জ্বলদর্চি

অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল/ সন্দীপ কাঞ্জিলাল

"পাহাড় কাটে লোহা, লোহাকে গলায় আগুন, আগুনকে নেভায় জল, জলকে শুষে নেয় সূর্য, সুর্যকে ঢেকে দেয় মেঘ, মেঘকে উড়িয়ে নিয়ে যায় বাতাস।কিন্তু মানুষের সংকল্প বাতাসকেও বাধা দেয়। তাই এ পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষের সংকল্প।"

অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল

স ন্দী প  কা ঞ্জি লা ল

বেপথু বুদ্ধি -৩

আমাদের অনেক অসুখের মধ্যে, বদহজম একটি ভয়ানক অসুখ। এর ফলে শরীর মন মেজাজ খিটখিটে লাগে। ঠিকমতো পরিপাক হয়ে খাবার সংশ্লেষিত হয় না বলে শরীর ও দুর্বল লাগে। কোনও কাজ করতে উৎসাহ থাকে না। মোট কথা গৃহস্থের যদি রান্নাঘর খারাপ হয়, তার কপালে অশেষ দুর্ভোগ থাকে। তদ্রূপ কেউ বদহজমে ভোগে, তারও তেমন অবস্থা। 

খাবার হজম না হলে যেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, ঠিক তেমনি বুদ্ধি যদি হজম না হয়ে দুর্বুদ্ধিতে পরিণত হয়, তবে সে শুধু নিজের সর্বনাশ করে না, সমাজ সংসারের বিপদ ডেকে আনে। খাবার পরিপাক করতে লাগে এনজাইম, আর বুদ্ধি হজম করতে লাগে পঞ্চইন্দ্রিয়ের সাহায্য। ইন্দ্রিয় যদি বুদ্ধিকে সঠিক পথে চলতে না সাহায্য করে, তবে বুদ্ধি হয় বিপথগামী। আর এই ইন্দ্রিয়কে যদি মনের পরিচালনার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়, তবে তা সমূহ সর্বনাশের কারণ। তা আমি আগে আলোচনা করেছি। এখন দেখবো কিভাবে ইন্দ্রিয় পরিচালনা করা উচিত। 
গীতার সাংখ্যযোগের ৫৮নং শ্লোকে বলা হয়েছে, "যদা সংহরতে চায়ং কূর্মোহঙ্গানীব সর্বশঃ।ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেভ্যস্তস্য প্রঞ্জা প্রতিষ্ঠিতা।।"
এর অর্থ করলে দাঁড়ায়, কুর্ম যেমন তার অঙ্গ সমূহ নিজের কঠিন বহিরাবরণের মধ্যে সঙ্কুচিত করে, তেমনই যে ব্যক্তি তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিকে বিপথে পরিচালনার বিষয় থেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারেন, তাঁরাই প্রকৃত বুদ্ধিমান এবং প্রজ্ঞা লাভ করেন।
কচ্ছপ নিজের অঙ্গ সমূহ যেমন গুটিয়ে নেয়, তদ্রূপ ইন্দ্রিয়গুলিকে লোভ লালসার বিষয় থেকে গুটিয়ে নিতে হবে। এমনি সাধারণ অবস্থায় কচ্ছপ নিজের সব অঙ্গকে অবাধে চলতে দেয়, কিন্তু যেখানে ভয় আছে তাদের গুটিয়ে নেয়। সেভাবে যেখানে ভয় আছে সেখান থেকে নিজের ইন্দ্রিয়সমূহকে গুটিয়ে নাও। যেখানে কল্যাণের কাজে আসবে সেখানে তাদের স্বাধীনভাবে ছেড়ে দাও। এ অত্যন্ত সহজ ব্যাপার। ভয় থাকলে পিছিয়ে এসো। ভয় নেই তো অবাধে ছেড়ে দাও। এ পথ সহজ এবং সোজা। পশুও বুঝতে পারে। তাই কচ্ছপের উদাহরণ। কচ্ছপের মতো জন্তু যদি এভাবে চলতে পারে, আমরা মানুষ পারবো না? কিন্তু আমাদের মতো মানুষের কাছে কঠিন লাগে।কথাটা মুলত অভ্যাসের। একদম শুরু থেকে ছোটোদের  যদি এ অভ্যাস হয়, তবে পরবর্তী জীবনে তা কোনো সমস্যার সৃষ্টি করে না। স্বভাবধর্মে শিশুর রুচি সুন্দর। আমরা জোরজবরদস্তি করে তার জিভে আজেবাজে রুচি উৎপন্ন করি। তার রুচি বিকৃত ও কৃত্রিম করে দেই। ছোটোদের যা তাদের পক্ষে স্বভাবিক তাই আমাদের করতে হবে। কিন্তু কুশিক্ষা দিয়ে আমরা তাদের রুচি বিকৃত করে দেই। তাই পরে উল্টো শিক্ষা দিয়ে তা ঠিক করতে হয়। কুশিক্ষা দিয়ে ইন্দ্রিয়গুলিকে দুষ্ট বানালে, পরে তাদের সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। শুরু থেকে যদি ভালো অভ্যাসে তারা অভ্যস্ত হয়, তবে ইন্দ্রিয় সংযম সহজ হবে।এইজন্য প্রকৃত জ্ঞানীরা বলেন, আমার ইন্দ্রিয়ের স্বভাব এমন হয়েছে যে, যা দেখতে নেই সেদিকে চোখ যায় না। যা শুনতে নেই কান তা শোনে না। এ কোনো কঠিন বিষয়ও নয়। যদি কোথাও আগুন থাকে সেখানে কি হাত যায়? আগুনে যদি হাত দেওয়ার বিশেষ প্রয়োজন পড়ে, তবে তা বিচার বুদ্ধি খাটিয়ে তবে হাত দিতে হয়। সেভাবে আমি যদি মনে করি এখানে ভয় আছে, সেখানে ইন্দ্রিয় যাবেই না। ভয়ের জায়গায় ইন্দ্রিয়গুলিকে লাগামহীন কেউ ছেড়ে দেয় না। কিন্তু কুশিক্ষা তাই করে। তখন যা কঠিন ও অস্বাভাবিক তাই সহজ মনে হয়। সমাজের বা মানুষ যখন স্বাভাবিক থাকে তখন ইন্দ্রিয় জয় কঠিন মনে হয় না।

কিন্তু ইন্দ্রিয় সংযম ও ইন্দ্রিয়-নিগ্রহ, এরূপ দুই প্রকার ইন্দ্রিয়-সংযমের কথা বলা হয়। ইন্দ্রিয় নিগ্রহ কিছু সময়ের জন্য। আর ইন্দ্রিয় সংযম সারাজীবনের জন্য। ধরুন, মিষ্টি খাওয়ার দিকে আমাদের ঝোঁক। মিষ্টি খাওয়া খারাপ কিছু নয়। কিন্তু মিষ্টির লোভ খারাপ। তাই প্রয়োজন পড়লে মিষ্টি খাওয়া কিছুদিন বন্ধ রাখতে হয়। তারজন্য নিজেকে সংশোধন করতে, অভ্যস্ত করতে হয়। এই ইন্দ্রিয়কে দমন করার জন্য, তাকে বশে আনতে কিছুকাল আমাদের ইন্দ্রিয়কে নিগ্রহ করতে হয়। মিষ্টি খাওয়া পাপ নয়, স্বাস্থ্যের প্রয়োজনে মিষ্টির দরকারও আছে। কিন্ত মিষ্টির লোভ বশে আনার জন্য ইন্দ্রিয়কে শাসন করতে হবে। সেই সময় শেষে রোগ ভালো হয়ে গেলে পুনরায় আমি মিষ্টি খেতে পারি। কিন্তু পরিমিতরূপে মেপে-জুকে। এরই নাম সংযম। সেইরূপ মৌনতা ও কিছু সময়ের সাধন। মিত-ভাষণ প্রত্যেকদিনের সাধন। নিয়মিত ও পরিমিত আহার রোজের সাধনা। আর এখানেই মানুষের পরীক্ষা। একটি গুজরাটি প্রবাদ আছে,"মানসানী পরীক্ষা খাটলে না পাটলে।" এখানে খাটলে মানে খাটের উপর অর্থাৎ রোগশয্যায়। আর পাটলে মানে পাটের উপর অর্থাৎ আহারের আসনে। আহার বা অসুখে পড়লে মানুষের সকল দোষ প্রকাশ পায়।কখনও বা অতিরিক্ত খায়, কখনও উপবাস। পরিমিত আহারে শরীর ভালো থাকে। কিন্তু অনেকে আবার সন্তুষ্ট হয় না। তারা অসংযমী। আর ইন্দ্রিয়কে বশ করে রাখার নাম সংযম। তারজন্য কখনো কখনো ইন্দ্রিয়কে শাসন করতে হয়। একে বলে ইন্দ্রিয় নিগ্রহ।কিন্তু তা যেন রোজের কর্ম না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখা দরকার।

নিগ্রহ সাময়িক, আর সংযম জীবনভোর। আবার একটু চিন্তা করলে দেখা যাবে যে সংযমের মতো নিগ্রহও প্রতিদিনের ব্যাপার হতে পারে। আমরা জানি উপবাস মাঝেসাঝে আর মিতাহার প্রত্যেকদিন। ধরুন কেউ নিয়ম করেছে দুপুর বারোটায় ভাত খাবে। তাকে যদি এর আগে বা পরে দেওয়া হয়, সে খাবে না। এর নাম নিগ্রহ। এ ব্যাপারটাও স্পষ্ট যে সাময়িক নয় বলে একে প্রত্যেকদিনের বলতে হবে। মৌনতা সম্বন্ধে একই কথা। কেউ কিছু বলছে, সে কথার উত্তর না দিয়ে বলার আগ্রহ অনেক সময় চেপে যেতে হয়। মানে দাঁড়ালো, নিগ্রহ এবং সংযম প্রত্যেকদিনের অভ্যাস। এ দুইয়ের মধ্যে যে পার্থক্য করা হয়, সে কেবল তারতম্যের কারণে। আসলে দুই-ই মূলত এক।নিগ্রহ শব্দের সঙ্গে দমন-পীড়ন যোগ আছে মনে হতে পারে। তা কিন্তু একেবারে নয়। এরমধ্যে জোরজবরদস্তির প্রশ্ন-ই ওঠে না।
যাদের এই আত্মসংযম আছে, তারা প্রকৃত বুদ্ধিমান এবং তারাই বুদ্ধিজীবী।  সাধারণত বুদ্ধিজীবীর কাজ--সমাজে-সংস্কৃতি-জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে ক্ষমতাসীন দলের জনস্বার্থ বিরোধী কর্মকাণ্ডের গঠনমূলক সমালোচনা করা। জাতীয় সংকট চিহ্নিত করে তা মোকাবিলার পথ বাতলে দেওয়া। একই সঙ্গে নাগরিকদের স্ব-স্ব অধিকার ভোগের লক্ষ্যে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধও করা। কিন্তু দেশের বুদ্ধিজীবী, বিশেষত যারা পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করেন তাঁদের কর্মকাণ্ডের দিকে তাকালে এসব কিছুই দেখা যায় না।পরিবর্তে দেখা যায় ভাঁড়ামি আর তোষামোদির দৌরাত্ম্য। অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী ও প্রতিবেদন লেখক হয় ক্ষমতাসীনদের তোষামদিতে ব্যস্ত, নয়তো নিন্দায় সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। তাদের বেশীর ভাগ লেখায় ক্ষমতাসীন কি বিরোধী দলের,কারোর প্রতি কোনো গঠনমূলক সমালোচনা পাওয়া যায় না। পরামর্শ ও না।

বর্তমানে করোনা নিয়ে, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের লুকোচুরি, ধর্ষণ ও অসামাজিক কাজকর্মে দেশ যখন নাজেহাল, তখন কি বুদ্ধিজীবীদের উচিত নয় প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা? কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের সে ভূমিকা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব যেখানে শাসকগোষ্ঠীর ভুল ধরিয়ে দেওয়া, ভাঁড়ের কাজ সেখানে মনোরঞ্জন করা। এই প্রবণতা অনেকদিন থেকে চলে আসছে। উভয়ের চিন্তা -বুদ্ধি-জ্ঞান কিংবা চাতুর্য তোষামোদিই তাদের স্ব-স্ব আসন ও অবস্থান নির্ধারণ করে দেয়। যাঁরা প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর কাজ করেন, তাঁরা শাসকদলের রোষানলে পড়েন। আর ভাঁড়দের জন্য বরাদ্দ থাকে পদ-পদবি ও পুরষ্কার। এক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীরা শাসকশ্রেণীর চক্ষুশূলের কারণ হলেও জনগণের বন্ধুতে পরিণত হয়। কারণ তাদের সংকল্প। কারণ সংকলের থেকে শক্তিশালী, এই পৃথিবীতে আর কিছু নেই। 

একবার এক শিক্ষককে একজন ছাত্র জিজ্ঞেস করলো, স্যার এই পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিশালী পাহাড়। তারচেয়ে শক্তিশালী কেউ আছে। শিক্ষক বললো পাহাড়ের চাইতেও শক্তিশালী লোহা। কারণ লোহার কোদাল দিয়ে পাহাড় কাটা হয়। আবার লোহাকে আগুন গলিয়ে দেয়। আগুন লোহার থেকেও শক্তিশালী। আগুনকে জল নিভিয়ে দয়। আগুনের চাইতে জল বেশি শক্তিশালী। তখন ছাত্র বললো, জলের সব থেকে বেশি শক্তি? শিক্ষক বললো, তা-ও না। জলকে শুষে নেয় সূর্য। তাই জলের থেকে বেশি বলবান সুর্য। সেই সূর্যকে আবার মেঘ ঢেকে দেয়। মেঘ উড়িয়ে নিয়ে যায় বাতাস। ছাত্র বললো,তাহলে বোঝা গেল সবচেয়ে শক্তিশালী বাতাস। শিক্ষক ঘাড় নেড়ে বললো,তা-ও না। সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষের সংকল্প। 

কারণ, মানুষ পারে পাহাড় কেটে রাস্তা বানাতে। লোহা গলিয়ে প্রয়োজনীয় দ্রব্য বানাতে। আগুনকেও নিয়ন্ত্রণ করে মানুষ। বায়ু ও জলের গতিপথও পরিবর্তন করে দেয়। আর তা পারে মানুষ নিজের সংকল্প শক্তির জন্য। তাই মানুষের সংকল্প শক্তির থেকে আর বড়ো কিছু নেই। তাই যাদের সংকল্প মানুষের কিংবা দেশের ভালো করার, তারা শত সহস্র ভয় দেখালেও মাথা নত করে না। তাঁরাই প্রকৃত বুদ্ধিজীবী।
-----------------
আরও পড়ুন। ক্লিক করুন। 

ফ্রেডরিক নীটশে। 
শ্রদ্ধা ও স্মরণে সন্দীপ কাঞ্জিলাল।

Post a Comment

0 Comments