জ্বলদর্চি

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত - ১৮ / সুদর্শন নন্দী

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত  

সু দ র্শ ন  ন ন্দী
  
 
৪ঠা অক্টোবর ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ; ১৯শে আশ্বিন, ১২৯১ সাল।শনিবার কোজাগর পূর্ণিমা (চন্দ্রগ্রহণ)। কেশব সেনের বড় ভাই নবীন সেনের কলুটোলার বাড়িতে ঠাকুর এসেছেন। বাইরের উপরের ঘরে  ঠাকুর বসে। নন্দলাল প্রভৃতি কেশবের ভাইপোরা, কেশবের মা ও তাঁদের আত্মীয় বন্ধুগণ ঠাকুরকে খুব যত্ন করছেন। উপরের ঘরে সংকীর্তন হল।  ব্রাহ্ম ভক্তরা গাইলেন--
(১)কত ভালবাস গো মা মানব সন্তানে,
   মনে হলে প্রেমধারা বহে দুনয়নে (গো মা)...
 
(২) - অন্তরে জাগিছ গো মা অন্তরযামিনী,
     কোলে করে আছ মোরে দিবস যামিনী।

(৩) - কেন রে মন ভাবিস এত দীন হীন কাঙালের মতো,
     আমার মা ব্রহ্মাণ্ডেশ্বরী সিদ্ধেশ্বরী ক্ষেমঙ্করী।

(৪)  কত দিনে হবে সে প্রেম সঞ্চার।
             হয়ে পূর্ণকাম বলব হরিনাম,
             নয়নে বহিবে প্রেম-অশ্রুধার ৷৷

গান তিনটির রচয়িতা ত্রৈলোক্যনাথ স্যান্যাল। প্রথম গানটি রচয়িতা নিজে ১২ই এপ্রিল ১৮৮৫তে বলরাম মন্দিরে গেয়েছিলেন তার উল্লেখ পাই। দ্বিতীয় গানটি নরেন্দ্রনাথ দুবার (২২শে ফেব্রুয়ারি ১৮৮৫  দক্ষিণেশ্বরে এবং ২৭শে অক্টোবর ১৮৮৫ শ্যামপুকুরের বাড়িতে) গেয়েছিলেন তার উল্লেখ রয়েছে কথামৃতে। চতুর্থ  গানটির রচয়িতা নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়। এই গানটি নরেন্দ্রনাথ আরও দুবার (১৪ই জুলাই ১৮৮৫,বলরাম মন্দিরে এবং ২৭শে অক্টোবর ১৮৮৫ শ্যামপুকুরের বাড়িতে)গেয়েছেন তার উল্লেখ পাই।   
এদিন নবীনচন্দ্র সেনের বাড়িতে ঠাকুরও কয়েকটি গান গেয়েছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম--
কে হরিবোল হরিবোল বলিয়ে যায়।
যারে মাধাই জেনে আয়।...গানটি ঠাকুর এদিন গেয়েছেন তার উল্লেখ নেই কথামৃতে। তবে গানটি আরেকদিন (১২ই এপ্রিল ১৮৮৫ বলরাম মন্দিরে) গেয়েছিলেন তার উল্লেখ পাওয়া যায়। 

 এবার পরের দিন,১৮৮৪, ৫ই অক্টোবর। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ঘরে নিজের আসনে বসে আছেন। বেলা প্রায় তিনটা । নীলকণ্ঠ পাঁচ-সাতজন সঙ্গী নিয়ে ঠাকুরের ঘরে  উপস্থিত। ঠাকুর তাকে যেন অভ্যর্থনা করতে অগ্রসর হলেন। নীলকণ্ঠ  ঠাকুরকে প্রণাম করলেন ভূমিষ্ঠ হয়ে।  ধর্মপ্রসঙ্গে কথা হচ্ছে। কিছু পরে ঠাকুর প্রেমোন্মত্ত হয়ে নৃত্য করতে শুরু করলেন। নীলকণ্ঠ ও ভক্তগণ তাঁকে ঘিরে স্বরচিত গান গাইছেন ও নৃত্য করছেন।
গান - শিব শিব বল মন অশিব হইবে নাশ...
এই গানটি শেষ হলে ঠাকুর নীলকণ্ঠকে বলছেন, -- আমি আপনার সেই-গানটি শুনব, কলকাতায় যা শুনেছিলাম। 
নীলকন্ঠ গাইলেন: শ্রীগৌরাঙ্গসুন্দর, নব নটবর, তপত কাঞ্চন কায়... 
মনোমোহন ভাবাবিষ্ট হলেন। মনোমোহন ঠাকুরের ভক্ত ও শ্রীযুক্ত রাখালের সম্বন্ধী।
ঠাকুর এবার গান ধরিলেন:
যাদের হরি বলতে নয়ন ঝুরে, তারা দুভাই এসেছে রে... 
উচ্চ সংকীর্তন শুনে চারদিকে লোক জমেছে।  
কীর্তন শেষ হল। ঠাকুর জগন্মাতাকে প্রণাম করছেন ও বলছেন -- ভাগবত-ভক্ত-ভগবান -- জ্ঞানীদের নমস্কার, যোগীদের নমস্কার, ভক্তদের নমস্কার।
এদিন আর কিছু গান নীলকণ্ঠ ও ঠাকুর গেয়েছিলেন যা পূর্বে উল্লেখ করায় পুনরুল্লেখ করা হল না এখানে।
কথা মৃতে ১১ই অক্টোবর ১৮৮৪তে একটি গানের বর্ণনা পাই যা ঠাকুর গুনগুন করে গেয়েছেন। মাকে প্রনাম করে নিজের ঘরের দিকে আসছেন তিনি । গলায় রামপ্রসাদের গান (আমি কালী ব্রহ্ম জেনে মর্ম ধর্মাধর্ম সব ছেড়েছি)।  সঙ্গে মাস্টার ও কয়েকজন ভক্ত ছিলেন। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে তিনি গাইছেনঃ অবশেষে রাখ গো মা, হাড়ের মালা সিদ্ধি ঘোটা। 
১৮৮৪, ১৮ই অক্টোবর। কালীপূজার রাতে ঠাকুর তাঁর ছোট্ট খাটে বসে মায়ের গান করছেন। কিন্তু অন্তর্মুখ, মাঝে মাঝে ভক্তদের সঙ্গে একটি-দুইটি কথা বলছেন।  আস্তে আস্তে গাইছেন তিনি: কে জানে কালী কেমন, ষড়দর্শনে না পায় দরশন।।(গানটি আগে গেয়েছেন এবং পূর্বে উল্লেখ করেছি। 
ঠাকুর এবার উঠে বসলেন। আজ মায়ের পূজা -- মায়ের নাম করবেন! আবার উৎসাহের সাথে গাইছেন:
এ সব ক্ষেপা মায়ের খেলা
(যার মায়ার ত্রিভুবন বিভোলা) 
(মাগীর আপ্তভাবে গুপ্তলীলা)... 
ঠাকুর গান করতে করতে মাতোয়ারা। বললেন, এ-সব মাতালের ভাবে গান। এই বলে গাইতে লাগলেন এক এক করেঃ 
   (১) - এবার কালী তোমায় খাব।
 (২) - তাই তোমাকে সুধাই কালী।
(৩) - সদানন্দময়ী কালী, মহাকালের মনোমোহিনী।
 
 (৪)-জয় কালী জয় কালী বলে যদি আমার প্রাণ যায়...
 
( প্রথম তিনটি গান পূর্বে উল্লেখ করেছি। চতুর্থ গানটির রচয়িতা নাটোরের মহারাজা রামকৃষ্ণ রায়ের)  

গান শেষ হলে রাজনারায়ণের দুই ছেলে এসে প্রণাম করল। নাটমন্দিরে বিকালে রাজনারায়ণ চন্ডীর গান গেয়েছিলেন, ছেলে দুটিও সঙ্গে সঙ্গে গেয়েছিল। ঠাকুর ছেলে দুটির আঙ্গে আবার গাইলেন: ‘এ সব ক্ষেপা মেয়ের খেলা’।
এছাড়া রামলালও এদিন গান গেয়েছিলেন (গানগুলি পূর্বেও গেয়েছিলেন এবং উল্লেখ করেছি)।  

১৮৮৪, ৯ই নভেম্বর। কালীমন্দিরে কীর্তনের দল এসেছে।মাস্টারের সাথে কথা বলতে বলতে নারায়ন প্রসঙ্গ উঠলে  ঠাকুর গোবিন্দ অধিকারী রচিত “ কুব্জা তমায় কু বুঝায়। রাই পক্ষে বুঝায় এমন কেউ নাই” পদের অংশটি উল্লেখ করেছিলেন।
 
পরের দিন, ১০ই নভেম্বর, ১৮৮৪। ঠাকুর স্নান করলেন। স্নানান্তে ৺কালীঘরে যাচ্ছেন। মণি সঙ্গে আছেন। ঠাকুর তাঁকে ঘরে তালা লাগাতে বললেন।
কালীঘরে গিয়ে ঠাকুর আসনে বসে ও ফুল নিয়ে কখনও নিজের মাথায় কখনও মা-কালীর পাদপদ্মে দিচ্ছেন। ঘরে এসে ভাবে বিভোর ঠাকুর নাম করছেন। মণি মেঝেতে একা। এবার ঠাকুর গান ধরলেন। ভাবে মাতোয়ারা হয়ে গানের ছলে মণিকে শেখাচ্ছেন যে, কালীই ব্রহ্ম, কালী নির্গুণা, আবার সগুণা, অরূপ আবার অনন্তরূপিণী।এরপর গাইলেন পরপর কয়েকটি গান।
১) কে জানে কালী কেমন, ষড়দর্শনে।
২) এ সব ক্ষেপা মেয়ের খেলা।
৩) কালী কে জানে তোমায় মা (তুমি অনন্তরূপিণী!)
তুমি মহাবিদ্যা, অনাদি অনাদ্যা, ভববন্ধের বন্ধনহারিণী তারিণী!
গিরিজা, গোপজা, গোবিন্দমোহিনী, সারদে বরদে নগেন্দ্রনন্দিনী,
জ্ঞানদে মোক্ষদে, কামাখ্যা কামদে, শ্রীরাধা শ্রীকৃষ্ণহৃদিবিলাসিনী।
৪) তার তারিণী! এবার ত্বরিত করিয়ে...
খানিক পরে ঠাকুর জিজ্ঞাসা করছেন - আচ্ছা, আমার এখন কিরকম অবস্থা তোমার বোধ হয়!
মণি (সহাস্যে) বললেন- আপনার সহজাবস্থা।
ঠাকুর আপন মনে গানের ধুয়া ধরলেন, -- 
৫)“সহজ মানুষ না হলে সহজকে না যায় চেনা।”
উল্লেখিত উপরের গানের পাঁচটির মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ গান আগে গেয়েছেন। তৃতীয় গানটির উল্লেখ অন্যদিন নেই। পঞ্চম গানটি ঠাকুর আরেকদিন (৬ই এপ্রিল ১৮৮৫, দেবেন্দ্র মজুমদারের বাড়িতে) গেয়েছিলেন। 

এরপর আমরা চলে যাব  পরের বছর ১৮৮৫তে। এর মাঝে যে গানগুলি গেয়েছেন তা একাধিকবার গাওয়ায় আগেই উল্লেখ করেছি বলি পুনরুল্লেখ করলাম না। এবার আসব ২২শে ফেব্রুয়ারি, ১৮৮৫তে। 
ঠাকুরের জন্মোৎসব পালিত হচ্ছে। ঠাকুর ছোট খাটটিতে বসে আছেন। বেলা ১১টা হবে। রাম প্রভৃতি ভক্তেরা ঠাকুরকে নববস্ত্র পরাবেন। ঠাকুর বলছেন-“না, না।” একজন ইংরেজী পড়া লোককে দেখিয়ে বলছেন, “উনি কি বলবেন!” 
ভক্তেরা অনেক জিদ করাতে ঠাকুর বললেন -- “তোমরা বলছ পরি।”
ভক্তেরা ওই ঘরেতেই ঠাকুরের অন্নাদি আহারের আয়োজন করেছেন।
ঠাকুর এবার নরেন্দ্রকে একটু গান গাইতে বললেন। নরেন্দ্র গাইছেন:
নিবিড় আঁধারে মা তোর চমকে ও রূপরাশি ৷
তাই যোগী ধ্যান ধরে হয়ে গিরিগুহাবাসী...
 
গানটি ত্রৈলোক্যনাথ স্যান্যালের লেখা। গানটি নরেন্দ্র আরও তিনবার (৯ইমে,১৮৮৫ বলরাম মন্দিরে, ১৪ই জুলাই ১৮৮৫ বলরাম মন্দিরে এবং ২৭শে অক্টোবর ১৮৮৫ শ্যামপুকুরের বাড়িতে) গেয়েছেন কথামৃতে তারও উল্লেখ রয়েছে । এছাড়া এই গানটি ৬ই নভেম্বর ১৮৮৫ শ্যামপুকুরের বাড়িতে ঠাকুর ভক্তদের গাইতে বলেছিলেন। মণি ও ভক্তরা গেয়েছিলেন গানটি।
এই গানটি ছাড়া নরেন্দ্র গাইলেন ত্রৈলোক্যনাথ স্যান্যালের লেখা গানঃ 
গাও রে আনন্দময়ীর নাম।
ওরে আমার একতন্ত্রী প্রাণের আরাম।।
এই জন্মোৎসবের দিন একাধিক গান গেয়েছিলেন নরেন্দ্র এবং ঠাকুর গানের উল্লেখও করেছেন কথা প্রসঙ্গে। এসব গান আগেও গেয়েছেন যা উল্লেখ করেছি তাই গানগুলির পুনরুল্লেখ করা হল না।

চিত্র- রবীন্দ্রনাথ কপাট  
-------------------------------------------------
প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে এই ধারাবাহিক। অভিমত জানাতে পারেন। jaladarchi@yahoo.in        

Post a Comment

0 Comments