জ্বলদর্চি

সুবোধ সরকারের কবিতার মুহূর্তই তাঁর এক একটা জন্মদিন/ সায়ন


সেমিকোলনের আত্মজীবনী-১৩ 

সুবোধ সরকারের কবিতার মুহূর্তই তাঁর এক একটা জন্মদিন

 সায়ন

সমস্ত বিষণ্ণ পথকে একপাশে রেখে, সমস্ত হিংসার বুলেট-পথ আটকে যে মানুষ তাঁর জীবন-পথের ছবি নিজের ভাষায় লেখেন - তাঁর নাম সুবোধ সরকার।

জীবনের ইতিহাস তাঁর লেখা আছে কবিতায়। কবিতা এক অমোঘ অস্ত্রের মতো হাতে আসে রেল স্টেশনের উল্টো দিক থেকে হাসিমুখে পাউরুটি খেতে থাকা এক সাবঅলটার্নের কাছে। আমি এই মুহূর্তটাকে সুবোধ সরকারের জন্মদিন বলি। 

কবিতা বলে আসলে আমরা যা তৈরি করার চেষ্টা করি, কবিতা আসলে হাসে নিয়তির মুচকি হাসি নিয়ে বলে - " যেন যেন যেন যেন তুমি টিকটিকি/ যেন যেন যেন যেন আমি আরশোলা/ হাজার বছর ধরে দরজার পেছনে/ তোলা দিয়ে বেঁচে আছি চারদিক খোলা।" (সনেট ১৫৬)

কবিতা তাঁর কাছে হাইটেশন তার আর উড়ে বসা কাকের বিশ্রামের ইচ্ছার মাঝখানে বিপজ্জনক একটা ফাঁক। এই গ্যপটুকুর মাঝে লেখা আছে খন্ড বিখণ্ড কবিতার ভাবনা। এই বিপন্ন অন্ধকারে একটা লণ্ঠন জ্বেলে বসে দেখা একজন কবিতা প্রদেশ, দেশ ও বিশ্বের মানুষের উঠোন - মানুষ মানুষকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়েনি/একটা নগরকে ন'বার ধ্বংস করেছিল মানুষ/ সেই নগরের নাম ট্রয়। / আর যাকে নিরানব্বই বার ধ্বংস করে/ অপেক্ষা করে আছে মানুষ/ তার নাম সভ্যতা।" (আ বে চোপ, আমি পঁচিশে বৈশাখ বলছি) 
সভ্যতা কাকে বলে তার নমুনা একটা প্যন্ডেমিক আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে। মানুষের ভিতর লুকিয়ে থাকা আদিম প্যন্ডেমিকের পচা দেহটা থেকে দুর্গন্ধ ছেযে় যার বিস্ময় ইতিহাসের ইঙ্গিত অনেক আগেই ছিল কবির খাতায়। 

" কিন্তু লক্ষণ আমি তাকে বলতে পেরেছিলাম/ শম্বুককে মেরোনা/ কালো হলেই একটা লোককে মারা যায় না/ কালো বলে একটা দেশ পুড়িয়ে দেওয়া যায় না" 
কবিতায় নিজের কথা বলা মানে আমার কথা নয়, 'আমাদের' কথা বলতে পারা। তাই কবিতা একটা গণতন্ত্র, কবিতা ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার আগে পাউরুটি ঘুগনি খেতে খেতে ভবিষ্যতে একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়ার বিশ্বাস অর্জন। আমি সুবোধ সরকারের লেখা কিনে পড়ি, খুঁজে পড়ি, মোমের আলোর কাছে গিয়ে পড়ি, বিদুৎ ঝলসে ওঠার মুহূর্তে পড়ে ফেলি বার বার। কারণ কবি আমার আমার কাছে একটা অন্য শহর কিংবা নগর উপহার দেন - সেই নগরের নাম "ভাষানগর"। এখানে প্লেটো থেকে পাওলি দাম পর্যন্ত সবটাই ক্ষমতা আর নীতির বিপরীতে একটা মুক্ত জীবনের পথ - "প্লেটোর কাছে প্লেটো হতে শিখলি না রে মন/ ও তুই দাম দিলি না, দাম দিলি না/ পকেট ভরে নিলি বাদাম/ ভাবসাগরে মিলিয়ে গেল প্রাণের পাওলি দাম।" (প্লেটো থেকে পাওলি দাম) 
আসলে কবির জীবনের পথ প্লেটো থেকে পাওলি দাম পর্যন্ত একটা গভীররেখা। এখানে ভারতীয়ত্ব একটা বিশ্ব নাগরিকত্বের মর্যাদার জন্য প্রশ্ন করতে পারে :

১.) "চিনের প্রাচীর কোন কাজে এল মানুষের?"
২.) " এরা এখন এক মুঠো তন্ডুল দিতে পারে না
        গরিব ছেলেমেয়েদের 
        এরা দেবে বিদ্যা?"
৩.) " ইন্ডিয়ান ক্যাপটেন হওয়ার পর 
        অনেকে বলেছিলেন, এ কী পারবে?"
৪.) " তোমাকে সঙ্গম করি যেভাবে বিদ্যুৎ ঢোকে          পাথরে চৌচির/ কীরাতের প্রেম ভাল নাকি           ভালো তির?"
৫.) " এই মুহূর্তে দেশ দাঁড়িয়ে আছে মেয়েদের                মাথার ইট এবং ম্যাডোনার                                   আন্ডারওযা়রের/মাঝখানে।"

এই পাঁচটা প্রশ্ন একটা নমুনামাত্র জনদরবারে রাখলাম। আসলে ইতিহাস কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বাধ্য হবে যেদিন, সমস্ত ছন্দ বর্ণ ভাষা দেশ এক হয়ে বিপন্ন মানুষের পাশে যে কবিতা আদালতকে প্রশ্ন করে তার গর্ভে জন্ম হয় একজন কবির প্রতিদিন। আজ ২৮শে অক্টোবর, ২০২০, শুধু সেই মায়ের পা'য়ে মাথা ছোঁয়াই, যিনি আমাদের মতো স্বল্পপুঁজির ভাষাজীবীদের জন্য এমন এক কবির জন্ম দিয়েছেন।
---------------------
আরও পড়ুন



Post a Comment

0 Comments