জ্বলদর্চি

কোথাও কোথাও বিশেষ কিছু রূপের আরাধনা / কালীপদ চক্রবর্ত্তী

   চিত্র- সুব্রত রায়চৌধুরী   


শারদ উৎসব

কা লী প দ  চ ক্র ব র্ত্তী  

পর্ব – ৩

কোথাও কোথাও বিশেষ কিছু রূপের আরাধনা

আজকাল এমন শহর বা গ্রাম খুব কমই আছে যেখানে দুর্গা পূজা হয় না। দুর্গাপূজার পরিধি আজ আর শুধু ভারতবর্ষেই সীমাবদ্ধ নেই। সুদুর আমেরিকা বা কানাডাতে গেলেও দুর্গাপূজা দেখা যায়। তবে স্থান, কাল, পাত্র ভেদে এর বিভিন্ন পরিবর্তনেও দেখা যায়। যেমন গ্রাম্য পূজাগুলিতে প্রকৃতির হৃদয়ের স্পর্শ পাওয়া যায়। ঠিক তেমনি শহর বা কলকাতার  পূজাতে আলোর রোশনাই এবং মণ্ডপসজ্জা সকলকে মুগ্ধ করে। মা দুর্গার মূর্ত্তি নিয়েও আজকাল পরীক্ষা – নিরীক্ষা বা নতুন কল্পনাকে জন্মদেবার চেষ্টা চলে। দিল্লীর পূজাগুলিতে আলোর রোশনাই তেমন না হলেও আজকাল থিম এবং বায়োফ্রেন্ডলি মণ্ডপের সূচনা হয়ে গেছে। এছাড়া আছে ভোগ খাওয়ার এবং বড় বড় শিল্পীদের অনুষ্ঠান দেখার আনন্দ।

দুর্গাপূজা আমাদের বাঙালিদের কাছে শুধু মাতৃ আরাধনাই নয়। এর একটি বিশেষ তাৎপর্যও আছে। এটি একটি মহা মিলন উৎসব। এই দুর্গাপূজা যদিও শ্রীরামচন্দ্র রাবণ বধের প্রাক্কালে করেছিলেন, কিন্তু বাঙালীরা ঠিক কবে থেকে এই পূজা শুরু করে সে সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে যা জানা যায়, তা হল ১৬০৬ সালে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রর পূর্বপুরুষ ভবানন্দ, প্রথম পশ্চিমবঙ্গে এই পূজার প্রচলন করেন। মর্ত্যে প্রথম দুর্গাপূজা করেছিলেন রাজা সুরথ।

কলকাতায় বরিষার সাবর্ণ চৌধুরীদের পরিবার ১৬১০ সালে এই পূজা প্রথম কলকাতায় করেন। তখন এই দুর্গাপূজা সীমাবদ্ধ ছিল ব্যাক্তিগত বা পারিবারিক গণ্ডীর মধ্যে। তখন পূজাতে পাঁঠা, লাউ ইত্যাদি বলি দেওয়া হত। এরপর ১৭৬১ সালে এবং অন্যমতে ১৭৯০ সালে হুগলীতে গুপ্তীপাড়ায় বারোজন বন্ধু (বা বারোজন ইয়ার দোস্ত) মিলে এই পূজা শুরু করে এবং সেই থেকে বারয়ারী পূজার প্রচলন হয়। আর কলকাতায় সতীর ঘাটে ‘ভবানীপুর সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা’ ১৯১০ সালে কলকাতার প্রথম বারোয়ারি দুর্গোৎসব শুরু করেন বলে জানা যায়। এই সতীর ঘাটের নাম ছিল মুখুজ্জে ঘাট এবং পরে সেকালের সম্পন্ন ও খ্যাতিমান পুরুষ বলরাম বসু বঙ্গীয় ১২১৭ অব্দে মুখুজ্জেদের কাছ থেকে দুর্দশাগ্রস্ত ঘাটটিকে কিনে নিয়েছিলেন। এই বলরাম বসু ঘাটে সতীদাহের জন্য ছিল শ্মশান। সেখানে প্রয়াত স্বামীর সাথে মেয়েদের দাহ করা হত।

কথিত আছে যে রাজা নবকৃষ্ণ দেবের সময় থেকে ব্রিটিশ শাসকদেরও এই পূজায় নিমন্ত্রন জানানো শুরু হয়। গোপীমোহন দেব উত্তর কলকাতায় তাঁদের দুর্গাপূজাতে ১৮২৯ সালে ইংরেজদের আমন্ত্রন করে এনেছিলেন। বারোয়ারী পূজা যদিও ১৭৬১ সালে প্রথম শুরু হয় কিন্তু শহরে প্রথম শুরু হয় ১৮৬০ সালে এবং পরবর্তী কালে ১৯২৪ সালে এই বারোয়ারী পূজাই সার্বজনীন পূজার আকার ধারন করে।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুর্গাপূজার সময় শান্তিনিকেতনে বিশাল উৎসবের আয়োজন করতেন। এমনকি তিনি শিলাইদহে থাকার সময় ‘কাত্যায়নী মেলা’র আয়োজন করেছিলেন। আমরা জানি, দেবী দুর্গাই কাত্যায়নী। শিলাইদহে সেই সময় পূজা উপলক্ষে যাত্রা, থিয়েটার, কবিগান, পাঁচালি, বাউল গান চলতো সাত দিন ব্যাপী। দুর্গাপূজা বিভিন্ন প্রদেশে সেখানকার রূপ নেয়। তবে সর্বত্র অটুট থাকে এর অন্তরশক্তি। প্রথা বদলায়, কিন্তু ধর্ম বদলায় না। দুর্গোৎসব সমাজের উঁচু-নিচুর প্রভেদ কমিয়ে দেয়। সমাজের বঞ্চিতদের সম্মান করার আগ্রহবোধ জাগ্রত করে। দুর্গাপূজার জন্য মাটির একাংশ বেশ্যাগৃহ থেকে আসা চাই। এই রীতি এখনও প্রচলিত। বাংলার চিরন্তন এই দুর্গোৎসবের মধ্যেদিয়ে বাঙালি বার বার সকলের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ব্যক্ত করেছে। যে কোনো ধর্মের ভিতরে লুকিয়ে থাকে ভক্তিবাদের নিগূঢ় তত্ত্ব। নেতাজি সুভাষ বসুর সকল চিঠিপত্রের মধ্য দেখা যাবে দেবী দুর্গার প্রতি আনত প্রণতির নিদর্শন। তার সকল চিঠি শুরু হয়েছে “ শ্রী শ্রী দুর্গা মাতা সহায়’ দিয়ে।

মানবতার কবি নজরুল, তাঁর একটি বিখ্যাত আগমনী গান কালোত্তীর্ণ হয়ে নতুন যুগের মানুষকেও শক্তির মন্ত্রে উদ্বোধিত করেছ – 

এবার নবীন মন্ত্রে হবে জননী তোর উদ্বোধন।
সকল জাতির পুরুষ নারীর প্রাণ,
সেই হবে তোর পূজা-বেদী, মা, তোর পীঠস্থান।
সেথা রইবে নাকো ছোঁওয়া-ছুয়ি, উচ্চ-নীচের ভেদ;
সবাই মিলে উচ্চারিব মাতৃনামের বেদ।

আজথেকে ৪০০ বছরেরও আগে অধুনা বাংলাদেশের তাহেরপুরের জমিদার কংস নারায়ণ চৌধুরী বাংলাদেশে শারদীয়া দুর্গাপূজা প্রচলন করেছিলেন।

পঃ বঙ্গের হুগলী জেলার সোমড়া এলাকার রামচন্দ্র সেন প্রায় তিনশো বছর আগে যে দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিলেন তা এখনো হয়ে আসছে এবং সোমড়ার সেন বাড়ির পূজা বলে বিখ্যাত। এই দুর্গার বিশেষত্ব হচ্ছে যে, মা দুর্গার তিনটি হাত, দশটি নয়।

বাঁকুড়ার রাইপুরের নেকড়ে-মুখো দেবীর কথা শোনা যায়। শাস্ত্রে যাঁকে ‘কোকামুখা দুর্গা’ বলা হয়েছে। এমনই আর একটি দুর্গা মূর্তি নাকি রয়েছে বাংলাদেশের মহাস্থান মিউজিয়ামে। 
স্কেচ - সুদেষ্ণা রায়চৌধুরী   

বেলুড় মঠের ঐতিহ্যপূর্ণ দুর্গাপূজার প্রবর্তক ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ স্বয়ং। তিনি এই পূজায় মৃন্ময়ী মূর্ত্তি এনে পূজা করার আগে স্বামীজীর জীবন্ত দুর্গা সকলের জননী মা সারদামণিকে চিন্ময়ী মূর্ত্তিরূপে প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছিলেন।

ঝাড়গ্রামের আদিবাসীরা বছরে দু-বার দুর্গাপুজার আয়োজন করে থাকেন। একটি দুর্গাপূজার নাম কনকদুর্গাপূজা। 

নৈহাটির পালবাড়ির সিংহবাহিনী দুর্গা দশভুজা মুর্তিতে সিং হের ওপর নটরাজের মতো নৃত্যের ভঙ্গিমায় দণ্ডায়মান। লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গনেশ, অসুর নেই, এমনকী হাতে ত্রিশূল পর্যন্ত নেই। তবে কলা বউ থাকে। ত্রিশূল যে হাতে থাকে সেই হাতে রয়েছে বরাভয় মুদ্রা। এখানে দুর্গা প্রসন্নময়ী ভক্তের মঙ্গলের জন্য বরাভয়দাত্রী। 

গোঁসাইগ্রাম এলাকার রায়বাড়িতে কাটামুণ্ডু দুর্গার পূজা হয়। তিনশো বছরের বেশি পূরানো এই পূজা। দেবীর মূর্তি কেবল মাথা থেকে গলা পর্যন্ত। এই পুজোর পেছনে এক ইতিহাস আছে বলে জানা যায়।

শ্রীরামপুরে রামগোবিন্দ গোস্বামীদের বাড়ি শরৎচন্দ্রের ‘পুরাতন বাটী’ নামেই পরিচিত। এই বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল আনুমানিক ৪০০ বছর আগে। রামগোবিন্দ গোস্বামীর সময়ে। রামগোবিন্দ চক্রবর্ত্তীর পিতা লক্ষন চক্রবর্ত্তী ছিলেন পাটুলির (বর্তমানে নবদ্বীপ) অধিবাসী। রামগোবিন্দ চক্রবর্ত্তী বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে গোস্বামী উপাধি প্রাপ্ত হন। রাজা বাসুদেব রায় তাঁকে শ্রীরামপুরে জমি দান করে ছিলেন। এখানকার দুর্গাপুজো বুড়ি দুর্গা নামে খ্যাত।

বালিতে তেল-সিঁদুরের তৈরী প্রাচীন দুর্গা প্রতিমার আবাহন আছে কিন্তু বিসর্জ্জন নেই। বালির বিপত্তারিণী আশ্রমের সাড়ে চারশো বছরের শারদীয়া দুর্গা প্রতিমা সম্পূর্ণ তেল ও সিঁদুরের তৈরী। বহুদিন ধরে তেল-সিঁদুর জমে জমে আপন নিয়মেই এই ব্যতিক্রমী প্রতিমার সৃষ্টি হয়েছে। মহিষাসুর, সিংহ, লক্ষ্মী, কার্তিক, সরস্বতী ও গণেশের প্রতিমা তৈরী হয় মাটি দিয়ে। এই চতুর্ভুজা এলোকেশী রক্তাম্বরা তপ্তকাঞ্চনবর্ণা বিপত্তারিণী দুর্গার মুখমণ্ডল ছাড়া দেহের অন্য কোনো অংশ সাধারণের দ্রষ্টব্য নয়। এই পূজার আরও বৈশিষ্ট হল, এই দুর্গা প্রতিমা কোনও দিন বিসর্জন দেওয়া হয় না। প্রতিবার বিসর্জন হয় শুধুমাত্র মায়ের চার পুত্র-কণ্যার মৃণ্ময় মূর্তিগুলির। পূর্ব্ববঙ্গে আনুমানিক ১৫৮৩ সালে এই পূজার সূচনা হয়। ভারত বিভাগের সময় দেবীকে ঢাকা থেকে বালিতে এনে প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেটাই এখন বিপত্তারিণী আশ্রম নামে পরিচিত। বর্তমানে এই বিপত্তারিণী আশ্রমটি বালির ৪৯ কৈলাশ ব্যানার্জি লেনে।

শিয়ালদহ লাইনে সুভাষগ্রামে অর্ধকালী রূপে দুর্গাবাড়ীতে মা দুর্গা পুজিতা হন। কৃষ্ণনগরের নজির পাড়ায় যে দুর্গাপূজা হয় সেই দুর্গামূর্তির রঙ নীল। সেখানে ষড়রিপুর প্রতীক হিসেবে চালের পিটুলির মানুষ তৈরি করে বলি দেওয়া হয়।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার:-

১। দুর্গোৎসব ও আমাদের প্রাসঙ্গিক ভাবনা – সুকেশ চন্দ্র দেব
২।     দেবী দুর্গা, রাম-সীতা, কৃষি ও পাখি কথা – সাজাহান সরদার
৩।     দুর্গাপূজা ও শক্তিধর্ম – প্রেমরঞ্জন দেব
৪।     বিভিন্ন দেশে ও বিদেশে পত্র, পত্রিকা।
৫।     দুর্গাপূজায় মহালয়া – স্বপন কুমার মিস্ত্রী


Post a Comment

0 Comments