জ্বলদর্চি

দেশ-বিদেশের দুর্গাপূজা / কালীপদ চক্রবর্ত্তী

শারদ উৎসব
পর্ব - ৪

কা লী প দ  চ ক্র ব র্ত্তী 

দেশ-বিদেশের দুর্গাপূজা

কলকাতায় দুর্গাপূজার কথা বলতে গিয়ে কু্মোরটুলির কথা না বললে অন্যায় হবে। দুর্গাপূজার কিছুদিন আগেথেকেই ছোটবেলায় বাগবাজার থেকে গঙ্গারপাড় দিয়ে হেঁটে প্রতিদিন বিকেলবেলা উপস্থিত হতাম দুর্গার মূর্ত্তি বানানো দেখতে। অদ্ভূত সব অভিজ্ঞতা জড়ানো সেই সব স্মৃতি। কুমোরটুলিকে আমরা মৃৎশিল্পী পাড়া বলেই জানি। তবে এর মানে এই নয় যে কুমোরটুলিতে শুধু মৃৎশিল্পীরাই থাকেন। কুমোরটুলি আজকের নয়। শুনেছিলাম কৃষ্ণনগর থেকে ৬/৭ ঘর মৃৎশিল্পী এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন কোন এক সময়। তারপর অনেক উত্থান পতন হয়েছে। অনেক রাজা বদলানোর পালা পেরিয়ে এই অঞ্চল এখন নিজের শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদের দুর্গা প্রতিমা বানানো শুরু হয় রথের দিন থেকে। চলে চতুর্থী, পঞ্চমী পর্য্যন্ত। রথের দিনে প্রতিমা বায়না করার এক প্রাচীন পদ্ধতি আজও চালু আছে এ পাড়ায়। ঠাকুর বানাতে এঁটেল মাটি ও বেলেমাটি দু’ধরনের মাটিই লাগে। জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম যে এঁটেল মাটি আসে উলুবেড়িয়া অঞ্চল থেকে আর বেলেমাটি আসে বাগবাজারের ঘাট থেকে। এখানকার তৈরী প্রতিমা বিদেশেও পাড়ি জমায়। শোলা ছাড়াও আজকাল পলিফাইবার দিয়েও এখন প্রতিমা বানাচ্ছেন কুমোরটুলির শিল্পীরা। তাদের থেকেই জেনেছিলাম যে প্রতিমার চুল তৈরী হয় কলকাতার বাইরে দক্ষিণ ২৪ পরগণায়। কৃষ্ণনগরে তৈরী হয় প্রতিমার চালচিত্র। বর্তমানে এই প্রাচীণ পল্লীকে ও শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে। 

অসমে  দেবী দুর্গা বিভিন্ন নামে ও রূপে পূজিত হন। গুয়াহাটির নীলাচলে কামাখ্যা দেবী ও ভুবনেশ্বরী, সত্রাশালে মঙ্গলচণ্ডী, সাদিয়াতে কাচাইখাইকি – যাকে তামরেশ্বরী নামেও অভিহিত করা হয়, ডিব্রুগড়ে মালিনী, ধুবুরিতে মহামায়া, গোয়ালপাড়ায় তির্থেশ্বরী, জোড়হাটে বুড়িগোঁসাই, মেঘালয়ের সেলাতে জয়ন্তেশ্বরী নামে পূজিত হন। শুধু অসমে নয়, সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতেই বিভিন্ন উপজাতির মানুষ কিছু অদ্ভূত নামে দেবী দুর্গার পূজা করে থাকেন। তাঁদের নিজস্ব কিছু আচরণবিধি ও বৈশিষ্ট্য সহ নিজস্ব পদ্ধতি ব্যবহার করে পূজা হয়। যেমন, গারো জাতির মানুষেরা ‘ফাজু’-র পূজা করেন। খাসি জাতির মানুষেরা কামাখ্যার মতই ‘কাম-মিখা’-র পূজা করেন। অহম জাতির মানুষ পূজা করে ‘সুবাসনী’-র। তিওয়া জাতির দেবীর নাম ‘বাওক’, কার্বিদের ‘রাসেঞ্জা’, বোড়ো জাতির দেবী ‘খাম-মাইখা’ (অনেকটা কামাখ্যার মতই শোনায়), সোনোয়ালদের ‘ভুরালি হাসি’, রাসভাসদের ‘বায়োখো’, ডিমাসাসদের ‘হিরিমাদি’। এ প্রসঙ্গে বলা যেথে পারে এঁরা সকলেই কিন্তু শক্তির দেবী।

ওড়িশার রাজধানি ভুবনেশ্বর থেকে ৮০ কি.মি. দূরে মানিক গোড়া গ্রাম। এই মানিক গোড়া গ্রামের দুর্গাপুজো হয় সমগ্র দেশ থেকে আলাদা রীতি –নীতি মেনে। এই পুজোয় হিন্দু পুরোহিত মন্ত্র উচ্চারণ করার সাথে সাথে মুসলমান সম্প্রদায়ের একজন মানুষ  হাতে দুশের আংটি পরে কাছা দিয়ে পাটের কাপড় পরে পুজ়োয় অংশ নেয়। হাতে শুভ-সুচ (কাঠের হাতা) দিয়ে অপরাজিতা, হোমকুণ্ডে ঘৃতাহুতি দেয় ‘ দ্‌ল বেহরা’। এই প্রথা চলে আসছে ১৫০০ শতাব্দী থেকে। এই দুর্গাপূজোর নাম কনক দুর্গা পূজা। পূজা শুরু হওয়ার ২০ দিন আগে থেকে এখানকার লোকেরা নিরামিষ আহার গ্রহণ করেন।

বিদেশেও দুর্গাপূজা বহুবছর ধরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তার মধ্যে টরোন্টো, বঙ্গীয় পরিষদের দুর্গাপূজার এ বছর ৩৭তম দুর্গাপূজা। ইউরোপের ওয়ালসের পুজার এটি ৩৬তম বছর। ৩১তম দুর্গাপুজা হচ্ছে ইউরোপের Wembley-তে। বোষ্টনের বাংলা ও বিশ্ব-র দুর্গাপূজার এবছর ২৯ বছর হল। বিদেশের দুর্গাপূজাগুলির বিশেষত্ব হল যে সেখানে সাধারণতঃ দু-দিনেই পূজাগুলি হয় অর্থাৎ শনি ও রবি ছুটির দিন দেখে।

কথিত আছে যে মহিষাসুরের সাম্রাজ্য ছিল মাইশোর। তাই সম্ভবত মাইশোরের রাস্তায় রাস্তায় বড় বড় জাংশানে মোটা গোঁফ, বড় বড় চোখ, ডান হাতে উদ্যত তরবারি আর বাঁ হাতে ফণা তোলা কোবরা নিয়ে মহিষাসুরের বিশালকৃতি মূর্তিগুলো দেখা যায়। মাইশোরে দুর্গা চামুণ্ডী বা চামুণ্ডেশ্বী নামেই পরিচিতা। কাছের পাহাড়ী এলাকাতে দেবীর একটি মন্দিরও আছে। গোটা মাইশোর দশেরা উৎসব পালন করে। তাঁরা চামুণ্ডী মন্দিরে গিয়ে দেবী চামুণ্ডেশ্বরীর পূজা করেন। নবমীর দিনটিতে রাজ তরবারির পুজো হয়। দশমীর দিন দশেরা শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। স্থানীয়রা একে  ‘জাম্বো সভরি’ বলে থাকেন। এখানে গোম্বি টোটিল্লু অর্থাৎ পুতুলের পুজো করার রীতিও প্রচলিত আছে।  

দিল্লীতে সম্ভবতঃ প্রথম দুর্গাপূজা করেন রাজসাহীর জনৈক মজুমদার পরিবার ১৮৪২ সালে। তবে সার্বজনীন পূজার প্রথম সূত্রপাত করে “দিল্লী দুর্গাপূজা সমিতি, কাশ্মিরী গেট ১৯১০ সালে। এটিই দিল্লীর প্রাচীণতম, ঐতিহ্যময় সার্বজনীন দুর্গাপূজা। কথিত আছে ১৯৩৬ সালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস এই পূজা উৎসবে যোগদান করেছিলেন। দিল্লীতে দুর্গাপূজার বয়স প্রায় ১০০ বছর হল। সফ্‌দরজঙ্গ এনক্লেভের মাতৃমন্দিরের দুর্গাপূজা শুরু হয় ১৯৬৬ সালে।

জয়েন্ট প্রশেসন কমিটি (J.P.C.)-র একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে ১৯১০ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্য্যন্ত ১৬৬টি দুর্গাপূজা হত। এই সংখ্যা ২০০৬ সালে গিয়ে দাঁড়ায় ৩০৪টি দুর্গাপূজায়। বর্তমানে অবশ্য এই সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে।

দুর্গাপূজার প্রায় একমাস আগে থেকে দিল্লীতে প্রতি পাড়ায় পাড়ায় নাচ, গান, নাটক ইত্যাদির মহড়া শুরু হয়ে যেত। সেই সময় প্যাণ্ডেলে প্যাণ্ডেলে বাংলা সিনেমা দেখানোর খুব প্রচলন ছিল। ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক যাত্রাপালা পরিবেশিত হত। দিল্লীতে ফণি রায়ের যাত্রাপালার কথা এখনো লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে। ১৯৬০ সালে নবরঞ্জন অপেরা দুদিনে একটি পৌরাণিক ও একটি ঐতিহাসিক যাত্রাপালা নিউদিল্লী কালীবাড়ীতে পরিবেশন করেন এবং তখনই ফণি রায় স্থির করেন দিল্লীর যাত্রা দল গঠনের এবং ১৯৬১ সালে ১ লা জুন শ্রীমতি অপেরার জন্ম দেন।

দিল্লীতে অনুষ্ঠিত দুর্গাপূজার একটি বিশেষত্ব হচ্ছে যে বিজয়ার দিন দিল্লীর সব প্রতিমা এবং শোভাযাত্রা নিউদিল্লী কালীবাড়ীতে গিয়ে একত্র হয় এবং সেখান থেকে সন্মিলিত শোভাযাত্রা শুরু। হয়। এই শোভাযাত্রা যাতে সুষ্ঠভাবে পরিচালিত হয় সেই কারণে জয়েন্ট প্রশেসন কমিটি (J.P.C.) গঠণ করা হয়। এই কমিটির উপর নিরাপত্তার দায়িত্ত্ব থাকে। প্রতি পূজা কমিটির প্রতিমার সাথে থাকে বহু ভক্তদের ভীড়, যাঁরা বাসে করে প্রতিমার সাথে সাথে বিসর্জ্জনের স্থান যমুনার গীতা ঘাট পর্য্যন্ত যায়। সব থেকে দেখার মত জিনিষ হল যে এই শোভাযাত্রা বহুদূর পর্য্যন্ত চলে বলে রাস্তায় রাস্তায় জল, পানীয়, ফল ইত্যাদি বিতরণ করতে সাধারণ জনতা এগিয়ে আসেন। এই শোভাযাত্রা দুপর ১২টা/১টায় শুরু হয়ে গীতা ঘাটে পৌছাঁতে সন্ধ্যে হয়ে আসে। গীতা ঘাটে গিয়ে নির্ধারিত জায়গায় প্রতিমাগুলি রাখা হয় এবং বিসর্জ্জনের পূর্বে শেষবারের মত আরতি করে মা দুর্গা-কে বিদায় জানানো হয়। এই সময় প্রতিমাগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা হয় এবং বিভিন্ন পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়। প্রতিমা বিজয়ার ঘাটে যাবার আগে কাশ্মীরী গেটের কর্মকর্তারা প্রতিমা-সহ অপেক্ষা করেন সকলকে স্বাগত জানাতে। কারণ এটিই দিল্লীর সবথেকে প্রাচীণতম পূজা।

আজকাল অবশ্য পূজার সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতে গীতা ঘাটে জায়গার অভাব দেখা দিচ্ছে তাই অনেক পূজা কমিটি তাদের প্রতিমা ওখলার ঘাটে বিসর্জ্জন দিচ্ছে।

প্রতিবছর শরতকালে মা-দুর্গা অসুর নাশিনী এবং মমতাময়ী মায়ের রূপনিয়ে পদার্পণ করেন। তাঁর আগমনে আমাদের মধ্যে পাপ, বিদ্বেষ, মিথ্যা, অহঙ্কার এবং সব পশুবৃত্তিগুলোর যেন অবসান ঘটে, এই হোক আজ আমাদের দৃড় প্রতিজ্ঞা। শারদীয় উৎসব মানুষের পুনরুজ্জীবনের উৎসবে পরিণত হয়ে উঠুক। মানুষের অন্ন, বস্ত্র এবং বাসস্থানের সমস্যার সমাধান হোক।

আসুন আজ সকলে মিলে ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের মঙ্গল কামনা করি। মর্ত্তে আবার শান্তি ফিরে আসুক। পরমানু বোমার হুমকি থেকে মুক্তহোক এই ধরিত্রী। আসুন সবাই মিলে মাতৃ আরাধণা তথা শক্তি আরাধণায় ব্রতী হই।

সর্ব মঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে
শরন্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়নী নমোহস্তুতে।


কৃতজ্ঞতা স্বীকার:-

১। দুর্গোৎসব ও আমাদের প্রাসঙ্গিক ভাবনা – সুকেশ চন্দ্র দেব
২।     দেবী দুর্গা, রাম-সীতা, কৃষি ও পাখি কথা – সাজাহান সরদার
৩।     দুর্গাপূজা ও শক্তিধর্ম – প্রেমরঞ্জন দেব
৪।     বিভিন্ন দেশে ও বিদেশে পত্র, পত্রিকা।
৫।     দুর্গাপূজায় মহালয়া – স্বপন কুমার মিস্ত্রী
৬।  দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন  পত্র-পত্রিকা।

Post a Comment

4 Comments

  1. পুরোটা পড়লাম। অনেক কিছু জানতে পারলাম।

    ReplyDelete
  2. খুবই তথ্য সমৃদ্ধ লেখা। খুব ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  3. পড়ে বেশ আনন্দ পেলাম। এখন সম্ভবতঃ পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে দিল্লির যমুনায় বিসর্জন হচ্ছে কম।

    ReplyDelete
  4. খুব‌ই জ্ঞানবর্ধক ধারাবাহিক। 1970 সাল থেকে দিল্লীর পুজো দেখে আসছি, কিন্তু আগের ইতিহাস এই লেখা থেকে জানছি।

    ReplyDelete