জ্বলদর্চি

বিজ্ঞানে ঈশ্বরের চিহ্ন -১৬ / পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


Sign of science in Almighty

বিজ্ঞানে ঈশ্বরের চিহ্ন 

পর্ব ― ১৬

ওয়র্মহোলের ধারণা :

'চল, ঘুরে আসি।'
'কোথায়?'
'এই কাছে-পিঠে কোথাও। ধর, মঙ্গল কিংবা চাঁদে!' ― কথা ক'টা শেষ না করে হেসে ফেলল সৌরভ। মাথামুণ্ডু না বুঝে হাসি হাসি মুখ করে ক্যাবলাকান্তের মতো চেয়ে থাকে অলক। ক্যাবলাই বটে! উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে সে পাশের কাপগাড়ি কলেজে বাংলায় অনার্স নিয়ে ভর্তি হল! অর্থাভাবে। আর সৌরভ? শহরের নামী কলেজের ফিজিক্স অনার্সের ছাত্র। খুব ব্রিলিয়ান্ট। মুখে যা বলে, তার সুদূরবর্তী অন্তর্নিহিত গভীর অর্থ থাকে। সেই ন্যাংটা বেলা থেকে দুজনে অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। জঙ্গল ঘেঁষা পাশাপাশি দুটি গ্রাম বড়শোল ও বুড়িশোল। অলকের বাড়ি বুড়িশোলে। বড়শোলে সৌরভের। লকডাউনের জেরে এক পক্ষ কাল আগে শহর থেকে গ্রামে ফিরেছে সে। বাড়িতে বসে বসে হাঁপিয়ে উঠছে। এদিকে অলকেরও একই অবস্থা। প্রিয় বন্ধু অনেক দিন পর দেশে ফিরেছে! অথচ করোনার ভয়ে বাড়ির লোকের কড়া নির্দেশ কলকাতা ফেরত বন্ধুর সঙ্গে মেলামেশা, দেখা করা সম্পূর্ণ বারণ। কতদিন আর নিষেধাজ্ঞা মেনে চলা যায়?

অগত্যা দিন পনেরো পেরতে না পেরতেই সাইকেল চেপে বনচণ্ডী পাহাড় ঘুরে দেখতে বেরিয়েছে দুজনে। সাইকেল দুটি বনচণ্ডীর পাদদেশে তালাবদ্ধ করে হাঁটা পথে ঢাল বরাবর খাড়াই ভেঙে উপরে উঠছে তারা। সচরাচর এ পথ মাড়ায় না কেউ। নির্ঘাত মাথা খারাপ না হলে! অদূরে ঝোপের আড়ালে হঠাৎ করেই গুহা মতন কিছু একটা দেখতে পায় সৌরভ। 

'চল তো দেখি, কী ওটা!'
'বাড়ি ফিরে চল, সৌরভ। অন্ধকার নামতে আর বেশি দেরি নেই। বাড়ির লোক চিন্তা করবে।'
'চল, ভেতরে যাই'― ঝোপের কাছে গিয়ে বলল সৌরভ।
'যাবি? আমার কিন্তু খুব ভয় করছে।'
'ভিতু কোথাকার! পেছন পেছন আয়'― ধমকেই হাঁটা দেয় সৌরভ। পিছু পিছু অলক। কিছু দূর যাওয়ার পর সুড়ঙ্গের ভেতরে জলের মতো স্বচ্ছ চকচকে কিছু একটা দেখতে পায় তারা। আশ্চর্য ব্যাপার! কী ওটা? দুজন দুজনের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগে সৌরভ একটা পাথরখণ্ড ছুঁড়ে দেয় সেদিকে। 
'পাথরটার সঙ্গে জিনিসটার ধাক্কা লাগল, শব্দ হলো না কেন?'― বিস্ময় প্রকাশ করে অলক। পরক্ষণেই বলে, 'এখনও সময় আছে। বাড়ি ফিরে চল, সৌরভ।' আরও কাছে গিয়ে সৌরভ পর্যবেক্ষণ করে, পাথরের সঙ্গে বস্তুটার সংঘর্ষে শব্দ কেন হল না। আসলে পাথরখণ্ডটি চকচকে জিনিসটার সম্মুখে যেন হাওয়ায় ভাসছে। আরও ভয় পেয়ে গেল অলক। ভৌতিক ব্যাপার-স্যাপার নয় তো? এদিকে বন্ধুর সঙ্গ পরিত্যাগ করতে সাহসেও কুলোচ্ছে না। খুব ক্লোজ কিনা! ওদিকে সমানে তাড়া করছে ভুতের ভয়। সৌরভের মুখচোখে কৌতূহলের ছাপ স্পষ্ট। রহস্যের সমাধান করতে যেন বদ্ধপরিকর। অলকের বাম হাত ধরে পেছনে জোর হ্যাঁচকা টান দেয় সৌরভ। ঠিক তার আগে ডান হাত বাড়িয়ে সৌরভ স্বচ্ছ পদার্থকে ছুঁয়ে ফেলেছে। আর ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত গতিতে তাদের দুজনকেই প্রচণ্ড বলে আকর্ষণ করে বস্তুটি কাছে টেনে নেয়। তারা জলের মতো স্বচ্ছ বস্তুর ভেতর ঢুকে পড়ে। তারপর দুমড়েমুচড়ে, চরকিবাজি খেতে খেতে অনুভব করে তারা প্রচণ্ড বেগে সম্মুখে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের পাশে সবকিছু যেন ভাঙছে, গড়ছে, আবার ভাঙছে। এমনভাবে দু-তিন মিনিট কেটেছে বোধ করি। বেশ কয়েক পাক ঘোরার শেষে হঠাৎ তারা  ছিটকে পড়ে সুড়ঙ্গ থেকে। হাত দশেক দূরে। পা-হাত ঝেড়ে উঠে দাঁড়ায় দুজন। কিন্তু এ কী! 
'এখানে তো পুরো লাল মৃত্তিকা। ঠিক আমাদের জঙ্গল মহলের কাঁকর মাটি নয়! তাছাড়া কাছেপিঠে একটিও গাছগাছালি দেখছি না কেন? যতদূর দৃষ্টি যায়, শুধু লাল আর লাল। চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। কোথায় এলাম রে বাবা!'― এবার অজ্ঞাত বিপদের আশঙ্কায় শঙ্কিত হয় সৌরভ। প্রচণ্ড গরম! মাথার উপর সূর্য। শক্ত করে অলকের হাত ধরে সে। হাতঘড়ির দিকে তাকায়। 
'এ কী? ঘড়িতে এখন সময় দুপুর ১২ টা পাঁচ! তারিখ "এপ্রিল ১, ২০৫০ সাল"। বেশ অবাক করা ব্যাপার তো!'―অলককে শুধায় সৌরভ। দুজনে চিন্তা করে― এখন কী করা যায়? সাত পাঁচ ভেবে ঢালু মত জায়গার দিকে হেঁটে যায় তারা। কিছু দূর এগোনোর পর একজনকে ওদের দিকে আসতে দেখে আশ্বস্ত হয় সৌরভ। 
'মঙ্গল গ্রহে স্বাগত, বাছারা। আর অসংখ্য ধন্যবাদ, ওয়র্মহোলের ভেতর দিয়ে রেকর্ড সময় মাত্র দুই মিনিট সতেরো সেকেন্ডে মঙ্গলে পৌঁছনোর জন্য।'― কিছু জিজ্ঞেস করার আগে পঞ্চাশোর্ধ্ব শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোকটি বলে ওঠে।
'ওয়র্মহোল! আমরা তো...'
'তোমরা যে সুড়ঙ্গের ভেতরে ঢুকেছিলে, তা যে-সে গুহা ছিল না। সেটা একটা ওয়র্মহোল। কীটগহ্বর।'― জানায় ভদ্রলোক।

উপরে উদ্ধৃত কাহিনিটি কোনো সিনেমা কিংবা রূঢ় বাস্তবের সরস গল্প নয়, বরং তা সম্পূর্ণভাবে লেখকের অবচেতন মনের কাল্পনিক প্রোপাগাণ্ডা, যার ভিত্তি বৈজ্ঞানিক কিছু তথ্য ও সমীকরণ। তাহলে কৌতূহল জাগে, ওয়র্মহোল কী!
সময়টা ১৯৩৫। জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি নিয়ে কাজ করছেন দুই বিজ্ঞানী― আলবার্ট আইনস্টাইন ও নাথান রোজেন। বিষয় ছিল কৃষ্ণগহ্বরের সঙ্গে শ্বেতগহ্বরের যোগসূত্র অনুসন্ধান ও স্থাপন করা। খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে উঠে আসে একটি আশ্চর্য তথ্য। আইনস্টাইন ফিল্ড সমীকরণের গণিতে তারা এমন একটি ব্রিজ বা সুড়ঙ্গের সন্ধান পেলেন যাকে কাজে লাগিয়ে বাস্তবে হয়তোবা ব্রম্ভাণ্ডের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করা যায় কিংবা একটি ব্রম্ভাণ্ড থেকে আরেক ব্রম্ভাণ্ডে অতি অল্প সময়ে পৌঁছে যাওয়া যায়। এ হেন সুড়ঙ্গ 'আইনস্টাইন-রোজেন ব্রিজ' (Einstein-Rosen Bridge) নামে পরিচিত হয়। 

অবশ্য এর অনেক আগে সাধারণ অপেক্ষবাদ আবিষ্কার (১৯১৫)-এর অব্যাহতি পরে ঠিক ১৯১৬ সালে জনৈক বিজ্ঞানী লুডিগ ফ্ল্যাম 'আইনস্টাইন-রোজেন ব্রিজ' আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। তখন অবশ্য ঐ নামে সুড়ঙ্গটি পরিচিত হয়নি।

শ্রী ফ্ল্যাম-এর আবিষ্কারের ক'মাস পরে কার্ল শোয়ার্জসচাইল্ড এক বিশেষ রকমের 'কৃষ্ণগহ্বর'-এর ভবিষ্যদ্বাণী করেন। এমন কালো গহ্বরের কোনও আধান নেই, নিজ অক্ষের চতুর্দিকে ঘোরে না। অর্থাৎ আধানশূন্য অঘূর্ণ সম্পূর্ণ স্থির কৃষ্ণগহ্বর। সেই সুবাদে এরা চিরস্থায়ী। অক্ষয়। অমর। কিন্তু সত্বর এ হেন ব্ল্যাকহোলের জীবন সংকটে পড়ে যখন কোন কিছু (কণা বা আলোক) তার এক প্রান্ত থেকে ভেদ করে অপর প্রান্তে চলে যায়। এতে গহ্বরের ভেতর একটি সুড়ঙ্গ পথ তৈরি হয়। এই গুপ্ত পথই 'শোয়ার্জসচাইল্ড সুড়ঙ্গ' হিসাবে অভিহিত হয়। তিনি আরও বলেন― উভমুখী গমনযোগ্য এমন সুড়ঙ্গ স্থিতিশীল হয় যদি ঋণাত্মক শক্তি ঘনত্বের 'এক্সোটিক পদার্থ' এর মধ্যে সংযোজন করা যায়। 

'এক্সোটিক পদার্থ' কী? 
এক্সোটিক পদার্থ হল সেই কাল্পনিক পদার্থ যার ঋণাত্মক ভর ও ঋণাত্মক শক্তি আছে। এদের চাপও ঋণাত্মক। এরা ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রনের মতো ব্যারিয়ন গ্রুপের পদার্থ নয়, নয় ডার্ক ম্যাটার অথবা অ্যান্টিম্যাটার। এই সব পদার্থ ফিজিক্সের প্রচলিত বিধিগুলি মানে না। শূন্যস্থানে আলোকের চাইতে দ্রুত গতিতে ছোটে। এমন পদার্থের উদাহরণ হল ট্যাকিয়ন কণিকা। 

এখন শোয়ার্জসচাইল্ড সুড়ঙ্গ-ই হল সেদিনের 'আইনস্টাইন-রোজেন ব্রিজ'। এর মাঝে তড়িৎচুম্বকীয় ফিল্ড এনার্জি-র ভর অনুসন্ধান করতে গিয়ে পদার্থবিদ হারম্যান ওয়েইল সর্বপ্রথম পদার্থের 'ওয়র্মহোল' হাইপোথিসিস প্রস্তাব করেন। ১৯২৮ সালে। যদিও তিনি এ হেন সুড়ঙ্গের নাম দিয়েছিলেন 'একমাত্রিক টিউব'। অনেক কাল বাদে ১৯৫৭ সালে এ হেন সুড়ঙ্গ এক জুতসই নাম পায়― 'ওয়র্মহোল'। বাংলা তর্জমায় 'কীটগহ্বর'। নাম প্রস্তাবক জন আর্চিবল্ড হুইলার একজন তাত্ত্বিক ফিজিসিস্ট। ১৯৬২ সালে শ্রী হুইলার এবং রবার্ট ফুলার একটি পেপার পাবলিশ করেন। সেখানে নিঁখুত অঙ্ক কষে তারা দেখান, আইনস্টাইন-রোজেন ব্রিজ ভেঙে পড়বে যদি একই ব্রম্ভাণ্ডে দুটি অংশের সঙ্গে যুক্ত হয় ব্রিজটি। 
এ হেন সুড়ঙ্গের নাম 'কীটগহ্বর' হল কেন? একটি কীট বা পোকা যেমন কাঁচা অথবা পাকা ফল কুরে কুরে খেতে খেতে ফলটির ভেতরে একটু একটু প্রবেশ করতে থাকে, তার ফলে তৈরি হয় সুড়ঙ্গ; ঠিক তেমনি শূন্যস্থান সংকোচনের জন্য স্থান-কালের ভেতর দিয়েও ওয়র্মহোলের মতো সুড়ঙ্গ তৈরি হতে পারে বলে পণ্ডিতদের অভিমত। শূন্যস্থানে এমন সুড়ঙ্গের থাকা, না-থাকা যদিও এখনও প্রমাণ সাপেক্ষ। 

ধরা যাক, একটি কাল্পনিক ফাঁপা অদৃশ্য গোলকের পৃষ্ঠতলে (2-D) এক পোকা অবস্থান করছে। তার লক্ষ্য গোলকের উল্টো প্রান্তে পৌঁছনো। কীভাবে পৌঁছবে সে? হাজার একটা পথ সেখানে পৌঁছনোর। কিন্তু সব চাইতে ন্যূনতম পথ কোনটি? যে পথে এগোলে খুব অল্প সময়ে পৌঁছনো যায় সেখানে। প্রিয় পাঠক, আপনি ভাবছেন একটাই তো পথ আছে অল্প সময়ে সেখানে পৌঁছনোর আর তা হল সরলরৈখিক সুড়ঙ্গ পথ। জ্যা বরাবর। কিংবা ব্যাস বরাবর। কিন্তু সরলরৈখিক দূরত্বেরও হাজার একটা সম্ভাবনা আছে। আর সেই সম্ভাবনা নির্ভর করে গোলকটির বক্রতার ওপর। গোলকের বঙ্কিমতার মাত্রা যত বাড়ে, তত কম হয় সরলরেখার দৈর্ঘ্য। দৈর্ঘ্য এভাবে কমতে কমতে শূন্যের নিকটবর্তী হলে অটোমেটিক্যালি সময় অনেক কম লাগবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছতে। আর এখান থেকেই টাইমমেশিনের পূর্বাভাস মেলে। এ হেন টাইমমেশিনে চড়ে শুধু যে এক বা ভিন্ন ব্রম্ভাণ্ডে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করা যায় তা না, ভুত-ভবিষ্যৎ-অতীত যেখানে খুশি যাওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ কাল্পনিক টাইম ট্রাভেল করা চলে। 

তবে একটা খটকা লাগে! বাস্তবিক, শূন্যস্থানে কী করে সম্ভব টাইম-ট্রাভেল? শূন্যস্থানে অত বক্রতা সৃষ্টি করা যায়? বুড়ো পণ্ডিত বলছেন― হ্যাঁ, যায়। ধরুন, আপনি থাকেন কোলকাতায়, আপনার প্রিয় বন্ধু থাকে ওয়াশিংটনে। হঠাৎ দুজনের একসাথে চা পানের শখ হল। বেকার বেলার মতো। দুজনে চায়ের ঠেকে আড্ডা-ফাড্ডা মেরে তারপর না-হয় নিজ নিজ কর্মজগতে ফিরে যাবেন ঠিক করলেন। হাতে সময় খুব কম। মাত্র পাঁচ মিনিট! সম্ভব ঠেক মারা? শুধু আপনি না, সবাই ভাববে কোন মতে সম্ভব নয়। কিন্তু ঐ বুড়ো পণ্ডিত! সে বলল, সবই সম্ভব। এবার উপায়ও বাতলে দিল সে। বলল, "এখন পৃথিবীর ব্যাস কত? ১২৮০০ কিলোমিটার। একে কমিয়ে আনতে হবে।" কিন্তু কীভাবে?  কার এত দুঃসাহস যে পৃথিবীর আকার কমিয়ে দেয়? 

সে বলল, "আছে একজন। নিউটনের 'মহাকর্ষ'। সেই আকর্ষণ বল যে সবসময় পৃথিবীর আকৃতি কমিয়ে বিন্দুবৎ (সিঙ্গুলারিটি) করতে চায়! শুধু পৃথিবী নয়, পুরো ব্রম্ভাণ্ডের মহাসংকোচন শুরু হলে দায়ী থাকবে একমাত্র সে-বল।। তা এ হেন ক্রমবর্ধমান মহাকর্ষের জন্য পৃথিবী যদি ব্ল্যাকহোলে পরিনত হয়, তখন পৃথিবীর ব্যাসার্ধের মান দাঁড়ায় এক মিলিমিটারেরও কম। এত বিশাল আয়তনের পৃথিবী-গোলকের বক্রতা হ্রাস পেয়ে এত কম মানে পৌঁছলে দুই বন্ধুর চা পান নিশ্চয়ই বিঘ্নিত হবে না; সে বন্ধু যেখানেই থাকুক― ওয়াশিংটন কিংবা অতি দূরের কোনো গ্যালাক্সি।"
আরও বলল, 'অথবা ধরা যাক, দুই বন্ধুর মাঝে কোথাও যদি অসীম ওজনের বস্তু থাকে বা সৃষ্টি করা যায়, তবে ঐ বস্তু তার চারপাশের শূন্যস্থান এত বেশি দুমড়ে মুচড়ে দেবে যে দুই বন্ধুর স্থানিক ব্যবধান অনেক কমে যাবে।'

সব ওয়র্মহোলের ভেতর দিয়ে বস্তুকণা কিংবা আলোক চলাচল করতে পারে? সম্ভবত না। তাহলে কত রকমের কীটগহ্বর আছে? পণ্ডিত বলছেন: ছয় প্রকার― 
      (১) ট্রাভারসেবল (Traversable) ওয়র্মহোল
      (২) নন-ট্রাভারসেবল ওয়র্মহোল
      (৩) ওয়ান-ওয়ে (one way) ওয়র্মহোল
      (৪) টু-ওয়ে (Two way) ওয়র্মহোল
      (৫) ইনট্রা-ইউনিভার্স (Intra-universe) ওয়র্মহোল
      (৬) ইন্টার-ইউনিভার্স (Inter-universe) ওয়র্মহোল

কল্পবিজ্ঞানের উপন্যাস বা সিনেমায় সাধারণত গমনক্ষম (ট্রাভারসেবল) কীটগহ্বরের দেখা মেলে। 'ইন্টারস্টেলার' (Interstellar) সিনেমায় ম্যাথিউ ম্যাককোনাউঘি এবং অ্যানা হ্যাথাওয়ে ঠিক এ ধরনের একটি ওয়র্মহোলের সাহায্য নিয়ে মহাবিশ্বের দূরতম প্রান্তে মনুষ্য বসবাসোপযোগী গ্রহ অনুসন্ধানে বের হয়েছিলেন।

খুব কতিপয় পণ্ডিত এখন বিশ্বাস করেন, কোয়ান্টাম ফোমের সহায়তায় 'ট্রাভারসেবল কীটগহ্বর' তৈরি করা যেতে পারে। কোয়ান্টাম ফোম হল ব্রম্ভাণ্ড জুড়ে থাকা এক ধরনের সাব-অ্যাটমিক গঠন যা পরমাণুর একটি নিউক্লিয়াসের চাইতে বিলিয়ান ট্রিলিয়ন ভাগ ক্ষুদ্র। আজকের টেকনোলজি হয়তো কোয়ান্টাম ফোম শনাক্তকরণের নিপুন কৌশল উদ্ভাবন করতে সমর্থ হয়নি। ভবিষ্যতে হবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়?

অতি সম্প্রতি (২০১৫) একদল স্পেনীয় বিজ্ঞানী ঘোষণা করেন তারা ম্যাগনেটিক ওয়র্মহোল তৈরি করেছেন। এ হেন ওয়র্মহোল এক স্থান থেকে অন্য স্থানে শুধু চৌম্বক ক্ষেত্র সঞ্চালন করে। চৌম্বক সংকেত ওয়র্মহোলের এক মুখে প্রবেশ করে অন্তর্হিত অবস্থায় অগ্রসর হয় এবং শেষে অপর প্রান্ত দিয়ে নির্গত হয়ে যায়। 

এতদসত্ত্বেও কীটগহ্বরের অস্তিত্ব বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ আছে। প্রথমত তার আণুবীক্ষনিক সাইজ। এত ক্ষুদ্র মাপের গহ্বর শনাক্ত করার বিস্তর অসুবিধা। খুবই ক্ষুদ্র আকারের জন্য তার মধ্য দিয়ে গমন করাও অসম্ভব ব্যাপার।

দ্বিতীয়ত তার স্থায়িত্ব। কারণ খুব তাড়াতাড়ি সেগুলি ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। এ হেন কীটগহ্বর এক্সোটিক পদার্থের সংমিশ্রণে অনেক বেশি স্থায়িত্ব লাভ করে। এখন যদি বেশি এক্সোটিক পদার্থ ওয়র্মহোলে মেশানো হয় বা থাকে, তাহলে শূন্যস্থানে টাইম-ট্রাভেল করা যেতে পারে। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং-এর মতে, তাও সম্ভব নয়। কারণ এক্সোটিক পদার্থের অপ্রতুলতা।

তৃতীয়ত এক্সোটিক পদার্থ সহযোগে ওয়র্মহোলের স্থায়িত্ব বাড়লেও টাইম-ট্রাভেলের সময় বাস্তব পদার্থ (মানুষ বা কণিকা)-এর সংযোজন সমগ্র ব্যবস্থার সমতা নষ্ট করে ধ্বংস করবে এমন কৌশল।

Post a Comment

0 Comments