটা ব্যাগে রেখে দিয়েছি আজ দিয়ে দেবো।কাগজের তোড়া পরপর সাজানো।যতটা লেখা ততটাই জেরক্স করিয়ে নিয়েছি।

ডায়েরী পড়তে শুরু করলাম দিনের শেষ আলোয়।পিকলু এসে এরমধ্যে একবাটি কিছু দিয়ে গেলো।আর এক অভ্যাসবশত টেবিলে ঢাকা দিয়ে রেখে বলল-কাকাই মা পাঠিয়েছে।খেয়ে নেবে।পিকলুর জায়গায় টুম্পাই ও ঐ এক কথাই বলবে।মেজদা আমাদের পৈতৃক ঔষধের দোকান নিয়ে খুব ব্যস্ত।জানি এই মুহূর্তে সব ব্যবসা তলানীতে। একমাত্র মেডিসিন আর মুদি দোকানের রমরমা।যাক মেজদা আবার যদি আর্থিক দিক দিয়ে শক্তপোক্ত হয়ে ওঠে খুব ভালো।আমার যা পেশা তাতে মেজদা বৌদি কেউই আমার ব্যক্তিগত পরিসরে ঢোকে না।আমি নিজের মতন থাকি।নিজেই পারলে খাবার এনে বা বানিয়ে খাই।তেমন হলে মেজবৌদির ঘরে গিয়ে খেয়ে আসি।তবে ঐ দিনের বেলা হলে।রাতে আমি স্বাধীন হয়েই ফিরি। রাতে আমার ধরাবাঁধা শাটার ফেলার টাইম নেই।চোখের শাটার আমার ক্লান্তির কাছে হেরেই পড়ে যায়।ডায়েরী নিয়ে বসলাম।

জানুয়ারি ১২ তারিখের লেখাটা পড়তে লাগলাম।

উহান শহর কত দূরে?
উহান এখন ভৌগোলিক মানচিত্রে কালোবিন্দু।পশুবাজার।মানুষ এখনও রক্তে মাংসে স্বাদ খুঁজে বেড়ায়।মেঘকে তাই বলি-ওরে মেঘ তুই ইতিহাস থেকে সভ্যতা শব্দটা বাদ দে।সভ্যতার ইতিহাসে তো মানুষের রক্তের ধারা লেগে আছে শুধু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তো সমাপ্তি ঘটলো লাখো লাখো নিরীহ নারী শিশু নিধন করেই।কে একজন আমাদের ভারতীয় ইতিহাসে যুদ্ধক্ষেত্রে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়ে তবে শোক পালন করে মহা ধার্মিক!ছ্যা ছ্যা!আমরা চেটে যাই এখনো।উহানের সেই চোখের ডাক্তার লি ওয়েন-লিয়াং।চোখের বিশেষজ্ঞ। সাহসী বটে।বন্ধুদের বললেন।সহকর্মীদের বললেন।শহরে এক অদ্ভুত সংক্রামক নিউমোনিয়া হচ্ছে। ডিসেম্বরের শেষে,৩০শে ডিসেম্বর।স্যোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে যেতেই চিন সরকারের কোপে পড়লেন।পাকড়াও হয়েছেন আর শারীরিক অত্যাচারও হয়েছে জানতে পারলাম।

আজ রুটির সাথে কষা মাংস খেলাম।আর খেতে খেতে জিহ্বার স্বাদের সঙ্গে অভুক্ত পাকস্থলীর অনুপাত করছিলাম।বছরটা এলো কিন্তু একগাদা দুশ্চিন্তা নিয়ে।আমার যে অফিস তাদের ব্যবসার হালহকিকত এই বছরে অনেক নিচে নেমেছে তাদের আর্থিক পরিসংখ্যানে।আর এই মুহূর্তে খুবই খারাপ।

এইভাবে আরও কিছুটা পড়ে ভাবতে লাগলাম।সালতামামির চিন্তাধারার সঙ্গে এই ডায়েরীর লেখায় কোন পার্থক্য নেই।মানুষের মনের চিন্তাধারাই তো তার লেখায় থাকে। সালতামামির ফোনটাও সুইচড্ অফ।আজ তিনদিনে পড়লো।আমার মনটা অস্থির হয়ে পড়লো।না,মেঘকে নিয়ে লোকাল পুলিশ স্টেশনে একটা মিসিং ডায়েরী করতেই হবে।ডায়েরী ছেড়ে দ্রুত উঠে পড়ি।মনকে বলি-লে বলগা চল!রেডি হয়ে নে।

ঘোড়াডিহির বিশাল ঝিল যখন পেরোচ্ছি সন্ধ্যা জমাট বেঁধে রাত হয়ে এসেছে।রাত সাতটা পনেরো বাজে।এই জুন মাসের গরমেও হাল্কা ঠাণ্ডা শীতল হাওয়া গায়ে লাগছিলো।গিয়েই মেঘকে নিয়ে বেরুবো, ফোনে কথা হয়ে আছে।শহরের এই দিকের ফাঁকা এবং জলাজমিতে নতুন বসতি গড়ে উঠছে। অসংখ্য বড় বড় ইমারত মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।ওরাও এখানে বছর দুয়েক হলো এই ফ্ল্যাটটি নিয়েছে।ঘোড়াডিহির এই বিস্তীর্ণ ঝিল ঘোড়াডিহির মূল আকর্ষণ।

এপার্টমেন্টের সামনে বাইক নিয়ে দাঁড়াতেই দেখি মেঘরোদহাসি সামনেই একদম টইটুম্বুর তৈরী। দুশ্চিন্তা গুলো আমার মতন মনের অতলে রেখেছে।
সিকিউরিটি গার্ড কেমন যেন বাঁকা চোখে মেঘকে দেখছে।মনে হলো গিয়ে বলি-কী দেখো ভাই?তবে এখন আর এসবে গা না মাখানো ভালো।

থানায় এসে হাজির হলাম।ডিউটি অফিসার আমাদের চোখের ইশারায় বাইরের বেঞ্চে বসতে বললেন।ভেতরে ছ-সাত জন লোক।মেঘরোদহাসি থানার চারিদিক চোখ বুলিয়ে দেখছিলো।আমার পেশাতে আমাকে তো কলকাতার এই থানা ও থানা প্রায় করতে হয়। বুঝলাম ভেতরে অন্যকারো কেস ডায়েরী নেওয়া হচ্ছে।আমার পরিচয় সহজে দেবো না।আগে দেখি কী বলে।

এরপর তৃতীয় পর্বে------
সালতামামির কেস ডায়েরী কি নেওয়া হবে?পুলিশের বড়বাবু কি বললেন?ঘোড়াডিহি থানার ভেতর কী ঘটলো সেই রাতে?

Post a Comment

0 Comments