জ্বলদর্চি

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত -২০/ সুদর্শন নন্দী


    অলংকরণ - রবীন্দ্রনাথ কপাট 


পর্ব-২০

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত  

সু দ র্শ ন  ন ন্দী

১৮৮৫, ১৫ই জুলাই। ঠাকুর বলরাম বসুর বাড়িতে রয়েছেন। আগের দিন রথযাত্রা গেছে।ভক্তদের আনাগোনা চলছে। ভোরবেলা উঠে জগন্নাথের উদেশ্যে ব্যাকুল ভাবে বলছেন জগন্নাথ, দীনবন্ধু, জগবন্ধু। আমি তো জগৎ ছাড়া নাই নাথ। আমায় দয়া কর। তারপর প্রেমোন্মত্ত হয়ে গাইছেন -- “উড়িষ্যা জগন্নাথ ভজ বিরাজ জী!”(কবীরের রচনা)
এবার নারায়ণের নামকীর্তন করতে করতে নাচছেন ও গাইছেন 
- শ্রীমন্নারায়ণ! শ্রীমন্নারায়ণ! নারায়ণ! নারায়ণ!
নাচতে নাচতে আবার গান গাইলেন:
হলাম যার জন্য পাগল, তারে কই পেলাম সই।...
(পূর্বে গেয়েছেন এবং বর্ণনা করা হয়েছে গানটির বিষয়ে)
এছাড়াও ঠাকুর আর কিছু গান গেয়েছিলেন যা একাধিকবার হওয়ায় পূর্বে  বর্ণনা করা হয়েছে। প্রসঙ্গত বলি, এদিন পূর্ণজ্ঞান ও পূর্ণভক্তি এসব বিশয়ে আলোচনার সময় রামপ্রসাদের “তাঁর পর আমি ভাল কি তুমি ভাল, তা তুমিই জানবে”। গানটির উল্লেখ করেছিলেন।  

পরের গানের কথা বলব যা কয়েকজন ছেলে গেয়েছে। ২৮শে জুলাই ১৮৮৫ রাত সাড়ে আটটা নাগাদ ঠাকুর বাগবাজারে গণুর মায়ের বাড়ি গেছেন। সেখানে একটি কনসার্ট রয়েছে ।  কনসার্টের ছেলেরা সেদিন ঠাকুরকে “কেশব কুরু করুনা দিনে” এবং “এস মা জীবন উমা “ গান দুটি গেয়ে শোনালে ঠাকুর খুব খুশি হন। বলেন আহা, কি গান! কেমন বেহালা!কেমন বাজনা!  

এবার আসব ১৮৮৫, ২৩শে অক্টোবরের কথায়। ঠাকুর শ্যামপুকুরের বাড়িতে। ডাক্তার সরকার, লাটু, শশী, শরৎ, ছোট নরেন, পলতু, ভূপতি, গিরিশ রয়েছেন। সঙ্গে থিয়েটারের রামতারণ। তিনি গান গাইবেন।
 ঠাকুর বলছেন -আমার তখন খুব ব্যামো। কালীঘরে বসে আছি, -- মার কাছে প্রার্থনা করতে ইচ্ছা হল! কিন্তু ঠিক আপনি বলতে পাল্লাম না। বললুম, -- মা হৃদে বলে তোমার কাছে ব্যামোর কথা বলতে। আর বেশি বলতে পাল্লাম না -- বলতে বলতে অমনি দপ্‌ করে মনে এলো সুসাইট্‌ (Asiatic Society's Museum) সেখানকার তারে বাঁধা মানুষের হাড়ের দেহ (Skeleton) অমনি বললুম, মা, তোমার নামগুণ করে বেড়াব -- দেহটা একটু তার দিয়ে এঁটে দাও, সেখানকার মতো! সিদ্ধাই চাইবার জো নাই! এসব কথা শেষ হলে রামতারণ স্যন্যাল গান শুরু করলেন:
আমার এই সাধের বীণে, যত্নে গাঁথা তারের হার ৷
যে যত্ন জানে, বাজায় বীণে, উঠে সুধা অনিবার ৷৷
তানে মানে বাঁধলে ডুরী, শত ধারে বয় মাধুরী ৷ 

(এই গানটি গিরিশ চন্দ্র ঘোষের বুদ্ধদেব চরিত নাটক অবলম্বনে রচিত। এই গানটি ৬ই নভেম্বর ১৮৮৫ গিরিশের ও কালীপদের কণ্ঠেও গাইতে দেখি)
গান শুনে ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন (গিরিশের প্রতি) -গান এ-সব কি অরিজিন্যাল (নূতন)?
গিরিশ -না, Edwin Arnold-এর thought (আর্নল্ড সাহেবের ভাব লয়ে গান)।
রামতারণ বুদ্ধচরিত নাটক থেকে গান গাইলেন:
জুড়াইতে চাই, কোথায় জুড়াই,
কোথা হতে আসি, কোথা ভেসে যা...
 
এই গান শুনতে শুনতে ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হয়ে গেলেন।
গানটি গিরিশচন্দ্র ঘোষের লেখা। এই গানটি আরও দুবার ঠাকুরকে শুনিয়েছিলেন গিরিশ ও কালীপদ (৬ই নভেম্বর ১৮৮৫, শ্যাম পুকুরের বাড়িতে) এবং দুটি ছোট মেয়ে (১৩ই এপ্রিল ১৮৮৬, কাশীপুর উদ্যান বাটিতে)। 
গানটি শেষ হলে ঠাকুর বললেন, “এ কি করলে! পায়েসের পর নিম ঝোল! --
আরও বললেন, “যাই গাইলে -- ‘কর তম নাশ’, অমনি দেখলাম সূর্য -- উদয় হবা মাত্র চারদিকের অন্ধকার ঘুচে গেল! আর সেই সূর্যের পায়ে সব শরণাগত হয়ে পড়ছে!”
রামতারণ আবার গাইছেন:
(১)  দীনতারিণী দূরিতবারিণী, সত্ত্বরজঃতমঃ ত্রিগুণধারিণী,
            সৃজন পালন নিধনকারিণী, সগুণা নির্গুণা সর্বস্বরূপিণী।
(রচয়িতা মহারাজ শ্রীশচন্দ্র। গানটি গিরিশ আরেকবার শ্যামপুকুরের বাড়িতে শুনিয়েছিলেন ৬ই নভেম্বর, ১৮৮৫)  

(২)  ধরম করম সকলি গেল, শ্যামাপূজা বুঝি হল না!
             মন নিবারিত নারি কোন মতে, ছি, ছি, কি জ্বালা বল না ৷৷
(গানটি শুনে ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হয়ে গেলেন। রচয়িতা গিরিশ চন্দ্র ঘোষ)
   (৩) রাঙা জবা কে দিলে তোর পায়ে মুঠো মুঠো।
(এই গানটিও শুনে ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হয়ে গেলেন। রচয়িতা গিরিশ চন্দ্র ঘোষ)
আসব ১৮৮৫, ২৪শে অক্টোবর শ্যামপুকুরের বাড়িতে। নরেন্দ্র, মহিমাচরন, ডাক্তার, মাস্টার ঠাকুরের ঘরে বসে আছেন। বেলা প্রায় একটা। বিভিন্ন প্রসঙ্গ আলোচনা চলতে চলতে  ঠাকুর নরেন্দ্রকে গান গাইতে বললেন।
নরেন্দ্রের ছটি গান গেয়েছিলেন সেদিন।  গান:
(১) তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা।
(২)  অহংকারে মত্ত সদা, অপার বাসনা।( রচয়িতা ভৈরব চন্দ্র দত্ত)
(৩)   চমৎকার অপার, জগৎ রচনা তোমার!
              শোভার আগার বিশ্ব সংসার!
(৪)   মহা সিংহাসনে বসি শুনেছি হে বিশ্বপতিঃ
              তোমারি রচিত ছন্দ মহান বিশ্বের গীত...
                ( কবিগুরুর রচনা) 
(৫)   ওহে রাজরাজেশ্বর, দেখা দাও!
(৬)   হরি-রস-মদিরা পিয়ে মম মানস মাতোরে!
              লুটায়ে অবনীতলে হরি হরি বলি কাঁদোরে ৷৷
দ্বিতীয় ও চতুর্থ গান বাদে সব গানগুলি এর পূর্বে উল্লেখিত। 
পরের দিন, ১৮৮৫, ২৫শে অক্টোবর। শ্যাম পুকুরের বাড়িতে বিজয় গোস্বামী ঠাকুরকে দেখতে   সঙ্গে কয়েকজন ব্রাহ্মভক্ত। বিজয়কৃষ্ণ ঢাকায় অনেক দিণ ছিলেন। আপাততঃ পশ্চিমে অনেক তীর্থ ভ্রমণের পর সবে কলকাতায় পৌঁছেছেন। এসে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলেন। অনেকে উপস্থিত -- নরেন্দ্র, মহিমা চক্রবর্তী, নবগোপাল, ভূপতি, লাটু, মাস্টার, ছোট নরেন্দ্র ইত্যাদি সব ভক্ত।
মহিমা চক্রবর্তী (বিজয়ের প্রতি) বললেন -- মহাশয়, তীর্থ করে এলেন, অনেক দেশ দেখে এলেন, এখন কি দেখলেন বলুন।
বিজয় -- কি বলব! দেখছি, যেখানে এখন বসে আছি, এইখানেই সব। কেবল মিছে ঘোরা! কোন কোন জায়গায় এঁরই এক আনা কি দুই আনা, কোথাও চারি আনা, এই পর্যন্ত। এইখানেই পূর্ণ ষোল আনা দেখছি!
বিজয় ঠাকুরের প্রতি বললেন, বুঝেছি আপনি কে?
ঠাকুর ভাবস্থ হয়ে বললেন, যদি তা হয়ে থাকে তো তাই।  
এবার মহিমাচরণ সাশ্রুনয়নে গাইতে শুরু করলেনঃ 
“দেখ দেখ প্রেমমূর্তি...”  
   ( গানটির রচয়িতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর)
এদিন ভূপতি আরেকটি এবং নরেন্দ্রও গান গেয়েছিলেন। সেই গান দুটি আগেও গাওয়া হয়েছে বলে পূর্বে উল্লেখ করেছি। 
 ১৮৮৫, ২৭শে অক্টোবর। শ্যামপুকুরের বাড়িতে ঠাকুর। বেলা সাড়ে পাঁচটা।নরেন্দ্র, ডাক্তার সরকার, শ্যাম বসু, গিরিশ, ডাক্তার দোকড়ি, ছোট নরেন্দ্র, রাখাল, মাস্টার ইত্যাদি অনেকে উপস্থিত। ডাক্তার এসে ঠাকুরের হাত দেখলেন ও ওষুধের ব্যবস্থা করলেন। ওষুধ খাবার  পর ডাক্তার বললেন, ‘তবে শ্যামবাবুর সঙ্গে তুমি কথা কও, আমি আসি।’
শ্রীরামকৃষ্ণ ও একজন ভক্ত বলএ উঠলেন, ‘গান শুনবেন?”
নরেন্দ্র গান শুরু করলেন। অনেকগুলি গান তিনি গেয়েছিলেন যা পূর্বে গাওয়ায় উল্লেখ করা আছে। নীচের দুটি গান এই প্রথম কথামৃতে উল্লেখ পাই।প্রথমটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এবং দ্বিতীয়টি পুণ্ডরীকাক্ষ মুখপাধ্যায়ায়ের।  

১) এ কি এ সুন্দর শোভা, কি মুখ হেরি এ!
আজি মোর ঘরে আইল হৃদয়নাথ, প্রেম উৎস উথলিল আজি --

২) কি সুখ জীবনে মম ওহে নাথ দয়াময় হে
যদি চরণ-সরোজে পরাণ-মধুপ চিরমগন না রয় হে।
 
“সতির পবিত্র প্রেম” গানের অংশ শুনতে শুনতে ডাক্তার অশ্রুপূর্ণলোচনে বলে উঠলেন, আহা! আহা! ঠাকুরও মাঝে মাঝে ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়ছেন।
চারদিন পর। ১৮৮৫, ৩১শে অক্টোবর। শ্যামপুকুরের বাড়িতে।ডাক্তার সরকার এসেছেন। ডাক্তারকে দেখে ঠাকুর সমাধিস্থ। কিঞ্চিৎ ভাব উপশমের পর ঠাকুর ভাবাবেশে বললেন -- “কারণানন্দের পর সচ্চিদানন্দ। -- কারণের কারণ!” 
খানিকপর ঠাকুর গান ধরলেনঃ
সুরাপান করি না আমি, সুধা খাই জয়কালী বলে...(পূর্বে উল্লেখিত)  
কথায় কথায় ডাক্তারকে ঠাকুর বললেন, “তাঁরই কোলে বসে আছি, তাঁকে ব্যারামের কথা বলব না তো কাকে বলব। ডাকতে হয় তাঁকেই ডাকব!”
এই কথা বলতে বলতে ঠাকুরের চোখ জলে ভরে গেল। আবার ভাবাবিষ্ট হলেন।-ভাবে ডাক্তারকে বলছেন -- “তুমি খুব শুদ্ধ! তা না হলে পা রাখতে পারি না!” আবার বলছেন। 
“শান্ত ওহি হ্যায় যো রাম-রস চাখে!
“বিষয় কি? -- ওতে আছে কি? -- টাকা-কড়ি, মান, শরীরের সুখ -- এতে আছে, কি? 
রামকো যো চিনা নাই 
দিল্‌ চিনা হ্যায় সো কেয়া রে।”
(রামচন্দ্র বিষয়ক এই ভজন ঠাকুর বাৎসল্য ভাব সাধনের সময় রামায়ত সাধুদের কাছে শিখেছিলেন।)  
এত অসুখের পর ঠাকুরের ভাবাবেশ হচ্ছে দেখে ভক্তেরা চিন্তিত। ঠাকুর বলছেন, “ওই গানটি হলে আমি থামব; -- হরিরস মদিরা।”
এরপর নরেন্দ্র উপরোক্ত গানটি সহ আরও গান গাইলেন। গানগুলি পূর্বে গাওয়ায় পুনরুল্লেখ করা হল না।
---------------------------------------------------------
আরও  পড়ুন 

১৮৮৫, ১১ই মার্চ। শ্রীরামকৃষ্ণ বলরাম বসুর বৈঠকখানায় বসে আছেন। ভক্তরা সব তাকিয়ে রয়েছেন তিনি কি বলবেন। ঠাকুর এমন সময় গান শোনার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। 


Post a Comment

0 Comments