জ্বলদর্চি

ঘোড়াডিহির অন্তর্ধান রহস্য-৭/গৌতম বাড়ই

ঘোড়াডিহির অন্তর্ধান রহস্য

গৌ ত ম  বা ড় ই

পর্ব-৭

সাব-ইন্সপেক্টর তমাল দত্তের চায়ের কাপে ঠোঁট বুলোনোর সাথে এক চিলতে হাসি উড়তে লাগলো।আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-বুদ্ধদেব আপনারা তো যাদবপুরের ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন?

এই সাব-ইন্সপেক্টর চরিত্রটি তো আমার গত কয়েক বছরের সাংবাদিকতার জীবনেও ক্রমশ অপার রহস্যের জাল বুনছে দেখি।জীবনে সত্যিটাকেই আঁকড়ে রয়েছি এখনো।মিথ্যে বলব না কিছুতেই।সত্যের জন্য বিপদ এলেও।এইসব ফন্দী ফিকির করে, চা খাওয়ানোর নাম করে মুখের মাস্কখুলে আমাদের দুজনের মুখটি এখন স্পষ্ট দেখার ছক।তাই ঘাড় সোজা করে চেয়ে বললাম- হ্যাঁ।কেন?

আমায় চিনতে পারছেন না ঠিকই কিন্তু আমি আপনাদের তিনজনকেই চিনি এবং ভালোমতন।

মেঘরোদহাসি আর আমি অবাক হয়ে তাকালাম থানার সেকেন্ড অফিসার ছোটবাবু তমাল দত্তের মুখের দিকে।না জানি এরপর সাজিয়ে গুছিয়ে আবার কী পুলিশি সওয়াল করবেন।তমাল দত্ত বলতে লাগলেন এরপর-----

আমরা চারজন,হাঁ আমিও যাদবপুরের ঐ সেম ইয়ারের ছাত্র।চিনতে পারছেন না তো?না পারবার-ই কথা।আমি ফিজিক্স এ অনার্স।পাতি বাংলায় পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র।আপনাদের চিনি কারণ আপনারা তিনজন তখন ছাত্রনেতাদের সামনের সারিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডীতে ঐ ছাত্র আন্দোলনের মুখগুলি তো ফেমাস হয় তাই।তারপর কালচারাল এক্টিভিটিস সব কিছুতেই যাদবপুরের সেই সময়ের উজ্বল মুখ আপনারা।আমরা মুখচোরাদের দলের। আপনাদের সেই গ্রুপের আপনারা যেমন তারপর মেদিনীপুরের জনার্দন মাইতি,নৈহাটির সন্দীপ,বোলপুরের হাসি রায় এইসব তাদেরকেও মনে আছে।

বললাম-না ভাই আপনায় চিনতে পারিনি ঠিকই তবে মনে হচ্ছিলো কোথায় যেন দেখেছি।আমার তো পেশাগত কারণে থানায় থানায় যেতে হয় ভাবছিলাম কোনো থানায় দেখেছি।

আমি ছিলাম ভিড়ে মেশা এক লাজুক মানুষ।বাবার অসময়ে চলে যাওয়া আমায় কলেজের গ্রাজুয়েশনটা কমপ্লিট করেই চাকরির খোঁজে পুলিশের চাকরিতে যোগদান।কোনদিন ভাবিনি এই পেশায় আসবো।তবে আর আপনি নয় তুমি চালাতেই পারো।আমি কাল মিসিং ডায়েরি পড়েই যেন তোমাদের পুরোনো ছবি দেখতে শুরু করি।তারপর আজ প্রথম থেকেই তোমাদের দেখেই একদম শিয়োর হই।আমি সকালে খবর পেয়েই এক চক্কর লাশ দেখে এসেই তোমাদের খবর দেই বা দেওয়ার চেষ্টা করি। তখনও হাল্কা ঝাপসা আলো।তোমাদের সাথে আমিও মনে মনে চাইছিলাম এই লাশ যেন সালতামামির না হয়।

আমরা মুখোশহীন মুখোমুখি পাশাপাশি বসে এক মুহূর্তের নিস্তব্ধ রচনা করি।মেঘ বলে-দেখো তমাল এতো আরও ভালো হলো।

ভাল মানে তোমাদের এটুকু কথা দিচ্ছি সালতামামির খোঁজ নিয়ে আসবোই।তবে সেটার মধ্যে পজিটিভিটি থাকলে আরও ভালো।জীবন আর মৃত্যুর মাঝে তো আর কিছু নেই।তাই বললাম।
কী বল বুদ্ধ?

আমি একটা বড় শ্বাস নিয়ে বলি ধীরে-একদম তাই।
তবে আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরুবো।আমার মিডিয়াতে আজ যাবো কদিন পর।একটা খবর ভাবছি তৈরী করবো আজ সালতাকে নিয়ে। অন্যদের খবর যেমন চটজলদি তৈরী হয়ে যায় নিজের লোককে নিয়ে এমন খবর করতেই মনে পড়ে না বা মন চায়না।


এই ধ্বস্ত সময়ে তবুও আমি হাত বাড়িয়ে দি তমালের দিকে।তমালও হাত বাড়িয়ে ঝাঁকিয়ে দেয়।মেঘও তাই।বন্ধুত্বের আবেগ কিছুই মানলো না।

মেঘ যদিও বললো- ঠিক হলোনা রে।তবে ফ্রেন্ডশিপের মধ্যে করোনাও ঢুকতে ভয় পেয়ে যাবে।

তোমরা চিন্তা করনা বুদ্ধ আর মেঘ।আমি যত শীঘ্র সম্ভব খবর নিয়ে আসবার চেষ্টা করছি এই নিরুদ্দেশের।কোথায় আছেন তিনি এই মহাপুরুষটি।তবে মেঘ ফোনটি ধরো।কারণেই ফোন করবো।বুদ্ধ তুমিও তাই।

আমরা বেরিয়ে পড়লাম এবার। সময় দেখলাম দশটা গড়িয়ে এগারোটার পথে।মেজবৌদিকে ফোনে বললাম দুপুরেই ফিরবো।

মেঘকে ওর কমপ্লেক্সের মেইন গেটে নামিয়ে দিতে গিয়ে বললাম আজ রাতে আসছি।তোর কিছু দরকার পড়লে জানাস নিয়ে আসবো।রাতে থাকবো।দেখি গুটিগুটি পায়ে সকালের ডিউটির সিকিউরিটি গার্ডটি আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন।তাই দাঁড়িয়ে গেলাম আর মেঘকেও বললাম দাঁড়া।

ম্যাডাম দাদাকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না?কদিন থেকে।দাদার কি মাথায় গোলমাল ছিলো?

এটুকু শুনতে পেয়েই আমি বললাম- এসব কে বলেছে?ঐ ব্যানার্জী ধেড়ে খোকাটা?ওটাকে বলে দেবে অন্যের ব্যপারে বেশি নাক না গলাতে।মেঘ তুই বেগড়বাই দেখলে আগে তমালকে ফোন লাগাবি।আজ একটা হারামিগুলোর সাথে রাতে বোঝাপড়া হবে।শালা আমরা মরছি নিজের জ্বালায় আর ঐ দুটো দামড়া এখানে মাতব্বরী মারাচ্ছে।কেন রে বাবা সোজাসাপ্টা তোকে এসে প্রশ্ন করা যায় না?করোনা টরোনা না, মালগুলোর নেচার এমনি‌।আড়ালে বসে ঘুঁটি চালানো।মেঘ তুই যা।দরকার পড়লে আমাকেও ফোন করিস।

যত্তোসব!ভাই সিকিউরিটি পেটের দায়ে এসেছো এখানে ভাই। বুদ্ধি করে চলো।ঐ মাতব্বরদের কথায় সব সময় চলবে না।এই বলে আমি বেরিয়ে আসি।

আজ আবার অনেকদিন পর

আমাদের সংবাদপত্রের অফিসে ঢুকলাম।ঢুকতেই দেখি মুখে মাস্ক হাতে মাথায় কভার দিয়ে বড় টেবিলটার এককোণে বসে ল্যাপটপে সুতনু নিমগ্ন হয়ে কী যেন লিখে চলেছে।আমি মোবাইল নিয়ে একটু দূরে বসলাম।কিছুক্ষণ পরে ঘরে কারও উপস্থিতি টের পেলো সে।আমায় এক ঝলক দেখলো।তারপর হঠাৎ লাফিয়ে উঠে বললো--আরে গুরু তুমি!বুদ্ধদা বল কী রকম আছো?তোমার কথাই কালকে হাউসের মিটিং-এ হচ্ছিলো।

আমি বললাম- জানি রে জানি।একটা বিশেষ পারিবারিক ঝামেলায় ফেঁসে গ্যাছি।কাল তন্ময়দা আমায় ফোন করেছিলো।

পারিবারিক ঝামেলা মানে?

না রে তাই বলে বাড়ির কেউ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়নি।ভয় পাস না।

আমার দিকে তাকিয়ে হাল্কা একটা হাসি দিলো সুতনু।মনযোগ দিলাম দুটো ম্যাটার নিয়ে।একটা তো ছোট খবর ঘোড়াডিহির ঝিলের ধারের অজ্ঞাত পরিচয়হীন যুবকের লাশ।আর একটি সালতামামি কে নিয়ে।ওটা বেশ গুছিয়ে লিখবো।এডিটর তন্ময়দার সাথে একটু বাদেই এই নিয়ে আগে  আলোচনা করে নিতে চাই। খবরটা গুরুত্ব দিয়ে ছাপতে হবে।আর এদের ই-মিডিয়ায় যদি এক টুকরো ছোট খবর দেওয়া যায়।আমরা চেয়েছিলাম ব্যপারটা গোপন রাখতে। সালতামামি নামটা শুনলেই তো কিছু প্রতিক্রিয়া হবে তরুণ মহলে।তন্ময়দা সব শুনে বললেন-আলবাৎ হবে। দাঁড়া এটাকে বেশ গুরুত্ব দিয়েই ছাপবো।এইসব ঠিকঠাক করে বেরিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় বিকেল চার সাড়ে চারটে হল।দুপুরে আর ফেরা হলো না।বাড়িতে ঢুকতেই মেজোবৌদি বললেন- ছোটো তাড়াতাড়ি স্নান করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে খেতে আয় আমার এখানে।আমি তোর জন্য অপেক্ষা করছি।তোর দুপুর যে বিকেল তা আমি জানি।

আমি বললাম মেজবৌদি এসব কেন--
মেজো আমায় এমনভাবে বলল- তুই এতকথা না বলে তাড়াতাড়ি কর দিকিনি ভাইটি। আমি তাড়াহুড়ো করে স্নান করতে গেলাম।এই করোনা পরিস্থিতি না হলে শুধু হাত মুখ ধুয়ে চালিয়ে দিতাম।এখন এই কোভিড-১৯ জীবনের বাপ বাপান্ত করে ছাড়ছে।

অনেকটা দিন পর আজ এই টেবিলটায় খেতে বসেছি।বার্মাটিকের বাবার তৈরী করা এই টেবিল,মায়ের কাছে শুনেছিলাম বাবা বিয়ের আগে নতুন বৌ আসবে বলে পুরানো লঝঝড়ে একটা ভাঙাচোরা টেবিল পাল্টে পনের হাজার টাকায় এই টেবিল বৌবাজারের ফার্ণিচারের দোকান থেকে অর্ডার দিয়ে বানিয়েছিলেন।এই টেবিলের সাথে কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে।যদি কোনদিন এই স্মৃতিটুকুকে বিদায় জানানো হয় আমাদেরও কত স্মৃতি ভেসে যাবে সাথে।ঐ তো ওধারে বসতো ঝিমলি,আমার ছোটবোন।দাদাদের সাথে রাতে দেখা হতো। বাঁদিকেরটায় বড়দা এদিকে আমার ডানহাতে পাশে সেজদা।তানিয়াদিদি আমার বাঁ হাতে। কখনও মায়ের সাথে আমাদের খাবার পরিবেশনে সহযোগিতা করত তখন মায়ের সাথে খেতে বসতো।বাবার সিঙ্গল চেয়ার ওপাশে টেবিলের বাঁকে।এদিকে মেজদা।মেজদা আর বাবাই আমাদের ওষুধের দোকানের ব্যবসা দেখে।মেজদার ব্যবসা দেখতে গিয়ে কলেজের পড়াশোনা আর শেষ করে হয়ে ওঠেনি।অথচ মেজদা অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন।বড়দা আর সেজদা চিরটাকাল নিজেদের জীবনের সুদৃঢ় ভিত্তি গড়ে গিয়েছেন।বাবা একবার অসুস্থ হয়ে পড়াতে মেজদাই বাবার সাথে ব্যবসায় পাশে গিয়ে দাঁড়ান সব জলাঞ্জলী দিয়ে।আজ সেই ছোটবেলা কিশোর বেলার ছবি দেখতে পারছিলাম।আরে ঐ তো মা খাবার থালা নিয়ে আসছেন।

ছোটো এত গভীর ভাবে কী ভাবছিস? মেজবৌদির কথায় চমক ভাঙ্গলো।

কই না তো?

আচ্ছা এবার খেয়ে নে।তোর প্রিয় দই পটল আর মৌরালা মাছের চচ্চড়িও আছে।নে বিউলির ডাল আর আলুপোস্ত দিয়ে শুরু কর।
আমি খেতে শুরু করি।মেজবৌদি ঠিক মায়ের মতন আমার পাশেই বসে আছেন। মানুষ এই স্নেহছায়ার তলে বসতে চায় জিরিয়ে নিতে চায় বলেই ঘরে ফেরে।

মেজবৌদি টুম্পাইকে ডাকে- টুম্পাই কাকাই এর জন্য চিকেনটা নিজের হাতে দে।

আমি বললাম- ওটা টুম্পাই করেছে?

হাঁ দেখ খেয়ে তোর ভাইঝি চিকেনের কী আধুনিক পদ রেঁধেছে।এই লকডাউনে ইউটিউব দেখে।আমি বাপু আর ঐ সব কেতার রান্নায় নেই। জীবনের এই শেষটায় ঐ থোড়- বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড় রেঁধেই তোদের খাওয়াবো।

তুমি তো অসাধারণ রাঁধো।ওটাই চালিয়ে যাও।টুম্পাই তুই ও তো বৌদির মতন রান্নায় উস্তাদ হয়ে উঠছিস।হেভী রেঁধেছিস কিন্তু--
কি যে বলো কাকাই ! মা সব কিছু জানে আমার থেকেও ভালো।আমি কলেজ বন্ধ বলে এই সবে ইউটিউব আর মাদারটিউব চ্যানেলে হাত পাকাচ্ছি।
অনেকদিন পর কাকা আর ভাইঝি মন খুলে হেসে উঠলাম।সত্যি ওদের আর্থিক অবস্থা যে অনেকটা ভালো হয়েছে তা ঘরের এত আলো দেখেই বুঝতে পারছি। লক্ষ লক্ষ আলো নেভে আবার কোথাও বা একবিন্দু আলো জ্বলে ওঠে।মন থেকে বললাম তোরা ভালো থাক টুম্পাই।

তারপর মেজবৌদি খেতে বসলো।মেজদা আগেই খেয়ে নিয়েছে দোকানের জন্য।আমায় বললো যদি তোর সময় থাকে ছোটো আমার পাশে এখানে বসে বল কী হয়েছে?

মেজবৌদি খাচ্ছে আর আমি যতটা বলা যায় মেজকে বললাম এই চার পাঁচদিনের ঘটে যাওয়া কথাগুলি।

সালতা ছেলেটি তো কিছুটা পাগলাটে স্বভাবের।তবে খুব ভালো একটা মানুষ।তোর সাথে ঐ মেঘ আর সালতা যখন একটা  সময়ে খুব আসা যাওয়া করতো।কত গল্প করেছি।মেঘকে দেখে আমাদের পুরানো ভাবনাগুলি এক নিমেষে ঝেড়ে ফেলে সতেজ হতাম।সাবধানে থাকিস আর খবর দিবি নিয়মিত।বয়স বাড়ছে।তোকে নিয়ে,তোদেরকে নিয়ে খুব চিন্তা হয়রে এখন।একটা বিষাদ হতাশাগ্রস্ত দুঃসময় এটা।এখানে প্রতি মুহূর্তে ভাবনা এখন চরম অনিশ্চয়তার গভীরতায় ডোবে।

(এরপর পরের পর্বে)

Post a Comment

0 Comments