জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প (পেরু)/ চিন্ময় দাশ

 
      চিত্র- শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য 

Peruvian folklore
দূর দেশের লোকগল্প (পেরু)


চি ন্ম য়  দা শ

ভােরের শুকতারা

আকাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আন্দিজ পাহাড়। যেন গােটা দেশটা শাসন করছে সে। সেই পাহাড়ের মাথায় একটা গুহা আছে। সেখানে বাস করে বিশাল একটা শকুন। এত বিশাল তার চেহারা যে, ভয়ে শিউরে উঠতে হয় দেখলে। সে যখন ডানা মেলে দেয়, পাহাড়ের গােটা মাথাটাই যেন ঢাকা পড়ে যায় তার ছায়ায়। তাই নিয়ে ভারি গুমাের তার। নিজেকে গােটা পেরুর রাজা মনে করে সে। 
সেই পাখির গুহায় থাকে একটি মেয়ে। ভারি অভাগিনী সে। এক গরীব মেষপালকের বাড়ি থেকে তাকে ছোঁ মেরে তুলে এনেছিল রাজ-পাখিটা। গুহাটা যেমন নির্জন তেমনি অন্ধকার। আর ভারি বোঁটকা গন্ধ তার ভিতরে। সেখানেই আজ কতদিন আটকে আছে সে। 

মনে ভারি কষ্ট বেচারি মেয়েটার। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয়। রাক্ষসের মত খিদে পাখিটার পেটে। কাঁড়ি কাঁড়ি খাবার বানাতে হয় তার জন্য। পাহাড়ের একেবারে নিচে যে পাহাড়ি নদীটা বয়ে চলেছে, সেখান থেকে জল তুলে আনতে হয়। ঘর-দোর সাফসুতরো করতে হয়। বুনাে উটের বড় বড় চামড়া নিয়ে আসে পাখিটা। সেসব দিয়ে বিছানা বানাতে হয় তার। কাজের যেন শেষ নাই।
পাখিটা বাসা থেকে বেরিয়ে গেলে,কাঁদতে বসে বেচারা মেয়েটি। কবে ফিরে যেতে পারবে তার নিজের গ্রামে। বিশেষ করে, বাবার জন্য ভারি মন খারাপ হয় মেয়েটার। কোন দিন কি আর বেরুতে পারবে না সে এখান থেকে ? কান্নায় বুক ফেটে যায় তার। 
নির্জন পাহাড়ের এই উঁচুতে কেউ নাই কোথাও। শুধু শোঁ-শোঁ বাতাস বয় দিনরাত। এখানে কে শুনবে তার কান্না ? তবে শােনে একজন। নীচে যে পাহাড়ি নদীটা তিরতির করে বয়ে চলেছে, সেইখানে থাকে একটা ছােট্ট ব্যাঙ। সে শােনে মেয়েটার কান্না। আসলে সেই ব্যাঙের মনেও ভারি দুঃখ। সে বেচারির সামনের ডান পা-টা বেখাপ্পা রকমের বড়। বাঁদিকের পায়ের একেবারে দ্বিগুন। তার ভাইবােনেরাই তাকে খেপাত 'ল্যাংড়া' বলে। তাই তো মনের দুঃখে এখানে চলে এসেছে সে। একা একা থাকে। গুহাটার সব শব্দ কানে আসে ব্যাঙের। ভারি কষ্ট হয় তার মেয়েটার জন্য। 
একদিন ভরপেট খেয়ে বিছানায় গড়াচ্ছে পাখিটা। মেয়েটা বলল – “আমি একটু নদীর ঘাটে যাব।'
“কেন ? জল আনিসনি সকালে ?"-- বাজখাঁই গলায় জানতে চাইল পাখিটা। মেয়েটা বলল – “জল নয়, কাপড়গুলাে কেচে আনব। ভারি নােংরা হয়েছে।"
পাখি বলল -“বোকা পেয়েছিস আমাকে ? নদীতে যাওয়ার নাম করে পালিয়ে যাওয়ার মতলব ? ওসব ফন্দি খাটবে না।”

মেয়েটা সাহস করে বলল - "কি করে পালাব ? কাপড় কাচবার শব্দ তাে শােনা যাবে এখান থেকে ? তাতেই মালুম হবে, আমি কাজ করছি কিনা।"
-- "এটা অবশ্য ঠিক বলেছিস। ঠিক আছে, যা। দেরি করবি না যেন।" পাখিটা বলল -" তবে শােন, শব্দ থেমে গেলেও যদি না আসিস, তখন আমাকে যেতে হবে।ছিঁড়ে টুকরো টুকরাে করে ফেলব একেবারে। আমার নখের ধার দেশ শুদ্ধ সবাই জানে।" 
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে নদীর ঘাটে নেমে এল মেয়েটা। ছোটবেলা থেকে মেয়েটির আর একটা নাম ছিল-- শুকতারা। বাবা আদর করে ডাকত শুকু। এখানে কোন মানুষই নাই। কে তাকে ডাকবে? নিজের নামটাই ভুলতে বসেছে সে। পাথরে আছড়ে কাপড় কাচছে, আর কেঁদে চলেছে নিজের মনে।
-- "অমন করে কেঁদো নাগাে, মেয়ে।" যেন নদীর জলে ভাসতে ভাসতে উঠে এল কথাগুলাে। কে বলল ? মেয়েটা এদিক ওদিক তাকাতে লাগল অবাক হয়ে। বুঝতে পারল না কিছু।তা দেখে, সাঁতার কাটতে কাটতে এগিয়ে এল ব্যাঙটা। বলল-- "কেঁদে কোন লাভ নাই, বাছা। তার চেয়ে, মনে সাহস আনো, পালাও এখান থেকে।" 
মেয়েটা বলল-- "কী করে পালাব? কাপড় আছড়াবার শব্দ থেমে গেলেই, ছুটে আসবে পাখিটা। ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে আমাকে।" কথা বলছে, কিন্তু হাত থেমে নেই তার। কাপড় কেচেই চলেছে। 
ব্যাঙ বলল-- "সে ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি। যাদুশক্তি আছে আমার। চাইলেই, তােমার চেহারা ধরতে পারি আমি। তােমার হয়ে আমি কাপড় কাচব এখানে। সেই সুযােগে পালিয়ে যাও।"
একথা শুনে, ভারি আনন্দ হল মেয়েটার। আবার গ্রামে ফিরে যেতে পারবে সে? ঝাপিয়ে পড়তে পারবে বাবার কোলে? তখনই তার মন বলল-- 'না, না, এটা হয় না।' মুখে বলল-- "নাগো, তা হয় না। আমি যাব না।”
ব্যাঙ তাে ভারি অবাক। আচ্ছা মেয়ে তাে। বলল-- "কেন ? যাবে না কেন ?"
"আমি চলে গেলে, তােমাকে খেয়ে ফেলবে শয়তান পাখিটা। আমার নিজের জন্য, তােমার বিপদ কেন ডেকে আনব ? সেটা ঠিক কাজ নয়।"
এমন কথা শুনে। ভারি ভাল লাগল ব্যাঙের। সে বলল– “পাখির বিপদ আমি সামলে নেব। তােমাকে চিন্তা করতে হবে না। এখন সময় নাই, পালাও তাড়াতাড়ি।" 
মেয়েটা ভারি খুশি। আদর করে হাতে তুলে নিয়ে, ছােট্ট একটা চুমাে দিল ব্যাঙটার কপালে। ঠিক তখনই চোখের পলক না পড়তেই, মেয়েটার চেহারায় বদলে গেল ব্যাঙটা। তার হাত থেকে নিয়ে কাপড় কাচতে লেগে গেল। মুখে বলল-- "তাড়াতাড়ি যেও গাে, মেয়ে। দেরি কোর না যেন।"
মেয়েটা হাত নেড়ে বলল– “ভাল থেকো, বন্ধু। বিদায়।"
নদীর পাড় ছেড়ে পাথর ডিঙাতে ডিঙোতে ছুটতে লাগল মেয়েটা। যত জোর আছে তার শরীরে, সব এখন জড়াে হয়েছে তার সরু সরু পা দুটোতে। এদিকে ভর পেট নিয়ে গুহার ভিতর অলসের মত গড়াচ্ছিল পাখিটা। এক সময় তার মনে হল-- 'অনেক সময় হয়ে গেল। ফিরছে না কেন হতভাগী ? দুটো কাপড় কাচতে এত সময় লাগে ? যাই দেখি একবার, ব্যাপারটা কী ?'.
নদীর পাড়ে এসে দেখল, একমনে কাপড় আছড়াচ্ছে মেয়েটা। কোনদিকে হুঁস নাই তার। পাখিটা গর্জন করে বলল– “অ্যাই মেয়ে, উঠে আয়। আর কাচতে হবে না তােকে।" মেয়েটা কোন সাড়াই দিল না সে কথায়। রাগে গরগর করে উঠল দানবটা-- "কথা কানে যায় না? দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা।"
যেই নীচে নেমে এসেছে সে, অমনি কাপড় ফেলে ঝপাং করে জলে লাফিয়ে পড়ল মেয়েটা। পাখি তাে বেদম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল প্রথমে। 'আরে, এটা কী হল ?' তারপর ভাবল-- 'পড়ুক না জলে, উঠে তাে আসতেই হবে। পালাবে কোথায় ?' 
তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রইল সে নদীর দিকে। টলটলে জল নদীর। তলার নুড়িটাও দেখা যায় যেন। পালাবার কোন উপায় নাই। হয়েছে কী, জলে ঝাপ দিয়েই নিজের চেহারায় ফিরে গেল ব্যাঙটা। কোথায় মেয়ে? আবার একটা ছোট্ট ব্যাঙ মাত্র সে। ভেসে ভেসে সাঁতরে পালাতে লাগল নিজের বাড়ির দিকে। সেখানে তার মা-বাবা, ভাই-বােন সকলে রয়েছে। পাখির তো আর এসব কিছুই জানা নাই। সে ভাবল-- 'মেয়েটা নিশ্চয়ই লুকিয়ে আছে কোন পাথরের আড়াল। কিন্তু ডাঙার জীব তুই। জলের তলায় আর কতক্ষণ থাকবি?' স্থির চোখে জলের দিকে চেয়ে, ঘাপটি মেরে বসে রইল সে।

ততক্ষণে ছুটতে ছুটতে একটু একটু করে নিজের বাড়ির দিকে এগিয়ে চলেছে মেয়টা। আর, জল কাটতে কাটতে ব্যাঙটাও চলেছে তার বাড়ির দিকে। এক সময় যখন বাড়ি এসে পৌঁছল ব্যাঙ, মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই খুব খুশি। সবাই ঘিরে ধরল তাকে। দেখা গেল, তার সামনের বেঢপ ডান পা-টা কোথায় উধাও। দুটো পা-ই সমান এখন। সবাই আনন্দে আটখানা। 

একটা ছােট্ট বােন ছিল ব্যাঙের। সে বলল – “পায়ের কথা ছাড়। কিন্তু তাের কপালে ওটা কী ?"
সবাই তখন চেয়ে দেখল তার কপালের দিকে। সত্যি তো, ছােট্ট মুক্তোদানার মত কিছু একটা জ্বলজ্বল করছে তার কপালে। যেন ঠিক ভাের বেলাকার শুকতারা। 

ব্যাঙটা তাে জানে না কিছু। সে অবাক হয়ে জলে ঝুঁকে পড়ল। ছায়া দেখল নিজের। সত্যি তাে, একটা তারা জ্বলছে তার কপালে। অমনি তার মনে পড়ে গেল, যাবার আগে এখানেই তাকে চুমু খেয়েছিল দুখিনী মেয়েটা। তার কৃতজ্ঞতার চিহ্নই তারা হয়ে ফুটে উঠেছে তার কপালে। আনন্দে বুক ভরে গেল তার। 
অন্যের বিপদে উপকার করলে, এভাবেই তার ফল পাওয়া যায়।
-------------------------
আরও পড়ুন। ক্লিক করে 👇

দূরদেশের লোকগল্প (তিব্বত)
চিন্ময় দাশ 

  


Post a Comment

0 Comments