জ্বলদর্চি

ঘোড়াডিহির অন্তর্ধান রহস্য-১১/গৌতম বাড়ই

ঘোড়াডিহির অন্তর্ধান রহস্য

গৌ ত ম  বা ড় ই
পর্ব-১১


তমাল দত্তের ফোন ধরতেই বলতে শুরু করলো সে-গতকাল সালতামামি তার বাড়িতে এসেছিলো এবং নকশালবাড়ির রেলস্টেশনের ধারে তাকে দেখা গিয়েছিলো।খবরটা একদম সত্যি।পুলিশের বিশ্বস্ত সূত্রে এ খবর পাওয়া।তবে তোমরা কি একবার ওর গ্রামের বাড়ির ঠিকানাটা দিতে পারো?

আমি ফোনটা নিয়ে মেঘকে দেই।মেঘ পুরো ঠিকানা আর অবস্থান বলে দিলো।

তমাল বলল মেঘকে --ঠিক আছে বিকেল নাগাদ খবর পেয়ে যাবে।তবে আমরা তো আর ওকে গ্রেফতার করে ধরে রাখতে পারবো না।তোমাদের ইনফরমেশনটা দিয়ে দিতে পারি।কারণ পুলিশের খাতায় তো ও অপরাধী না।তোমরা বললে আটকে রাখতে পারি বড় জোর। মিসিং এর খোঁজ দিতে পারি।

মেঘ বলল-না তমাল ওসব করতে হবে না।ভীষণ একরোখা স্বাধীনচেতা মানুষ আমাদের মতন-ই।ওর ভাবের গভীরে চেতনায় আমরাও সহজে ঢুকতে পারিনা।তবে এটুকু বলতে পারো-আমাদের একটা খবর যেন দেয় এই ভালো আছি জাস্ট।আর কিছু নয়।

তমাল ও.কে. বলে ছেড়ে দেওয়ার পর সবটাই মেঘের কাছে থেকে শুনে নিলাম।

নকশালবাড়ি তে কেন?কি করছে?আমরা এইসব ভাবতে লাগলাম।ওর নিজের বাড়িতে তো বলতে গেলে এখন কেউ নেই।তবে?মেঘ বলল-তমাল যখন এত জোর দিয়ে বলেছে বিশ্বাস করতেই হয়।আমার দৃঢ় বিশ্বাসটা ভেঙ্গে গেল।দেখি এবার।সন্ধেতেই জানতে পারবো আশা করছি সব।তবে সালতামামি ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে যখন তাহলে ঠিকই আছে।এটুকু খবরে শান্তি পেলাম।

কাল ওর লেখা পড়তে গিয়ে কিছু কবিতাও পেলাম।চোখ আটকে গেল তাতে।বুল্লে শাহর কবিতার উল্লেখ-আমি হিন্দুও নই,মুসলমানও নই।----আমি ক্ষুধিতও নই,রাজাও নই।আমি হাসিও না,আমি কাঁদিও না।আমার বাড়ি নেই,আমি গৃহহারাও নই।আমি পাপীও না,আমি ধার্মিকও নই।

সিন্ধীতে সুফি কবিতার কিছু পেলাম-

না তিনি প্রেমিক ,না তিনি প্রেমাস্পদ
না তিনি স্রষ্টা,না তিনি সৃষ্ট
এক থেকে জন্ম নিয়েছে বহু
সমস্ত বহুল অন্তরালে এক

সালতার চরিত্রের ধারা বা আমাদের চরিত্রের ধারাই তো সুফী কবিদের বর্ণনায়।আমরা সালতার এই কবিতাগুলি নোট করে রাখা দেখেই পড়ে মনে মনে বেশ তৃপ্তি পেলাম।গভীর রাতে তার ভেতরে এই তৃপ্তটা ধরা দিতো।মেঘ জানতোই না।

আরে এখানে কি লিখেছে দেখ।মেঘ আঙুল দিয়ে দেখায় আমাকে।এ লেখা ইংরেজি মে-মাসের গোড়ায়। এখানেও কোন কবিতা।তাকে কদিন কবিতা ঘিরে ধরেছিল বুঝতে পারছি।লিখেছে-

কি চলছে চারদিকে।আমার তো সুফি কবি শাহ আবদুল লতিফকে মনে পড়ছে।

রাজশক্তির চেয়েও অনেক বড় আমি মনে করি
একটি সূচকে
সূচ ঢেকে দেয় মানুষের নগ্নতা ,নিজে থাকে নগ্ন।

একটা ব্যথা একটা বিষাদময়তা তার গৃহবন্দী জীবনে গ্রাস করছিলো।তবে মৃত্যু চেতনা তাকে ঘিরে ধরেনি।যেটা আমরা খুঁজছিলাম।পেলাম না কোথাও।মেঘের চাকরিটা প্রায় চলে যাবার পথে বা চলেই গিয়েছে বলা যায়।এসবও ভেবেছে।মেঘকে সামনে রেখে অন্যদের মিলিয়েছে।

ফোনে ফোনে সারাদিন কেটে যাচ্ছে আমাদের।মেঘের মা সোদপুর থেকে অনেকক্ষণ ওর সাথে কথা বললো।আমাদের মিডিয়া থেকে অনেকেই খোঁজ খবর নিলো আমার কাছ থেকে।বন্ধু বান্ধবদের ফোন এসেই যাচ্ছে।মেঘকে না পেয়ে আমাকে আর আমাকে না পেয়ে মেঘকে ফোনে ধরছে।এক-ই প্রশ্ন আর উত্তরে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। মেজবৌদি এরমধ্যে একবার ফোন করে সব খবর নিলো।পিকলু ফোনটি করে মেজ বৌদিকে ধরিয়ে দেয়।আমি মেঘকে বলি-শোন বেলা বাড়লে কোথাও থেকে খাবার নিয়ে আসতে হবে।এখন তো মাঝ দুপুরের পর আর খাবারের দোকান খোলা পাব না।আবার বিকেল থেকে রাত আটটা পর্যন্ত।ঘোড়াডিহি ঢুকবার মুখে মোড়ের মাথায় একটা দোকান খোলা থাকে দেখেছি কিন্তু মানুষজন কোথায়?খুলে রেখেই বা করবে কি?বাস গাড়ি সব চলতে শুরু করলে না হয় আবার ধীরে ধীরে ভিড় বাড়বে।

মেঘ গম্ভীর থেকে বলল-বুদ্ধুরে কেসটা কি?তুই তো বলেছিলি -ডায়েরীর কোথাও সালতা লিখেছে যে এবারে উজানে পাড়ি দিতে হবে।

আমি বললাম আমরা যখন লিখি তখন মনের ভেতর থেকে উঠে আসা ঐ ক্ষণের কথা লিখি।অত সাতপাঁচ ভেবে কি লিখি?বল।তাই আমি কি লিখল কোন গুরুত্ব দিচ্ছি না।তবে তমালের ফোনটার জন্য অপেক্ষা কর।দেখ সালতা হয়ত এই লকডাউন জীবনটা মানতে না পেরে কোন শাল সেগুনের জঙ্গলে হাতির পিঠে ঘুমোচ্ছে!

আরে ইয়ার তুই খুব মস্তিতেই আছিস।আমার জায়গায় থাকলে এসব বলতি না।
 
আরে তোর আর আমার এবং সালতার জীবনের মধ্যে পার্থক্য মূল পার্থক্য কি?তুই সালতার সাথে থাকিস ২৪ ঘন্টা একই ছাদের তলায়।আমি থাকি না।আমি পুরুষ আর তুই মহিলা। কিন্তু তোরা বিবাহিত না।অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী না।আর তুই ওটা মানিস না।তাহলে---বহুত ইয়ারানা লাগতী হ্যায় ছমকছাল্লু!আমি শোলের গব্বর সিংয়ের ডায়লগ মেরে পরিবেশটা লঘু করবার চেষ্টা করি।দেখি মেঘ টেবিলে মাথা পেতে গভীর ভাবে কি ভাবছে।ঘুমিয়ে পড়ে নি তো!একে তো ঘুমিয়েছে কম তারপর হ্যাঙওভার থাকতেই পারে।আমি মেঘকে ডাকি-কি রে ঘুমিয়ে পড়লি?

ধুস্ ওতো এমনিতেই কদিন ধরেই নেই।তাও তুই আসাতেই একটু গভীর ভাবে ঘুমিয়েছি এই রাতে।

ঘরের ডোর বেল বেজে উঠলো।মেঘ উঠে দাঁড়িয়ে জামাকাপড় টানটান করে নিয়ে চোখে চশমাটা পড়ে ভেতর থেকে বললো-কে?

আমরা ম্যাডাম।

মেঘ স্বর নামিয়ে বললো-আপদ!তুই বোস আমি কথা বলে আসি।এবার স্বর চড়িয়ে বলল আসছি।

কান পেতে রইলাম।বেগরবাই দেখলে সামনে গিয়ে দাঁড়াবো।মেঘকে বলছেন ওনারা--ম্যাডাম ভাল আছেন তো?কিছু দরকার হলে বলবেন।আমাদের সবার ফোন নাম্বার দেওয়া আছে।আচ্ছা ঠিক আছে।ও আরো একটা জিনিস বলছি---

মেঘ থামিয়ে দিয়ে বললো-দেখুন আমার এই মুহূর্তে হয়ত আপনাদের দরকার নেই।তবে দরকার পড়লে নিশ্চয় জানাব।আমাদের অন্তরঙ্গ পারিবারিক বন্ধু আমার এখানেই আছে এবং থাকবেও বেশ কদিন।তাই আমার কিছুটা দুশ্চিন্তা কমেছে।

আপনারা এই সোসাইটির বেশ ভ্যালুএবল পার্সন আমরা বুঝেছি গতকাল থেকে প্রশাসন এমন কি পলিটিক্যাল নেতা সব আমাদের ফোন করে জানিয়েছে আপনার খোঁজ নিতে।এটাই বলবার ছিলো-সেই লোকেরা বললেন।

তা না হলে আপনারা কোন খোঁজ খবর নিতেন না।তাইতো?

না,না,ম্যাডাম তা কেন? তা কেন? করে সোসাইটির লোকজন বিড়ম্বনায় পড়ে।

তারপর মেঘ দরজা বন্ধ করে ভেতরে এসে বসেই বললো-শুনলি তো সব।যত্তোসব!খেজুরে আলাপ।

দুপুরে একটা ভাল খবর এবং কিছুটা খারাপ খবরও  পাওয়া গেল।মেঘরোদহাসিকে ওদের ব্যাঙ্ক থেকে রিজিওনাল ম্যানেজার  ফোন করে জানালেন যে একটা ই-মেইল পাঠানো হয়েছে তাকে ওটা আগে খুলে পড়তে।তারপর ফোনে কথা বলবেন।মেঘ ই-মেইল খুলে পড়ে জানলো তাদের ঐ ব্যাঙ্কের শাখায় কিছুদিনের মধ্যেই কাজ শুরু হবে এবং মেঘকেই ব্রাঞ্চ ম্যানেজার করে।তবে খারাপ খবরটি হল স্যালারী সত্তর শতাংশ পাবেন।পরে আগের অবস্থায় ব্যবসা ফিরে গেলে স্যালারীও ফিরে আসবে আগের মতন।ম্যানেজারকে ফোন করে হাঁ বলে দিলো আর বললো আমি ই-মেইলে রিপ্লাই রাতে দেবো।

দুপুরে তমালের একবার ফোন এলো।বললো বিকেলবেলায় সালতার খবর ঠিক তোমাদের দিয়ে দেবো।তোমরা কিছু খেয়েছো?বন্ধু আছে পাশেই। নো হেসিটেট।আমি ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই লোকদিয়ে তোমাদের দুজনের খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি তবে স্রেফ ডিমের ঝোল ভাত।

আমি বললাম-তমাল তুমি এসব ঝামেলা নিতে যেও না।
তমাল বললে-এটা একটা ছোট্ট ব্যপার।তোমাদের দূর থেকে কলেজে দেখতাম আর তোমাদের বন্ধুত্বের সাহচর্য মনেপ্রাণে চাইতাম।আজ একটু সুযোগ পেয়েছি বুদ্ধ এইটুকু করতে দাও।

মনের ভেতরে বলে উঠলো-পুলিশেরাও মানুষ।সবাই অমানুষ হয়ে যায় না সব পেশাতেই।তবে যদি ঘটনাটা এমন ভাবে ঘটতো সালতামামি আর মেঘবর্ণা,এরমধ্যে কেউ যদি অন্য ধর্মের হতো। নামগুলো ধর্তব্যে আনছি না।ওরা একসাথেই আছে কিন্তু জীবন বিপন্ন নয়।আর ধর্মের এক চামচ ঢেলে দিলেই গোটা কমিউনিটি ওদের জীবন বিপন্নতায় সংশয়ে ভরে তুলতো।তমাল দত্তকেও অত সহজে ট্যাকল করতে দিত না।সমাজ ধর্ম বর্ণ রাষ্ট্র তাই আমার কাছে একটা মস্ত -----।

সন্ধের মুখে তমাল ফোন করলো।জানাল-পুলিশ সালতামামির গ্রাম সুবলভিটায় গিয়েছিল।সালতাকে পাওয়া যায়নি।তবে ও একরাতের জন্য এসেছিল এটা সত্যি। গতকালের বিকেলে  নকশালবাড়ি গিয়ে আর ফেরেনি।সন্ধের মুখে তাই নকশালবাড়ি স্টেশনে দেখা গিয়েছিলো।সকাল থেকে সারাদিন ওদের গ্রামের একজনের বাড়িতে কাটিয়েছে।তাদের বাড়ির একটি ছেলে দিল্লীর কাছে গাজিয়াবাদে থাকে।পুরো চারজনের পরিবার নিয়ে থাকতো।বৌ আর দুটি বাচ্চা নিয়ে।লকডাউনের পর থেকে তাদের খবর এখনও বাড়ির কেউ জানে না। পরিযায়ী হয়ে দেশের পথেই তারাও একদিন বেরিয়ে পড়ে শুধু মাত্র বাঁচবার আশায়।এটুকুই খবর এসেছে।আমি নকশালবাড়ি থানাকে বলে দিয়েছি খড়িবাড়ি আর শিলিগুড়ি মেট্রোপলিটন পুলিশকে খবরটা দিয়ে দিতে খুব ভালো করে। শিলিগুড়ির সমস্ত থানা যেন সালতামামিকে নজরে আনেন।

আমরা ভেবেছিলাম সালতামামি হয়ত ওর বাড়িতে দিব্যি টানটান ঘুম লাগিয়ে দিয়েছে।পুলিশ ওকে জোর করে ধরে মেঘের সাথে কথা বলিয়ে দেবে।এ কোথায় কী!

মেঘ বলে-ব্যাপারটা কি রকম ঘোরালো হয়ে যাচ্ছে না‌।শালা মালটা পাগল হয়ে গেল না তো?

আমি বললাম ওর ডায়েরী  লেখায় কোথাও পাগলামী দেখলি?ওর গভীরতা চিরকাল আমাদের থেকে অনেক বেশি।আরে মেঘ আমরা সব কটা
মাল তো পাগল!সবাই আড়ালে বলতো না?

মেঘ জানালা খুলে ঘোড়াডিহির বিস্তীর্ণ ঝিলের দিকে এই সন্ধ্যালোকে তাকিয়ে রইলো।আমি আমার হাউসের সাথে দু-একটা কথা বলবো বলে বসলাম মোবাইল নিয়ে ওদের ব্যালকনীতে।

হঠাৎ দেখি মেঘরোদহাসি চিল্লিয়ে উঠলো-এই দেখ বুদ্ধু!

আমি- কি বলতো? বলে মেঘের দিকে ঘাড় ঘোরালাম।দেখি ওর হাতে কিছু একটা ধরা।

(এরপরের পর্বে এবং শেষ পর্ব।)

Post a Comment

0 Comments