জ্বলদর্চি

একটা সত্যি ভূতের গল্প/ তড়িৎ ভট্টাচার্য্য

কটা সত্যি ভূতের গল্প

তড়িৎ ভট্টাচার্য্য


এই ঘটনাটি ঘটেছিল আমার আগের বাসস্থান অর্থাৎ প্রিন্স আনােয়ার শাহ রােডে কলাবাগানে এ থাকতে। কলাবাগানে আমাদের নিজেদের বাড়ি মানে পৈতৃক ভিটে। ঐ কলাবাগানের পিছন দিকে ক্রিশ্চানদের একটি কবরখানা আছে। এই কবর খানাটি ১৯৪২ সালে তৈরী হয় পশ্চিম দিক থেকে পূর্বে প্রসারিত দীর্ঘ রাস্তার দুপাশের জমিতে কবরের সারি। আবার একদিকে কবরের মাঝ দিয়ে একটি লম্বা রাস্তাও আছে। মােটামুটি এই কবরখানার মাঠ আর দুটি রাস্তা হাঁটার পক্ষে খুব উপযােগী। বিকেলের দিকে এখানে বেশ লােকজন আসে আশেপাশের পাড়া থেকে। ঘােরা হয়,গল্প হয়, আড্ডা হয় তারপর সন্ধের মুখে সবাই আবার ফিরে যায় নিজের নিজের পাড়ায়। খােলা আকাশের নীচে অতটা উপযুক্ত জায়গা পাওয়াই যায় না। তাই এত ভীড়। আমার বাসস্থানের কাছে বলেই আমি প্রায় ওখানে এসে সময় কাটাতাম। কখনও পায়চারী করতাম কখনােবা বসে বসে চারপাশ দেখতাম। আর এটা শুধু বিকেলে নয় সময় পেলেই সকাল দুপুর যে কোন সময় চলে আসতাম। আমার কাছে কবরখানার মাঠ খুব প্রিয় জায়গা ছিল। এখানে বেশ কয়েকটা গাছ আছে যা দর্শনীয়। পাতাঝরা আর নতুন পাতা বেরুনাের সময় তাদের যা শােভা তা আর কি বলবাে!  দেবদারু, শিমূল, পলাশ, কৃষ্ণচুড়া ছাড়া আর একটা গাছ যার নাম আমি জানি না। তার নিচে দাঁড়ালে মনটা এতাে ভাল লাগতাে বলার নয়। এক বিদেশি মহিলার কবরের ওপর গাছটা বড় হয়েছে। আমার তাে মনে হয় মহিলা অত্যন্ত দয়ালু এবং বিদুষী ছিলেন।
যাই হােক অনেক কথা লেখা হলাে এবার আসল ঘটনায় আসা যাক। আসলে ভূতের গল্প তাে তাই কলমটাকে একটু সড়গড় করে নিলাম। সেটা ছিল ফাল্গুন মাসের এক বিকেল। আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে যে রাস্তাটি পশ্চিম থেকে পূর্বে অর্থাৎ আমাদের দিকে এসেছে তারই ওপর ঘাসের মধ্যে বসেছিলাম। সুন্দর বিকেল, আকাশ পরিষ্কার, পশ্চিমে সূর্যদেব একটু একটু করে এগুচ্ছেন। ভারী মিষ্টি হাওয়া দিচ্ছে দূরে পলাশ আর কৃষ্ণচূড়ার মাথা দিয়ে। আমি চুপচাপ বসে প্রকৃতিকে উপভােগ করছিলাম, ভীষণ ভালাে লাগছিল। আমার পাশ দিয়ে অনেকেই হাঁটতে হাঁটতে যাওয়া আসা করছে। তার মধ্যে বেশির ভাগ পরিচিত কিন্তু আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। একলা বসে ফাল্গুনের এই সুন্দর বিকেলটাকে মনে ধরে রাখার চেষ্টা করছিলাম। এর মধ্যে লক্ষ্য করিনি কখন সূর্যদেব পাটে বসেছেন। লােকজনও আস্তে আস্তে কমছে। একটা সময় আলাে বেশ কমে এলাে একটা আবছা পরিবেশ তৈরী হলাে। কবরখানার মাঠ তখন প্রায় ফাঁকা। আকাশের থেকে চোখ নামিয়ে সামনের দিকে তাকাতেই একটা অদ্ভুত জিনিস আমার নজরে পড়লো। দূরে কবরখানার ভেতর যে রাস্তাটা আছে সেখানে কবরের পাশে সাদা মতাে কি একটা নড়ছে। প্রথমে ভেবেছিলাম বােধহয় গরু হবে। একটু ভাল করে লক্ষ্য করার পর বুঝলাম না গােরু নয় কিছু একটা জিনিস। সেটা নড়তে নড়তে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। একদম প্রথমে আমার ভেতরে কোনও অনুভূতিই হয়নি কিন্তু ঠিক তারপরই হঠাৎ মনে হলাে প্রায় অন্ধকার কবরখানার মাঝে ওটা কি ভূত নাকি? ভূত আমি বিশ্বাস করি না, অনেকেই করে। এই কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি যেন একটু সচেতন হয়ে গেলাম। ওদিকে সেই সাদা বস্তুটি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে মাঝ এর রাস্তা দিয়ে। আমি এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছি। কবরখানার মাঠ ফাঁকা।  আমি একা বসে আছি। অন্য সময় এই সময় আমি বাড়ির দিকে হাঁটা দিতাম। আজ কিন্তু একেবারে অন্য রকম মনােভাব। কি আসছে ওটা একটু একটু করে এগিয়ে আমারই দিকে, ভূত বলে কিছু নেই আমি নিশ্চিত। মৃত্যুর পর কবর হােক আর পােড়ালেই হােক সবশেষ। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা আমায় বেশ ধন্দে ফেলে দিলাে। কবরখানাকে কেন্দ্র করে নানান ভূতের গল্প পশ্চিমি সাহিত্যে আছে। অবিশ্বাস্য এবং ভয়ঙ্করও বটে। ঠিক এই  মুুুুহূর্তে সেই সব গল্প আমার মনে আসতে লাগলাে। এর মধ্যে সেই সাদা বস্তুটা কিন্তু অনেকটা এগিয়ে এসেছে। মাঝের রাস্তা ছেড়ে এখন আমি যে রাস্তাটার বসে আছি সেই দিকেই আসছে। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছি না কি ওটা। পার্থিব না অপার্থিব কিছু। একটু পরেই আমি ওর মুখােমুখি হবাে। অদ্ভুত একটা উত্তেজনায় ভরা পরিবেশ। 

কবরখানার পাঁচিলের বাইরে বরাবর লাইট পােস্টগুলােতে আলাে জ্বলছে। কবরখানার ভেতরটায় তার কোনও প্রভাব নেই। এখানে সার সার কবরে ঘুরছে কতজন কে জানে। কে জানে তাদের কেউ কি ঘুম থেকে উঠে এগিয়ে আসছে। সন্ধ্যেই তাে ওদের সঠিক সময়। সেই বিখ্যাত গল্পটা মনে হচ্ছে যেটা সিনেমা হয়েছিল সন্ধ্যে হলেই কবর থেকে উঠে পড়তাে আবার ভাের হবার আগেই কবরে ঢুকে পড়তাে, কি যে নামটা মনে পড়ছে না কিন্তু গল্পটা মনে পড়ছে। এর মধ্যে ঐ বস্তুটি প্রায় আমার কাছে এসে পড়েছে। এবার একটু একটু বােঝা যাচ্ছে সাদা থান পরা কোমর ভাঙা এক বৃদ্ধা হাতে একটা লাঠি। আমার কাছাকাছি আসতে আমি জিজ্ঞাসা করলাম কে আপনি কি করছেন এখানে, এই কবরখানায় ? জিজ্ঞাসা করতেই সে আমার দিকে তাকিয়ে বললাে তার ছাগলটা হারিয়ে গিয়েছে তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। অদ্ভুত কিন্তু তার চোখ দুটো কিরকম একটা ফ্যাকাশে ভাব আর চোখের পাতা পড়ছে না। উত্তর দিতে দিতেই সে আমার পাশ দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল এই কথা বলে যে সে ঐ কলােনীতে থাকে। কেউ পাশ দিয়ে মানে একেবারে গা ছুঁয়ে বেরিয়ে গেলে একটু তাে হাওয়া লাগবে গায়ে। না সেরকম কিছু অনুভব করলাম না। পেছন দিকে তাকিয়ে দেখি কবরখানার মাঠ ছেড়ে সেই মূৰ্ত্তি রাস্তায় উঠলাে আর তারপর একটু এগিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেল। কবরখানার এই অংশের পাঁচিল ভাঙ্গা তাই ঐখান দিয়েই সব বিকেলে আসে। আমি জোর করে উঠে পড়লাম বুঝলাম আমার শরীর আর মনের ওপর একটা চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ধীরে ধীরে ঐ পথ ধরেই বাড়ির দিকে এগুলাম যে পথ দিয়েই ঐ ভূতটা গিয়েছে। বাড়ি ফিরে এক গ্লাস জল খেয়ে ভাবলাম তা হলে আমার বিশ্বাসটা কি ভুল। ভূত কি তাহলে আছে ? আজও তার উত্তর পাইনি। আমি পরে কলােনীতে গিয়ে ঐ কোমরভাঙ্গা বুড়ির খোঁজ করেছিলাম। কেউ কিছু বলতে পারে নি আর আমিও তাকে দেখতে পাইনি।

Post a Comment

0 Comments