জ্বলদর্চি

ঘোড়াডিহির অন্তর্ধান রহস্য-৮/ গৌতম বাড়ই

ঘোড়াডিহির অন্তর্ধান রহস্য

গৌ ত ম  বা ড় ই

পর্ব-৮

আমাদের সেই জীবনটা ছিল একটা টলটলে জলে ভরা দিঘির মতন।স্বচ্ছ অথচ একটা ছোটো পাথরও ছুঁড়ে মারলে তরঙ্গ তুলে সারাটা দিঘি ছড়িয়ে পড়ত।আজ অবেলায় বলতে গেলে প্রায় অন্ধকার নেমে আসা বিকেলে যখন ঝুপ করে সন্ধে নেমে আসে সেইসময়ে সালতামামির লেখালেখির ডায়েরীটা নিয়ে সবে বসেছি একটু পড়বো বলে দেখছি চোখ যেন ঝাপসা হয়ে আসছে আর মাথার চিন্তাশক্তিও কাজ করছে না।আসলে গত রাতের অপর্যাপ্ত ঘুম আর সারাদিনের মানসিক এবং শারীরিক ধকলের জন্য।একটু ঘুমিয়ে নিই মোবাইলে এলার্ম দিয়ে ভাবছি।রাত আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ ঘোড়াডিহি যাবো। এখন আর কোন কথা নেই কারোর সাথে।

জানিনা কতক্ষণ ঘুমিয়েছি মোবাইলটা বেজে উঠে ঘুমটা ভাঙ্গালো।দেখি তমালের ফোন। তাড়াতাড়ি ধরলাম।

খবরটা ভালোই করেছো বুদ্ধ টিভিতে দেখলাম।আজ দুটো খবরই আমার থানা এলাকার ছিল।অজ্ঞাত পরিচয় লাশের এখনও কোন খোঁজ মেলেনি।সালতামামির ফোন তো সুইচড অফ সাত জুন থেকে।শেষ টাওয়ার লোকেশন ঘোড়াডিহি নেচার রেসিডেন্সী।অর্থাৎ মেঘ আর সালতামামির কমপ্লেক্স তো দেখছি।রাত সাতটা বেজে তেতাল্লিশ মিনিট।শেষ ফোন কলড্ যাদবপুরে।তাহলে কী এই কলকাতায় কোথাও গা ঢাকা দিয়ে আছে?তাই যেন হয়।

তমালকে পেয়ে আমাদের এক বিরাট সাপোর্ট পাওয়া গিয়েছে।জনারণ্যে এই সময় এরকম একটা ঘটনায় যে কী মুশকিলে পড়তাম ঐ কমপ্লেক্সের ওঁচাটে লোকগুলোর আচার আচরণ  দেখেই বুঝতে পারছি।আমায় সাত-ই জুন সকাল এগারোটা নাগাদ একবার ফোন করেছিলো।মামুলী কথাবার্তা বলেছিল-- পুরো বন্ধ হয়ে পড়ে আছিরে এটাই আর ভালো লাগছে না।দোকান খুললেও সন্ধে হতেই বন্ধ।মানুষের ভেতর এখনও আতঙ্কে চলাফেরা।আমি বলেই ফেললাম তমালকে- আরে মেঘেদের ঐ কমপ্লেক্সের কিছুলোক মেঘের পেছনে এই দুঃসময়ের মধ্যেও খুব লেগেছে।

তমাল বলল- তাই! সকালে বললে না তো।তবে তক্ষুণি একটা দাওয়াই দিয়ে আসতাম।আমি এখন ডিউটিতে নেই। আগামীকাল সকালে যাবো আবার।সালতামামির কোন ইনফরমেশন এলে অংশুমান নামে যে পুলিশ অফিসারটি এখন ডিউটিতে আছে আমায় জানিয়ে দেবে।ঠিক আছে আমি অংশুমানকে একটু জানিয়ে দিচ্ছি আর অংশুমানের ফোন নাম্বার তোমায় দিচ্ছি।ও গিয়ে হাল্কা করে একটু মেডিসিন দিয়ে আসুক‌।অংশুমান আরও ইয়াং অফিসার।বছর ছয় সাতেক চাকরি হয়েছে।মেঘকেও দিয়ে দিচ্ছি ওর ফোন নাম্বারটি।

ঠিক আছে তমাল-বলে ফোনটি রাখলাম।

তন্ময়দা তাহলে খবরটিকে ভালোই গুরুত্ব দিয়েছে।বলে ছিলাম টিভিতে ছোট করে আর কালকের নিউজ পেপারে বড় করে দিলেও চলবে।তন্ময়দা আমার লেখাটি মোবাইলে দেখে নিলো।আর বলল-তুই বাবা আমাদের ইনফরমেশন ব্যবসা ওয়ার্ক ফ্রম হোম করিস দিনে দু-ঘন্টা করে। আর নিউজ মিডিয়াতে একটু ওদিকটা সামলেই দেখিস।আমার এখন খবর চাই খবর।বেশিরভাগ লোকে বাড়িতে এখন তাই পড়বার জন্য সময় দিতে পারছে।

ঠিক আছে তন্ময়দা বলে বেরিয়ে আসি।

কিছু পুরানো কথা মনে পড়তে শুরু করলো।

সময় এখন রাত সাতটা দশ।মানে পনের কুড়ি মিনিট বা আধঘন্টার মতন চোখ বন্ধ করে রেখেছিলাম।গভীর ভাবে ঘুমিয়ে ছিলাম। দেখলাম সেই ঘুমেই আমার ক্লান্তি এখন উধাও।আমি বিছানায় শুয়ে শুয়েই আমাদের সেই কলেজ জীবনের  ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গেলাম।

ওদিক দিয়ে বাতাসী আর এদিকে নকশালবাড়ি তারমাঝে সুবলভিটা গ্রাম।চা-বাগানের ভেতর দিয়ে গিয়ে বাতাসীর বাসস্ট্যান্ড এ শিলিগুড়ির বাস ধরতে হয়। এদিকে নকশালবাড়ি থেকেও বাস ধরা যায়।সালতামামির এক জ্যাঠতুতো দাদার বিয়েতে গিয়েছি। পাঁচ রকমের শাক খেয়েছিলাম।ঢেঁকী শাক তারমধ্যে একটি।এত ভালো লেগেছিলো যে কদিন ছিলাম তারমধ্যে অন্তত আর্ধেক দিন খেয়েছি।মেঘেরও ভালো লেগেছিলো। শুনলাম এ অঞ্চলের খুব জনপ্রিয় শাক এটি।এই খবরটি আগেই জানতাম যে যখন জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি পুজোর অবকাশ কাটাতে উত্তরবঙ্গের জলদাপাড়ার হলং টুরিস্ট লজে থাকতে ভালোবাসতেন আর তার স্ত্রী কমলদেবী ফালাকাটার হাট থেকে ঐ শাক কিনে আনতেন। তখনও এই অঞ্চলের মানুষজন ভীষণ সরল সাদাসিধে।সালতামামির সাথে বেরিয়ে পড়তাম প্রতিদিন।নকশালবাড়ির জঙ্গলে পাহাড়গুমিয়ায় খড়িবাড়ি বাগডোগরা ব্যাঙ্গডুবি হয়ে লোহাগড়ের জঙ্গল দুধিয়া পানীঘাটা পানীট্যাঙ্কী নেপাল বর্ডার হয়ে মেচি নদী পেরিয়ে নেপালের ভদ্রপুর ও গিয়েছিলাম, তারপর যে কয়বার ওর বাড়িতে গিয়েছি বেড়াতে।আমাদের সাথে একটি মেয়ে সবাই অবাক চোখে চেয়ে দেখে মেয়েটিকে।মেয়েটি মেঘবর্ণা দাশ।ওরা ভাবে আড়ালে বলে- এর তো চলন বলন সব মরদের মতন। শিলিগুড়ি শহর থেকে একদিন আরও দুটো বন্ধু এলো।আমরা সবাই একসাথেই ট্রেনে করে আসি এই শিলিগুড়িতে।ওরা ওদের বাড়ি নিয়ে যেতে চাইছিলো।আমরা বললাম না আমরা এই এখানেই থাকবো।এই সুবলভিটার নদীর ওপারেই সেই জোতদারের বাড়ি যেখানে সশস্ত্র কৃষকদের সাথে পুলিশের লড়াই হয়েছিলো।কৃষকদের হাতে তীর ধনুক।তারপরের টুকুতো ইতিহাস।নকশাল আন্দোলন।নকশাল শব্দটাই অক্সফোর্ডের ডিকশনারীতে স্থান করে নিলো।যখন আমাদের সালতামামি আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছিলো ঐ জায়গাগুলো আমরা অদ্ভূত এক শিহরণ অনুভব করছিলাম ইতিহাসের ছাত্র হয়ে। ইতিহাস গায়ে মেখে নিচ্ছিলাম।সালতাদের চাষের জমি আছে কিছু তবে তা দিয়ে তো আর বাঁচা যায়না সারা বছর।
সালতা আমি আর মেঘ সেই বৃষ্টিরাতে গল্পে মেতেছি।আমরা রয়েছি সালতার কাকার বাড়িতে।টিনের চালা হলেও পাকা বাড়ি।পাকা টয়লেট।মেঘ আছে বলে এখানেই থাকা।সারাদিন সালতাদের বাড়ি খাওয়া দাওয়া আর রাতে এখানে।মেঘ ওর খুড়তুতো এক বোনের সাথে পাশের ঘরে শোবে আর আমি এবং সালতা এখানে।এই বন্দোবস্ত হয়েছে।তবে আমরা তার আগে প্রতিদিন মনভরে সারারাত জেগে গল্পে মেতে উঠতাম।

তোর এই মেয়েলীপনা ভেঙ্গে একটা পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে চলাফেরা করার এই  সাহসটা পেলি  কার কাছ থেকে? বা তোকে উদ্বুদ্ধ করলো কে?সালতামামি গল্পে আড্ডায় জিগ্গেস করলো মেঘবর্ণাকে।

আমার বাবা এবং আমার জীবনের দিশারী।মা টা একটা যা তা!ঐ সাবেকী চিন্তাধারার জন্য একনাগাড়ে এখনও হাতাখুন্তি নেড়ে যাচ্ছে।আমায় বেরুনোর সময় পইপই করে বললো--এই প্রথম বাইরে একা একা যাচ্ছো।নিজের ভালমন্দ আর আমাদের পারিবারিক সম্মান মনে রেখো।সোদপুরের দাশবাড়ির একটা ঐতিহ্য আছে।ধূলোয় গড়াগড়ি যেন না খায়।শোন কি বে-আক্কেলে কথা, বেরুনোর সময় কি যা তা কথা!
দাশবাড়ি!মাথায় তুলে নাচো।এসব নিজেরা নিজেদের মতন তৈরী করে।ঐতিহ্যের ধুনো জ্বালায়।নাচো নাচো।আমি এইসব কথাবার্তায় কোন আমল দি না। কোনদিন।আমার স্বাধীনচেতা যদি আমার উচ্ছন্নে যাওয়ার রাস্তা হয়,তাহলে সেই রাস্তা দেখিয়েছে আমার বাবা আমার জেঠু।দাশবাড়ির বিগ বসেরা।আই ডোন্ট কেয়ার এনি পার্সন।

আমি বললাম- মেঘ তোর এই মাতৃনিন্দা কী না করলে নয়? আলটিমেটলি তুই তো বাড়ি ছেড়ে বেড়াতে এসেছিস।আর মা হাতা খুন্তী না নাড়লে খেতিস কী? দেখিস না আমাদের কলেজের কত বন্ধুর ঐ আফসোসটা আছে যে -আমার মা তো সারাদিন তার অফিস নিয়েই ব্যস্ত থাকে।

ছোড় ইয়ার ঐ সব হেঁদোপেঁজো বাতচিত।আমার একদম পসন্দ না।এসেছি ঐ বাবার জন্য।আমায় বললো ঘরে গিয়ে, কাল তোকে বেড়াতে যাওয়ার টাকা হাতে দেবো।কত লাগবে বলে?আমি হিসেব টিসেব অত বুঝি না।

বাবা বললো-হাজার দশেক দিলে হবে?ব্যাস এই বেড়িয়ে পড়া।তারপর বড়মাসি ফোন করে বললো-খুব সাবধানে যাবি।সবই তো ছেলেবন্ধু।সাবধান।ওদের বেশী বিশ্বাস করবি না।শোন কথা।আসলে আমার মামাবাড়িটাই খুব রক্ষণশীল আর সেকেলে চিন্তাধারা নিয়ে চলে।অথচ সেইভাবে বললে কেচ্ছা কেলেঙ্কারিতে ভরা।এ্যয়সা বড়া বড়া কাহানী।সব ঢেলে দেবো তোদের কে একদিন।

এত প্রগলভ হয়েছে দেখে সেই রাতে আমি আর সালতা অন্য প্রসঙ্গে আসি।আমি সালতামামিকে বলি-তোদের এই নিরীহ চেহারার সাধারণ ভাবধারার লোকজন এখনও যাদের দেখছি এই গ্রামে তারা আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে এই অখ্যাত একটা  গ্রামে আগুন জ্বাললো কী ভাবে?বিদ্রোহের আগুন?বিপ্লবের আগুন?

সালতামামি বলেছিল- এরা কী আর জ্বেলেছিলো?জ্বেলেছিলো কলকাতা থেকে আসা লোকজন।কলকাতার ছাত্ররা।এক আদর্শ সামনে রেখে কত মেধাবী ছেলেমেয়েরা সেদিন নিজেদের জীবনকে বলিদান দিয়ে দেশটাকে প্রকৃত স্বাধীনতা এনে দিতে চেয়েছিলো।সশস্ত্র বিপ্লব!গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা কমরেড মাও এর চিন্তাধারা এই তত্ত্ব ছড়িয়ে  দিতে চেয়েছিলো।তারা প্রত্যেকেই সৎ ছিলো কিন্তু সততা দিয়ে কী রাজনীতি হয় রে? বুঝিস না।তবে এরমধ্যে একদিন এই সামনেই একজন সেই আমলের  আদর্শবান নেতার জীবন দেখিয়ে নিয়ে আসবো।দেখবি ঘরবাড়ি ছেড়ে কুঁড়েঘরে শেষ জীবনটা কাটাচ্ছে।দেখবি আর অবাক হবি।আমরাও তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে কিছু আদর্শ সামনে রেখে কী তুলকালাম ঘটাই,দেখবি এর পরে আমাদের অধিকাংশ বন্ধু বলবে আমাদের ভাবনাটা ভুল ছিলো।আমাদের এই এই ভাবে চলা উচিত।সব এসকেপিস্ট রে!আগুনের লেলিহান শিখায় সব সাধারণ মানুষগুলো পুড়ে মরে।আর ক্ষীর খায় তারাই আবার পুনরায় যাদের অত্যাচারের জন্য এই আগুন জ্বলে উঠেছিলো।এই সাধারণ মানুষগুলো নির্বোধ অধিকাংশ-ই,আবেগ আর বিশ্বাসে হঠাৎ করেই জ্বলে ওঠা।সামনে গিয়ে দেখ, জিগ্গেস কর,তারা দেশটাকেই সঠিক ভাবে চেনে না জানে না‌।মাত্র তিনশো টাকার জন্য প্রতিদিন কয়েকশো মহিলা এখানে গর্ভবতী হয়।জানিস।চল তোদের কে কালকেই দেখাবো সে মজা। খড়িবাড়ি,গলগলিয়া,পানীট্যাঙ্কী থেকে শিলিগুড়ি শহরের সব রুটের বাসে। 

অ্যা বলিস কী!গর্ভবতী।সে কিভাবে--মেঘ বলে ওঠে।

আরে বাবা দেখাবো।শয়ে শয়ে মহিলা নেপাল বর্ডার পেরিয়ে পেটের কাপড়ের ভাঁজে বিদেশী মাল নিয়ে পুতুনা রাক্ষসীর মতন ভুঁড়ি বাগিয়ে শিলিগুড়ির বাসে উঠছে।অথচ বর্ডারে এত সাজ সরঞ্জাম লোক লস্কর।পেচ্ছাপ পায়খানা বন্ধ করে সে মাল খালাস করছে শিলিগুড়ি শহরে কয়েকঘন্টা বাদে।পুরো জায়গাটার অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে চোরাচালানের ওপর। হাঁ আশ্চর্য হলেও সত্যি এটাই নকশালবাড়ির হাল হকিকত।

আমরা পরদিন কানু সান্যালের বাড়ি আর রুটের বাসে শিলিগুড়ি যাই।দেখি সেই কৃত্রিম গর্ভবতী মহিলাদের।বাস মালিক চালক কন্ডাকটর পুলিশ সবের মধ্যে কী সুন্দর বোঝাপড়া।সিটের ওপর বস্তা, সাধারণ যাত্রী দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কিছু বলবার উপায় নেই।অবাক হলাম না শুধু, আশ্চর্য হলাম কানুবাবুকে দেখে।

মনে পড়তে থাকে। সালতামামির কথা মনে পড়ে যায় আরও বেশি করে।আজ রাতে তো মেঘের ওখানেই থাকবো।প্রশাসনের একটু সহায়তা একটু সমর্থন পেলে মানসিক যে জোর সেটাই লড়াই করবার অনেক রসদ যোগায়।

গা ঝাড়া দিয়ে উঠি।আমাকে বেরুতে হবে রাতে।তবে আজ মেজোবৌদিকে জানিয়ে যাবো যে আমি রাতে ফিরছি না।
(এরপর পরের পর্বে)

Post a Comment

0 Comments