জ্বলদর্চি

আধুনিক ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান-৩/ অনিন্দ্যসুন্দর পাল

আধুনিক ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান
(Ancient India, History & Science)   

অ নি ন্দ্য সু ন্দ র  পা ল

অলংকরণ- শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য          

তৃতীয় পর্ব

"ইতিহাস ও সাহিত্য পারস্পরিক ধারণা"

পূর্বের দুই পর্বের আলোচনা থেকে এটুকু জ্ঞাতব্য হয়েছে যে ভারতবর্ষে ইতিহাস সম্পর্কিত ধারণার পরিবর্তনের মূলে  যতটা ঔপনিবেশিক শিক্ষাক্রমের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য, ঠিক ততটাই সংগৃহিত তথ্যের যাচাই এবং বিশ্লেষণ ও যুক্তি-প্রতিযুক্তির পারম্পর্যের বাধ্যতামূলক বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একজন ঐতিহাসিক যেভাবে প্রত্ন-রক্ষণশালা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে সেগুলিকে নিস্পৃহ এবং নৈর্ব্যক্তিক অবস্থানে নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখে বিচার বিশ্লেষণ ও যুক্তির মাধ্যমে ইতিহাসরূপী আখ্যানটি নির্মাণ করতে সচেষ্ট হন সেটা এককথায় শুধু "ইতিহাস" বললে ভুল হবে, এটি একপ্রকার "ধ্যান বা সাধনা" বলা চলে। 

       কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ইতিহাস কি তবে স্বাধীন নয়? ইতিহাস কি কেবলই এভিডেন্স বা ক্রীতদাসীমূলক সূত্র নাকি বিশেষভাবে ব্যক্তি-চৈতন্যের প্রভাবাধীন অথবা অ-নিশ্চয়াত্মক? এরপরও আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই- যা তথাকথিত, যা লিখিত বা যা আজ-অব্দি সংগৃহীত আছে, সেগুলোকেই কি অন্ধের মতো অনুধাবন করতে হবে নাকি ঐতিহাসিকগণ নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, মনন ও মর্জি বিশেষভাবে ক্রিয়াশীল রেখে সেই সংগৃহীত তথ্যগুলিকে নির্বাচন, বিশ্লেষণ ও পারম্পর্যে সুবিন্যস্ত করে নিজের ইচ্ছেমতো গ্রহণ বা বর্জন করতে পারেন বা পারবেন? এই সমস্ত প্রশ্নের নির্ণায়ক হয়ত ইতিহাসবিদ্ এলটন, E.H.Carr, ইতিহাস নির্মাতা রাজকুমার চক্রবর্তীর মতো প্রভূত ব্যক্তিরাই। 

           প্রসঙ্গত, ইতিহাসবিদ্ এলটনের অভিমত যেমন-
 "একজন ঐতিহাসিক 'এভিডেন্স' বা তথ্যসূত্রের ক্রীতদাসমাত্র।"

পুনরায় সেই সঙ্গে কিছু বিপরীত মতাবলম্বীদের ভিন্ন ভিন্ন বিপরীত মতও উল্লেখযোগ্য। তাঁদের মধ্যে যেমন বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য: 'What Is History' বিখ্যাত গ্রন্থটির রচয়িতা E.H.Caar। যেখানে তিনি ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকদের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ টেনে বিশ্লেষণ করেছেন এইরূপে যে- 

"কোন তথ্যটিকে ঐতিহাসিক গ্রহণ করবেন বা কোন তথ্যটিকে বর্জন করা দরকার- সম্পূর্ণ তা তাঁর নিজস্ব চিন্তা-ভাবনার উপর নির্ভরশীল। এমনকী যে তথ্যগত বা তাত্ত্বিক প্রস্থানে তিনি উন্নীত হতে চান, তাও তাঁর নিজস্ব অভিমত বা সিদ্ধান্ত।"

 আবার আলজেরিয়ান ফ্রেঞ্চ ফিলসফার  "Jacques Derrida"-এর মতামতও বাদ পড়েনি, তাঁর মতে-- 

"ভাষা যেহেতু বহির্বাস্তবের পূর্ণ প্রতিফলন ঘটাতে সমর্থ নয়, তাই ইতিহাসের আখ্যানেও সম্ভাব্যতা স্থান করে নেওয়ার পাশাপাশি এইদুটির সংযোগস্থলেই ইতিহাস ও সাহিত্যের যোগসূত্র স্থাপিত হয়।"

প্রসঙ্গক্রমে, এক্ষেত্রে রাজকুমার চক্রবর্তীর একটি বক্তব্যও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে, সেটি হলো--

"ফলত 'ফ্যাক্ট' ও 'ফিকশন' দুটোই তো ভাষা দিয়ে নির্মিত কোনো ঘটনা, বাস্তবের প্রতিফলন বা প্রতিরূপ নয়। তাছাড়া যদি মেনে নেওয়া হয়, তথ্যসূত্র হল একদা বাস্তবের বিশ্বস্ত বা নির্ভরযোগ্য কিছু চিহ্ন, কিন্তু তা তো ইতিহাস নয়, ইতিহাস রচনার অন্যতম কাঁচামাল। ইতিহাস হয়ে উঠতে গেলে তাকে অন্যতর কিছু প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। রোলাঁ বার্ত বা হেডেন হোয়াইট বলবেন, তথ্যসূত্রগুলিকে ইতিহাস বা ইতিহাস-বিদ্যায় রূপান্তরিত করার সময় যে পদ্ধতিগত প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে ঐতিহাসিককে যেতে হয়, তা একজন কবি ঔপ্যনাসিক অর্থাৎ সাহিত্যকারের চেয়ে স্বতন্ত্র কিছু নয়।"

 এথেকেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে  উত্তর-আধুনিক তত্ত্ববিদদের ভাষ্যে লিখিত ইতিহাস ও সাহিত্যের মধ্যে সে অর্থে যেমন কোনো আক্ষরিক প্রভেদ নেই, ঠিক তেমনই আবার বিষয় প্রতিস্থাপনের এক বিশেষ মাধ্যম কিন্তু এই অর্থগ্রাহ্য আখ্যান, যার একটি নিজস্ব বা বিকল্প কোনো স্বর, নির্মাণ- পুনর্নির্মাণ অভিপ্রায় এবং জ্ঞাপন ও গোপন- প্রক্রিয়ক সমান্তরালতা, থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে বলে ধরে নেওয়া হয়।

          উল্লেখ্য এর পাশাপাশি, আমরা বুঝতে পারি ইতিহাস-বিদ্যা আদতে কোনও সম্পূর্ণ জ্ঞান নয়, যার মধ্যে রয়েছে সম্ভাব্যতার যথেষ্ট স্থান, বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন তথ্যগুলোকে একত্রে করে পূর্ণাঙ্গরূপ দেওয়ার প্রজ্ঞা এবং এরই সাথে সমানভাবে বিদ্যমান ঐতিহাসিক ভাষার স্বাধীন ব্যবহার। সুতরাং একজন সাহিত্যিক যেভাবে উপযুক্ত এক বা একাধিক তথ্যকে শাব্দিক অলংকরণে সাহিত্য রচনা করেন ঠিক সেভাবেই ঐতিহাসিক সেই তথ্যগুলোকে সুনির্দিষ্ট বিন্যাসে তাই বিনির্মাণ করেন।
        কিন্তু এর পরও সেই একই প্রশ্ন এসেই যায়-
 সাহিত্য যেখানে স্বাধীন সেখানে ইতিহাস কোথাও না কোথাও গিয়ে একটা পরাধীনতা অনুভব করছে না তো? কারণ এর উত্তর হয়ত একটাই- ঐতিহাসিক তার আখ্যানটিকে যুক্তি ও প্রামাণ্য দ্বারা সিদ্ধ করতে চান। যার ফলে বেশ কিছু ইতিহাস সম্পর্কিত সুনিশ্চিত ও সর্বাত্মক জ্ঞানের ধারণা উপক্ষিত হয়ে যায়। এই ক্রমশ খণ্ডনের প্রয়াসেই তৈরি হতে শুরু করে বিকল্প সূত্র। সেই সূত্রকে নির্ভর করে উপেক্ষিত ও খণ্ডিত বিষয়কে মাথায় রেখে আখ্যানটিকে পরিমার্জিত করার বাধ্যবাধকতায় একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আটকে পড়ে যায় তাঁরা। যার ফলে তাদের যুক্তি ভাবনা বিশ্লেষণ এইসব যেমন রাজ-রাজাদের পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহ, সন্ধি, চুক্তি প্রশাসনিক কার্যপ্রণালীতে আটকে পড়ে, ঠিক তেমনি এই গুলোকে যুক্তি নীতি তর্ক দিয়ে মুক্তি দিতে গিয়ে তার সমস্ত অপরাপর স্তরগুলো মানুষের কাছে অনালোকিত হয়ে যায়। যার ফলাফলস্বরূপ জন্ম নেয় তথ্যসূত্রের প্রতি নিশ্চয় অপারগতা।

      বলাবাহুল্য, ইতিহাস শুধু রাজরাজাদের আলোচ্য বিষয় নয়, সমাজের অবতলবর্তী সম্প্রদায়ের ইতিহাসকেও সংযোজিত করে। কারণ সমাজের বিরাট অংশ জুড়ে যেহেতু তাদের অবস্থান, তা অবশ্যই খণ্ডিত ও অসম্পূর্ণ। সুতরাং একটি বৃহত্তর বা খন্ড-কাল সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জানতে গেলে নিম্নবর্ণের মানুষগুলোর দিকেও চোখ রাখতে হবে। তবে একথা স্বীকার করতেই হবে, সাধারণ মানুষদের নিয়ে তথাকথিত কাহিনী ইতিহাস সাহিত্যের পাতায় স্থান পেয়েছে ঠিকই, তা কিন্তু গণ-জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, সাফল্য-ব্যর্থতা, ও স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গের ব্যাখ্যা বা মানসচোক্ষে সামাজিক নিপীড়িত শোষিত শ্রেনীর বর্বর মানসিকতাকে তুলে ধরার জন্য নয়, এই সংক্রান্ত রচনার পূর্বে কোনো বিশেষ অভিপ্রায় ছিল বলে ধরে নেওয়া হয়, যা কিনা ধৃত দেশ-কালকে নির্ভরযোগ্য রূপ দিতে গিয়ে সাহিত্য অজান্তেই ইতিহাসে বিনির্মিত হয়ে গেছে। প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি এস্থলে আমরা রাখতে পারি- 

        "সমস্ত জনশ্রুতি, লিখিত, অলিখিত, তুচ্ছ   এবং মহৎ, সত্য এবং মিথ্যা - এই পত্রভান্ডারে সংগ্রহ হইতে থাকিবে। যাহা তথ্য হিসাবে মিথ্যা এবং অতিরঞ্জিত যাহা কেবল স্থানীয় বিশ্বাস রূপে প্রচলিত,  তাহার মধ্যেও অনেক ঐতিহাসিক সত্য পাওয়া যায়। কারণ ইতিহাস কেবলমাত্র তথ্যের ইতিহাস নহে, তাহা মানবমনের ইতিহাস, বিশ্বের ইতিহাস।"

তবে, একথা সত্য যে এই উদ্ধৃতি আমাদের ইতিহাস সম্পর্কিত সাধারণ ধারণার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুললেও এমন মন্তব্য শুধু ইতিহাস ও সাহিত্যের মধ্যবর্তী ধৃত দেশ-কাল ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের এক অজ্ঞাত অভিনব অভিপ্রায়কে প্রকাশ করছে, তা নয়,  অন্যদিকে উচ্চ থেকে নিম্ন সর্ব সম্প্রদায়ের ইতিহাস সম্পর্কে সমগ্র জ্ঞান অর্জন তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষিতে একপ্রকার স্বচ্ছতা নির্মাণের ক্ষেত্রে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দাবি রাখছে। তাই হয়ত, গণ-জীবন সংক্রান্ত তথ্য সাহিত্যের কল্পনা, ইতিহাসের অতিরঞ্জকতাকে ছাপিয়ে বারংবার প্রতিষ্ঠিত হতে চায় অন্যতম যুক্তি-সম্পৃক্ত সামাজিক আখ্যানে। যা কিনা ইতিহাস, তাই নাকি সাহিত্য, তাই নির্বিশেষে প্রত্নতত্ত্ব।
--------------------------------
আরও  পড়ুন। ক্লিক করে। 
ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ- এই চতুর্বর্গ লাভের উপায়স্বরূপ উপদেশ যে পুরাবৃত্ত, তাহাকেই আর্যেরা বলতেন ইতিহাস।

Post a Comment

0 Comments