জ্বলদর্চি

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত -২২/ সুদর্শন নন্দী

পর্ব-২২

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত  

সুদর্শন নন্দী

এরপর ১৯শে জানুয়ারি ১৮৮৬। কাশীপুর বাগানবাড়িতে। মাস্টার খুব ভোরে এসেছেন । ঠাকুরের খুব কাসি হচ্ছে। নরেন্দ্র, নিরঞ্জন বুড়োগোপাল রামাইত সন্ন্যাসীর বেশে দোতলার ঘরে। খানিক কথাবার্তার পর নরেন্দ্র ঠাকুরকে বললেন একটা গান শুনুন। 
এই বলে কবীরের একটি লেখা শুরু করলেনঃ
প্রভু ম্যয় গোলাম, ম্যয় গোলাম, ম্যয় গোলাম, তেরা।
তু দেওয়ান, তু দেওয়ান, তু দেওয়ান, মেরা...
ঠাকুরের চোখ দিয়ে তখন আনন্দাশ্রু ধরে না।      
পরের গানের উল্লেখ পাই ২১শে জানুয়ারি ১৮৮৬, কাশীপুর বাগানবাড়িতে। উপস্থিত রয়েছেন মাস্টার, নরেন্দ্র,বাবুরাম, শশী, ভবনাথ, কালীপদ প্রভৃতি ভক্তেরা। কথাবারতা চলছে। ঠাকুরের শরীর একটু ভাল। কথায় কথায় নরেন্দ্র ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলেন , আপনি কবার তারকেশ্বর গিয়েছেন? ঠাকুর ইঙ্গিতে বললেন তিনবার। সে অনেকদিন হল। কালীপদ হাসি মস্করা শুরু করলে ঠাকুরও হাসছেন। এবার নরেন্দ্র পরপর দুটি গান শোনালেন।
১) 
প্রথম নাম ওকার,
ভুবন-রাজ দেব-দেব
জ্ঞানযোগে ভাব হে,
তিনি তোমার সঙ্গে।...
২)
যে শুনেছে বাঁশির গান...
আরেকটি গান উল্লেখ পাই ১৮ই এপ্রিল ১৮৮৬ কাশীপুর বাগানবাড়িতে। শ্রীরামকৃষ্ণ বিছানার উপর বসে আছেন। দুর্বল শরীর। ঐ অবস্থায় ফুলচন্দন নিয়ে তিনি নিজেকে পুজো করছেন। সুরেন্দ্রনাথ, বাবুরাম, লাটু। মাস্টার সবাই উপস্থিত। পশ্চিমদিকের পুকুরঘাটে কিছু ভক্ত খোল করতাল নিয়ে কীর্তন করছেন। ঠাকুর বাবুরাম আর মাস্টারমশায়কে পাঠিয়ে দিলেন কীর্তনদলে যোগ দিতে। কীর্তন শেষ হলে সুরেন্দ্র ভাবাবিষ্ট হয়ে গাইছেন-জিহবা যন্ত্রে... 
(গানের এটুকুই উল্লেখ রয়েছে)। 
  কথামৃত ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় ঠাকুরের গাওয়া বা ঠাকুরকে শোনানো গানের উল্লেখ পাই বিভিন্ন গ্রন্থে। গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-শ্রীম-দর্শন(স্বামী নিত্যাত্মানন্দ),শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ (স্বামী সারদানন্দ), শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা (স্বামী গম্ভীরানন্দ), শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথি (অক্ষয় কুমার সেন), শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ লীলামৃত (বৈকুণ্ঠনাথ স্যান্যাল), শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেবের উপদেশ (সুরেশ চন্দ্র দত্ত), আমার জীবন কথা ( স্বামী অভেদানন্দ) প্রভৃতি গ্রন্থে।
যেহেতু এই লেখা মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃতকে ভিত্তি করে তাই বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখিত কিছু গান উল্লেখ সম্ভব হল না। উৎসাহী পাঠক যারা আরও বিস্তৃতভাবে ঐ গানগুলি সম্ভন্ধে জানতে চান তারা স্বামী লোকেশ্বরানন্দের সম্পাদনায় “শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণের প্রিয় সঙ্গীত” (প্রকাশকঃ রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার, গোলপার্ক, কলকাতা) গ্রন্থটির সাহায্য  নিতে পারেন। 

ঠাকুরকে যারা গান শুনিয়েছেন অর্থাৎ যারা গান গেয়েছেন উল্লেখযোগ্য তাঁদের কয়েকজন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করলাম।
নরেন্দ্রঃ ঠাকুরকে গান শোনানোর ব্যাপারে কিছু বলতে গেলে প্রথমেই ঠাকুরের প্রিয় শিষ্য নরেনের কথা উল্লেখ করতে হয়। কিন্তু সেই নরেন তথা নরেন্দ্রনাথ ঠাকুর যিনি ভাবীকালে হাঁক দেবেন সেই স্বামী বিবেকানন্দের গলাটি ছিল মধুর। নিয়মিত গান গাইতেন তিনি। ঠাকুরের সাথে প্রথম দেখা সেই গান নিয়ে। আমরা সবাই জানি সুরেন্দ্রানাথ মিত্রের বাড়িতে ঠাকুর গান শুনতে চাইলে সুরেন্দ্রর পাড়ার নরেনকে ডাকেন। ঠাকুরের জীবদ্দশায়  অসংখ্য গান শুনিয়েছেন তিনি। তার গান নিয়ে বললে আলাদা গ্রন্থ হয়ে যাবে।   
রাজনারায়ণ -- শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকে চণ্ডীর গান শুনিয়ে তুষ্ট করবার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। তাঁর দুই পুত্রসহ তিনি গান করতেন।
রামতারণ -- গিরিশচন্দ্র ঘোষের থিয়েটারের অভিনেতা ও সুগায়ক। শ্যামপুকুরে অবস্থানকালে অসুস্থ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে গান শোনাবার জন্য গিরিশবাবু রামতারণকে নিয়ে আসেন। তাঁহর ভক্তিমূলক গান শুনে ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হন।
ত্রৈলোক্যনাথ সান্যাল (১৮৪০ - ১৯১৬) -- ব্রাহ্মভক্ত, কেশব সেনের অনুগামী। গীতিকার ও সুগায়ক। বলা যায় কেশব সেনের সংস্পর্শে এসে ত্রৈলোক্যের নবজন্ম ঘটে। ছেলেবেলা থেকেই তিনি গান গাইতেন। কেশবচন্দ্রের সঙ্গী হিসাবে তাঁর শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে আসার সুযোগ ঘটে। দক্ষিণেশ্বরে বহুবার তিনি যান এবং সেখানে মধুর সুললিত কণ্ঠে ঠাকুরকে গান শোনাবার  সৌভাগ্য তাঁর হয়েছিল। তাঁর রচিত সঙ্গীত ঠাকুরের অত্যন্ত প্রিয় ছিল এবং ঠাকুর স্বয়ং বিশেষ ভাবোদ্দীপক গানগুলি করতে অনুরোধ করতেন।  
 নরোত্তম -- কীর্তনীয়া। ঠাকুরের ভক্তেরা নিজেদের গৃহে উৎসবের ব্যবস্থা করলেই কীর্তনগানের জন্য নরোত্তমকে আমন্ত্রণ করতেন। ঠাকুর এই কীর্তনীয়াকে খুব স্নেহ করতেন।
বেনোয়ারী কীর্তনীয়া -- শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে আগত জনৈক কীর্তনীয়া। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে রথযাত্রার দিনে শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহীভক্ত বলরাম বসু তাঁর বাড়িতে বেনোয়ারীর কীর্তনের ব্যবস্থা করেছিলেন। ঠাকুর সেই আসরে উপস্থিত ছিলেন।
কালীপদ ঘোষ (১৮৪৯ - ১৯০৫) -- ‘দানা-কালী’ নামে শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘে পরিচিত । ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের বিশেষ কৃপাপ্রাপ্ত গৃহীশিষ্য। উত্তর কলিকাতার শ্যামপুকুরে প্রসিদ্ধ ঘোষ কোম্পানীতে চাকরী করতেন। প্রথম দর্শন ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে দক্ষিণেশ্বরে। ন্যাট্যাচার্য গিরিশ চন্দ্র ঘোষের সাথে তাঁর খুব হৃদ্যতা ছিল। ভক্তগণ এদের দুইজনকে একত্রে জগাই মাধাই বলতেন। তিনি বহু গান লিখেছিলেন যা “রামকৃষ্ণ সঙ্গীত” নামে প্রকাশিত হয়। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁকে ‘দানা’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। ভাগ্যবান কালীপদর জিহ্বায় ঠাকুর “কালী” নাম লিখে দেন এবং ঠাকুর তাকে বিশেষ কৃপাদান করেন। সুগায়ক, বেহালা ও বংশীবাদক কালীপদর বাঁশী শুনিয়া একদা ঠাকুর সমাধিস্থ হতেন।  
শ্যাম দাস -- প্রখ্যাত কীর্তনিয়া। ঠাকুরের গৃহীভক্ত রামচন্দ্র দত্ত তাঁর নিকট কীর্তন শিখতেন। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ৭ই সেপ্টেম্বর একদিন দক্ষিণেশ্বরে শ্যাম দাসের “মাথুর” কীর্তন শুনে ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হয়েছিলেন।
পান্না কীর্তনী (পান্নাময়ী) -- বিখ্যাত মহিলা কীর্তনীয়া। পদাবলী কীর্তনে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে দক্ষিণেশ্বরে কীর্তন উপলক্ষে ঠাকুরের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। ঠাকুর তাঁর ভক্ত ঈশানচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে পান্নার সুকণ্ঠের প্রশংসা করেন এবং তাঁর ভক্তির কথা উল্লেখ করেন।
---------------
আরও পড়ুন। 

Post a Comment

0 Comments