জ্বলদর্চি

দুর্গাপূজার কিছু ব্যতিক্রমী অনুষঙ্গ/ তুলসীদাস মাইতি

দুর্গাপূজার কিছু ব্যতিক্রমী অনুষঙ্গ : সম্মান অসম্মানের নানা প্রশ্ন 

তু ল সী দা স  মা ই তি



এক।  মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার আরাধনা:
         অপমানিত অসুরদের শোক উৎসব 

পুজো আসছে। আর কদিন পরেই সেজে উঠবে উৎসবের উঠোন। মহালয়া থেকে ধরলে এক পক্ষ কাল মেতে থাকা।  অবশ্য এবছর একটু অন্য রকম। মহালয়ার অনেকগুলো দিন  পরে পুজো। কিছু দশক পরে পরে এমন হয়ে থাকে। তাতে আনন্দের কমতি হয় না। এমনকি অতিমারীর ভ্রূকুটিও বাঙালির পুজো উচ্ছ্বাসকে একেবারেই ম্লান করে দেবে বলে মনে হয় না। অকাল বোধন ও অসুর নিধনকে কেন্দ্র করে বাঙালির এই শ্রেষ্ঠ আনন্দ উৎসবে সবাই মেতে উঠবে তা অনায়াসে অনুমেয়। কিন্তু  এর ব্যতিক্রম আছে। এই আনন্দ উৎসবই কারো কারো কাছে শোক উৎসব হিসেবে পালিত যুগ যুগ ধরে। তারা এক বিশেষ সম্প্রদায়। 'অসুর দম্প্রদায়'। তাদের কথা বলতেই  প্রতিবেদনের এই অংশটুকুর অবতারণা। 

কারা অসুর সম্প্রদায়? অনেকেই জানেন না 'অসুর' নামে একটা জনজাতি আছে আমাদের দেশে।  নৃতাত্ত্বিক গবেষণায়  উঠে এসেছে তাদের নানা কথা। তাদের বিশ্বাস মহিষাসুর তাদের পূর্বপুরুষ। সমীক্ষায় জানা গেছে অস্ট্রিক গোষ্ঠীর এই অনার্য জনজাতি হিন্দু ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়েও দুর্গাপূজার সম্পূর্ণ বিরোধী। আনন্দ তো দূরের কথা তারা দুর্গাপূজার মণ্ডপ বা প্রতিমা কিছুই দর্শন করে না। উল্টে মুখে কালো কাপড় বেঁধে শোক পালন করেন। এমন কি ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের  মণ্ডপে যেতে বারণ করে থাকে। পুজোর দিনগুলো তারা শোক পালন করে। অশৌচ পালনের মতো করে। দেবী দুর্গা তাদের পূর্বপুরুষ মহিষাসুরকে বধ করেছেন বলে তারা বিশ্বাস করে বলেই তাদের কাছে দুর্গাপূজা এমন শোক- উৎসব। এই অসুর জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই মধ্য প্রদেশ, বিহার, চা বাগান অধ্যুষিত বাংলায় বাস করে।  উত্তরবঙ্গের  গবেষক জ্যোতির্ময় রায়ের একটি নৃতাত্ত্বিক সমীক্ষা থেকে জানতে পারি ১৯৯১ এর জনগণনা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের অসুরগোষ্ঠীর প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ বসবাস করে। অধিকাংশই জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং ও কোচবিহার জেলায় তাদের বাস।  নাগরাকাটা ব্লকেই  প্রায় পাঁচশো অসুর পরিবার আছে। দীর্ঘকাল এখানে বসবাসের কারণে আজকাল অনেকের সংস্কৃতি বদলে গেছে বলে মনে করা হয়। অনেকে হিন্দু ধর্ম ছেড়ে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছে। কেউ কেউ খ্রিস্ট ধর্ম এমনকি খুব সামান্য কিছু জন ইসলাম ধর্মও করেছে। এই অসুর জনগোষ্ঠীর মানুষের আদিবাসীদের মতোই  গাছপালা, জীবজন্তু, জলচর নানা প্রাণী অনুযায়ী গোত্র নির্ধারিত হয়ে থাকে। যেমন কাছুয়া, টিরকি, নাগ, কেরকেটা, শিয়ার (শিয়াল), বারোয়া( বনবিড়াল), বাসবিয়ার (বেল) প্রভৃতি। অবশ্য বিয়ের ক্ষেত্রেই  এই গোত্রের প্রয়োজন হয়। তাদের ভাষা 'আসুরী' আজ অবলুপ্তির পথে। জীবিকার প্রয়োজনে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে তাদের শোকের উৎসবটি আগের মতো কঠোর থাকছে না। তবে আজও তারা দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে শোকের নিয়ম অনেকটাই পালন করে। সভ্য সমাজের কাছে তারা যে প্রশ্ন তুলেছে তাও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। 

তারা বলেন অস্ত্র হাতে নিধন এবং তাকে নিয়ে উৎসব আধুনিক ভারতের সংস্কৃতিতে মানায় না। যে দেশ  শান্তির  কথা বলে  সে দেশে নিধন নিয়ে শো কেন ?
তাদের আরও অভিমত  অসুর নাম করে অশুভ শক্তি বিনাশের  কথা বলে এইব বধ -এর চিত্র কেন? আর নিরীহ প্রাণী মহিষ বা নিরীহ মানুষই কী দুষ্ট? ভাল পোশাক পরা সভ্য মানুষের অত্যাচার ই বা দেখানো হবে না কেন ? দুর্গা সহ দেবতা গণ ও মহিষাসুর বধের লড়াই-এ কালো ফর্সা বর্ণবিদ্বেষ- ছায়াও কি নেই? অসুর জনজাতি মানুষজন প্রকৃতিপূজো ও পশু পূজায় বিশ্বাস করে। স্বভাববিক ভাবেই এ চিত্র তাদের কাছে কষ্টের। অসুর জনজাতির পূর্ব পুরুষ নারীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতেন না বলেও তারা ব্যাখ্যা করে থাকে। আজকের বিজয় উৎসবে এই ভাবনা ভেবে দেখার মতই। সব কিছু বদলায় - এই চিত্র কী বদলাবে না ?

দুই। পতিতা ঘরের মাটি::
       নারীর সম্মান না অসম্মান

দুর্গা পুজোর আচারে উপকরণ হিসেবে এক অদ্ভুত নিয়ম চলে আসছে।  প্রায় সবপুজোর মতো দুর্গাপূজায় পত্র- পুষ্প, ফল শস্য দানা লাগে, অগুরু- চন্দন- ঘৃত- মধু-দুগ্ধ- হরীতকী এইসবও পূজার উপকরণ। কিন্তু দুর্গা পুজোয় অতিরিক্ত একটি দ্রব্য লাগে তা হলো নিষিদ্ধ পল্লীর মাটি। দেবী দুর্গার প্রতিমা নির্মাণ ও দুর্গার স্নানের সময় এই মাটি লাগে । কেন এই মাটি ব্যবহৃত হয় তা নিয়ে বহুকৌণিক ব্যখ্যা আছে। তার কিছুটা শাস্ত্রীয়, কিছুটা সমাজ বিন্যাসের নিয়ম অনুযায়ী, কিছুটা মনগড়া। 

শাস্ত্রে নয় কন্যার বাড়ির মাটি ব্যবহারের কথা বলা হযে থাকে তারা হলেন- ১ নর্তকী,  ২. কাপালিক, ৩.ধোপানী, .৪. নাপিতানি, ৫. ব্রাহ্মণী, ৬. শূদ্রাণী, ৭. গোয়ালিনী, ৮. মালিনী  ৯.পতিতা। সমাজে এই নয় রূপের নারীরই অত্যন্ত প্রয়োজন। তবে পতিতাকে একটু স্বতন্ত্র রূপেই ভাবা হয়। কোনো কোনো আলোচনায় আর প্রকারের নারীর কথা বলা হয়েছে। যাই হোক, পতিতা কেন- এ প্রশ্নের উত্তরে সামাজিক ভাবে যা বলা হয়ে তা জানা জরুরি, দুর্গা নারী শক্তির প্রতীক। পতিতাও নারিশক্তির প্রতিনিধিত্ব করে।কামার্ত পুরুষ পতিতার ঘরে ফেলে আসে তার পুণ্যের সবটুকু। সঙ্গে সে ফেলে আসে তার অহংকার ও পৌরুষ। এসব গ্রহণ করে পতিতাভূমি হয়ে ওঠে পবিত্রভূমি। পতিতা সব বিষ ধারণ করে হয়ে মাহিমাময়ী নীলকণ্ঠ নারী। বাইরের চোখে তাকে যতই অচ্ছুত বলা বলা হয় না কেন, আসলে তারা পবিত্র মাতৃশক্তি। প্রকৃত সভ্যতা তাকে সমীহ করে। তার ঘরের মাটি দুর্গাপূজায় ব্যবহার করে আসলে সভ্যসমাজে তাকে বড়ো মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। বিষয়টিতে নারীশক্তি তথা মাতৃ শক্তিকে দশভুজা দুর্গার সাথে সংযোজিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

দশ মহাবিদ্যায় আছে  “অভিষিক্তা ভবেৎ বেশ্যা ন বেশ্যা কুলটা প্রিয়ে।” যারা দশ মহাবিদ্যার উপাসক এটি তাঁদের মন্ত্র। বেশ্যা বা পতিতা নারী স্বাভাবিক অর্থেই দশমহাবিদ্যা আয়ত্ব করে সিদ্ধ নারী। এ ভাবেই পতিতা নারী সম্মানিত হয়েছে আকালবোধনের আয়োজনে।

প্রগতিবাদী নারীদের একাংশ এই সব শাস্ত্রীয় বা নিয়মসম্মত ব্যাখ্যা মানতে নারাজ। তাদের মতে, এটি আসলে পুরুষতান্ত্রিকতার আর এক কৌশল। ভোগের জন্য ব্যবহার করে মেয়েদের পুণ্যলাভের লোভ দেখানো পুরুষের মর্জি। দুর্গাপূজায় পতিতা দ্বারের মাটি ব্যবহার করার তাগিদ  আসলে এই আদিম  প্রথাকে রেখে দেওয়ার কৌশলী প্রয়াস।


তিন।  সিঁদুর খেলার আনন্দ:
          নারী প্রগতির পিছুটান নয়তো?

বিজয়া-দশমীতে অর্থাৎ  দুর্গাপুজোর শেষ লগ্নে সিঁদুরখেলার চল আজকাল খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এই উৎসব অনেক বেশি আনন্দের অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছে। পুজো শেষে সব ছাপিয়ে সিঁদুর খেলার ছবি । এ যেন অকাল বোধনের শেষে অকাল হোলি উৎসব । লাল পেড়ে শাড়ি বা বাসন্তী লাল শাড়ি পরিহিতা সধবা মেয়েদের উচ্ছ্বাস দেখে আনন্দ হয় বৈকি। সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়াল ভরে ওঠে খেলার আবহের হরেক চিত্রে। এসব ঠিকই আছে। কিন্তু কিছু প্রশ্নও জাগে এই এয়ো-নারীদের সিঁদুর খেলা বিষয়ে। 

সিঁদুর নিয়ে এই খেলার এত জনপ্রিয়তা কেন ? এর ব্যাখ্যা কী শুধুই শাস্ত্রীয়? দেবতা বিদায়ের আগে তাকে বরণ করা আর ঘরের মেয়ে রূপে তাকে সাজানো একটা রেওয়াজ বাঙালি সংস্কৃতিতে, আর ঘরের মেয়ের বিদায় লগ্নে নিজেদের আলতা সিঁদুর  যোগে সাজ -ছিলই । কিন্তু খেলার এমন চল কী তেমন ছিল? প্রাচীন বাংলায়? ছোটো বেলায় মা ঠাকুমাদের কাছে শুনেছিলাম সিঁদুর খুব পবিত্র তা নাকি পায়ে লাগাতে নেই। কোনারক সহ বহু মন্দির  গাত্রে আয়না হাতে সিঁদুর পরার যে রূপসীর চিত্র আছে তার ভঙ্গি বিশেষ। নাম 'দর্পণসুন্দরী'। এমনভাবে হেলে সিঁদুর পরছেন যে কোনো ভাবেই সিঁদুর যেন গায়ে বা পায়ে না পড়ে। এসব প্রাচীন প্রথা। প্রাচীন সংস্কার।.থাক সে সব কথা। সময়ের সাথে সাথে সব বদলে যাওয়া কালের নিয়ম। 
কিন্তু অবাক লাগে আর একটা বিষয় - খুব সঙ্গত কারণে আজকাল বিবাহিত নারীরা প্রশ্ন তোলেন -সিঁদুর পরাকে আসলে মার্কার হিসেবে ব্যবহার। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের দাসত্বের স্মারক শাঁখা ও সিঁদুর। 
দীর্ঘকাল ধরে নারীদের অধিকারে রাখার কারণেই সিঁদুর। এ ব্যাপারে পুরুষের বিরুদ্ধে জেহাদও অনেকে ঘোষণা করেন দিন রাত। খুব স্বাভাবিক কারণও তাই হয়তো। কিন্তু তাদেরই একটা বড় অংশ সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠে। আনন্দের জন্য। প্রশ্ন করলে যুক্তিও প্রস্তুত  'একে সিঁদুর হিসেবে ধরছেন কেন? এতো উৎসব? আবির খেলা ধরুন' তাহলে কী বিধবা নারী বা আবাল বৃদ্ধ বনিতা ও সিঁদুর খেলায় অংশ নেবে ? তাই যদি হয় তাহলে সিঁদুর নারীর জন্য মার্কার এই প্রশ্ন আর আসবে না হয়তো। প্রগতিশীল নারী  বাঙালির সংস্কৃতি বলে ভাবের ঘরে চুরি করছেন নাতো? নাকি অকাল বোধনের মতই অকাল হোলি ? যেখানে সবার অধিকার। 
সিঁদুর খেলা নারী প্রগতির পরিপন্থী নয়তো?

Post a Comment

1 Comments

  1. প্রচন্ড এক কৌতুহল নিয়ে পড়া শুরু করেছিলাম , কিন্তু ঠিক যেন শেষ হয়েও হলো না । আর একটু ডিটেলে লিখলে মন ভরে যেতো।
    নিষিদ্ধপল্লি কথা টা যেন কেমন কানে লাগলো , এই ডিজিটাল যুগেও ঐ বিশেষ সেবিকাদের কেন নিষিদ্ধ পল্লি র বাসিন্দা বলা হচ্ছে বুঝলাম না ।
    নিষিদ্ধ পল্লি দিয়ে মায়ের মূর্ত গড়া শুরু আর সিন্দুর পরা বধূর বরন দিয়ে মায়ের গমনের পর্ব শেষ -- মনে হচ্ছে না কি
    কোথাও যেন সব নারী দের একই সম্মান মায়ের কাছে ,
    আর সিন্দুর খেলা একটা হুজুগ, এই ৫/৭ বছর এর দূরন্ত অগ্রগতি এসেছে ছবি পোষ্ট করার জন্য বা নিজেকে কতো সুন্দর লাগছে অথবা আমি কতোটা স্বামী সোহাগী দেখানের জন্য । এখন অন্তরের থেকে বাইরের আবরণ টাই বেশি লক্ষনীয় হয়ে গেছে ।
    সেই কারণেই সিন্দুর নিয়ে এই নাচন কিছু দিনের তারপর এই হুজুগ কমে যাবে আস্তে আস্তে।
    যাই হোক লেখাটা সুন্দর হয়েছে , লেখক কে অসংখ্য ধন্যবাদ ।আরো এমন ধরনের তথ্যবহুল লেখা পাওয়ার অপেক্ষায় থাকবো ।

    ReplyDelete