আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -১৭
শ্যা ম ল জা না
বিশ শতকের সূত্রপাত ও একাধিক ইজম-এর জন্ম
যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি ও এক্সপ্রেশনিজম নিয়ে যে আলোচনা আমরা করলাম, তা বিশ্ব পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে নিঃসন্দেহে মুখ্য আলোচনা হলেও পূর্ণ আলোচনা নয়৷ কারণ, প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে মানুষের আত্মনির্ভরতার যে সদম্ভ প্রয়াস, ভোগ-বিলাসের প্রয়োজনে দৈনন্দিন অপরিহার্য ব্যবহৃত বস্তুর(Essential commodity) তালিকা বাড়ানো, ও তার ফলশ্রুতিতে অবশ্যম্ভাবী ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভেলিউশন ঘটা, তার প্রেক্ষিতে পাকাপাকি শোষণের ব্যবস্থা হওয়া৷ আর, এই সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি মিলিয়েই দেশে দেশে হানাহানি ও যুদ্ধ-পরিস্থিতি তৈরি হওয়া— এই সব কিছু নিয়েই, প্রকৃতির নির্মলতাকে কলুষিত করেই, সামগ্রিকভাবে বিশ্ব আধুনিকতা তার যাত্রা শুরু করল৷
তাই, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভোলিউশন-এর সময়কাল(১৭৬০ থেকে ১৮৪০ ধরে নেওয়া যায়) থেকে আস্তে আস্তে আধুনিকতার সূত্রপাত হলেও একেবারে বিশ শতকের গোড়ায় এসেই তা দ্রুত গতি পেতে শুরু করল৷ গতি, যন্ত্র, প্রযুক্তি, হানাহানি, হিংস্রতা, যুদ্ধ-পরিস্থিতি, নতুন নতুন কাজ, ইত্যাদি নিয়ে যৌবনের উদ্দামতা... এই সব কিছুরই সূত্রপাত ঘটেছিল একেবারে বিশ শতকের শুরুতেই৷ মানুষ সময় ধরে চলতে শুরু করল৷ অর্থাৎ গতি এল জীবনে, প্রচুর ইন্ডাস্ট্রির জন্ম হল৷ স্বাভাবিকভাবেই এল যন্ত্র ও প্রযুক্তির ব্যবহার৷ যুদ্ধ পরিস্থিতির সাথে সাথে এই সব বিষয়গুলিও মানুষের সাধারণ জীবনযাত্রায় সাংঘাতিক প্রভাব ফেলল৷ কিছু মানুষ মনে করল— এ মানুষের জয়যাত্রা৷ কিছু মানুষ মনে করল— এ মানবতার অবনমন৷ এক্সপ্রেশনিজম শুধুমাত্র যুদ্ধ-পরিস্থিতিকে গুরুত্ব দিলেও, এই বাকি বিষয়গুলিও কিন্তু বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যা তারা এড়িয়ে গেছিল৷ ফলে, একই সময়ে, বিশ শতকের প্রথম দু-দশকের মধ্যে একাধিক, বলা যেতে পারে একটার ঘাড়ে একটা, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সব ইজম-এর জন্ম হল৷ এক্সপ্রেশনিজম ছাড়াও ওই একই সময়ে জন্ম নিল— ফিউচারিজম, ভোর্টিসিজম, কিউবিজম, সাররিয়েলিজম, দাদাইজম ইত্যাদি৷ এই ইজমগুলি সময়ের প্রেক্ষিতে প্রত্যেকটাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ কারণ, আধুনিকতার যাত্রা মানুষের আত্মাকে কলুষিত করেছিল৷ সরল থেকে জটিল করে দিয়েছিল মানুষের জীবনযাত্রা৷ এ ধারণা অনেকে ঠিক মনে করেছিল৷ আবার কেউ কেউ উল্টোটাও মনে করেছিল৷ যেমন—
ফিউচারিজম বা ভবিষ্যবাদ৷ নাম শুনে নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে এরা ভবিষ্যতকেই বেশি প্রাধান্য দিত৷ এরা মনে করত— মানুষের জয়যাত্রার অবশ্যম্ভাবী ঘটনা এই বিশ্ব-আধুনিকতা৷ মানুষ ক্রমশ উন্নতি করে বলেই আধুনিকতার জন্ম হয়৷ এইভাবে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়াই অত্যন্ত সঠিক কাজ৷ অতীত আঁকড়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা যায় না৷ তাই, তারা অতীতকে একেবারে অস্বীকার করত৷ এরা যুদ্ধকেও মহিমান্বিত করত৷ মনে করত যুদ্ধ অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটায়৷ আধুনিকতার পক্ষে যা খারাপ, তাকে যুদ্ধ মুছে দেয় বলেই তার জয়যাত্রা অক্ষুণ্ণ থাকে৷ আর, দেশপ্রেমের উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই যুদ্ধ৷ ফলে, পৃথিবীর স্বাস্থ্য ঠিক রাখার একমাত্র সত্য হল— যুদ্ধ ও সামরিকতাবাদ৷ আর তাই, এদের কাজের মধ্যে মানবিক সুকুমার বৃত্তির চেয়েও যান্ত্রিক ও আঙ্গিকবাদী উপাদান তথা বিমূর্ত বিষয়ের উপস্থাপনার প্রাধান্যই বেশি ছিল(ছবি-১)৷
আর অদ্ভুত! এই তত্ত্ব প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সারা ইয়োরোপে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল৷ বিশেষ করে যুব সমাজের মধ্যে৷
আবার, ফিউচারিজম-এর এই মতবাদ কোনো অর্থেই ঠিক নয়! এই মর্মে ফিউচারিজম-এর বিরুদ্ধে আন্দোলনস্বরূপ প্রায় একই সময়ে জন্ম হয়েছিল আর একটি ইজম-এর৷ নাম ভোর্টিসিজম৷ এরা মনে করত— মানুষের দ্বারা মানুষের আকস্মিক ও চরম সর্বনাশ ঘটানো হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে৷ এরই নগ্ন রূপ বিভিন্নভাবে ক্যানভাসে তুলে ধরাই এদের উদ্দেশ্য ছিল৷ তাই, তাঁরা ছবিতে প্রাকৃতিক দৃশ্য(Landscape)ও শারীরিক নগ্নতা(Nudity)আঁকতেন না, বর্জন করেছিলেন(ছবি-২)৷
2 Comments
এক্সপ্রেশনিজম ও নিও এক্সপ্রেশনিজম এর ছত্রছায়া থেকে সামাজিক ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ও যুদ্ধোত্তর প্রেক্ষিতে শিল্প বিপ্লবের দুর্বার গতি,তখনকার জনমানসে তীব্র ছাপ ফেলতে শুরু
ReplyDeleteকরল কি ভাবে।আর কি ভাবেই বা
ফিউচারিজম এর বিপরীতে ভোর্টিসিজম গড়ে উঠেছিল তার
অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ মনোমুগ্ধকর।
আধুনিক শিল্পের বিবর্তনের মধ্য
দিয়ে পাঠক ইতিহাস ছুঁয়ে যেতে
পারবেন, এও কম পাওয়া নয়।
ধন্যবাদ লেখককে।
Thanks
Delete