জ্বলদর্চি

ঘোড়াডিহির অন্তর্ধান রহস্য-৯/গৌতম বাড়ই


ঘোড়াডিহির অন্তর্ধান রহস্য

গৌ ত ম  বা ড় ই

পর্ব-৯

মেঘের বাড়ি ঢুকতে ঢুকতেই রাত সাড়ে নটা হয়ে গেলো।
মেজবৌদি বললেন বেরুনোর সময়-- সাবধানে যাস ছোটো।যদিও রাত খুব একটা বেশি না তবুও অনেক রাত এখন, বাইরেটা দেখলে তাই মনে হয়। এখনও আতঙ্ক ঘরে ঘরে।মৃত্যু ভাবনায় সবাই চরম এক সঙ্কটে দিন কাটাচ্ছে।রাস্তাঘাট ফাঁকা।ওখানে পৌঁছে একটা খবর দিস।

আচ্ছা মেজবৌদি-- এই বলে বেড়িয়ে পড়ি।সত্যি এই দুঃসময়ে আমরা সবাই প্রিয়জনকে ছুঁয়েই চলতে চাই।মেজবৌদি কেন জানিনা এই বিধ্বস্ত অতিমারি সময়ে পুরো মাতৃস্নেহে আমাকে আগলে রাখতে চায়।

প্রথম চমক রেসিডেন্সীর গেটে। সিকিউরিটি গার্ড ছেলেটি চোখ উজ্বল করে বললো আসুন স্যার  এইসব বললো।আমি আজ বাইকটি কোথায় রাখবো? জিগ্গেস করতেই সে জানিয়ে দিলো-কেন এপার্টমেন্টের পার্কিং-এ।আমি বললাম-রাতে এখানে থাকবো ভাই। সে আবার গদগদ হয়ে বলল-হাঁ,থাকুন না।স্যার আপনার বাইক আমি নজরে রাখবো।আমি অবশ্য অবাক হলাম না,বুঝতেই পারলাম কিছু দাওয়াই পড়েছে থানা থেকে।আমি কমপ্লেক্সের ভেতরে ঢুকে গেলাম।আর পৌঁছে গেলাম বিনা বাধায় ঝগড়া আর কাজিয়া ছাড়া মেঘেদের ঘরে।আমি আজ মনে মনে তৈরী হয়ে এসেছিলাম ঐ দুটো মাতব্বরকে একটু রগড়ে দেওয়ার জন্য।না সব দেখি ঘরের ভেতরে।দু একটা জানলা আমায় খুলে দেখেই আড়াল নিলো।

মেঘকে বললাম কী রে এত সান্নাটা তোদের পাড়ায়?
আরে ভাই ভেতরে এসে বোস রে! তারপর বলছি সব।
মেঘ বলতে শুরু করে- ঘোড়াডিহি থানা থেকে পুলিশ এসেছিল।জানিনা কি বলে গিয়েছে সোসাইটিতে।তবে জানলা দিয়ে দেখলাম সিকিউরিটি গার্ডের সাথে তারপর এখানকার কর্তামশাইদের গেটে ডেকে নিয়ে কী বলে চলে গেল পুলিশের ভ্যান।তার ঠিক আধঘন্টা বাদে তেনারা আমার দরজায় নক করে বলে গেল শুনেছি সব ম্যাডাম।কোন দরকার হলে বলবেন আর আপনার হাজব্যান্ডের মিসিং খবরটা তো একটা চ্যানেলে দেখালো।কী পিরিত মারাইতে আসিলো রে ভাই।

তাহলে তমাল হাম্পু দিয়ে গিয়েছে-আমি বলি।

হ তাইতো দ্যাখতাছি-মেঘ বলে।মেঘ আর সালতামামি মাঝে মাঝেই আমার সাথে আড্ডায় এই এক বাঙাল না দেশীভাষা নিজেদের তৈরী করা দিয়ে কথা বলে।আমার আবার হেভ্বী লাগে।মিলেনিয়াল ল্যাঙ্গুর অনেক স্লাঙ্গও আমরা ব্যবহার করি।ভালো লাগে।আমাদের ভালো লাগে আমরা বলি।

মেঘের চোখের কোলে একটু কালচে বর্ণের ছোঁয়া লেগেছে।মেঘ যতই বলুক আমি জানি আজ সালতার নিরুদ্দেশের পাঁচদিন হলো ওর মনের দুশ্চিন্তা চোখের কোলেও পড়েছে।ও কি আর স্থির হয়ে নিশ্চিত হয়ে রাতে ঘুমোতে পারছে?

অন্য কোন দিন হলে আমরা উষ্ণ পানীয় নিয়ে বসতাম। সালতামামি নিজের কবিতা পাঠ করতো তার দরাজ কন্ঠে,আমিও তাই করতাম আর মেঘ তার সুললিত কন্ঠে রবীন্দ্রনাথের গানে মাতোয়ারা করে দিতো।গানে গল্পে আড্ডায় আর মদিরায় আমরা তিনবন্ধু অভিন্ন হয়ে উঠতাম।এই তো লক ডাউনের আগে মার্চের গোড়ায় আমরা শেষ আড্ডায় মেতে ছিলাম।

এক জায়গায় আজ আগে থেকে খাবার বলে রেখেছিলাম আসবার সময় প্যাক করে নিয়ে আসি।দোকানটি যদিও রাত আটটা বাজতেই বন্ধ হয়ে যায়।লকডাউনের পর এখনও এই আনলক পর্যায়ে লোকজন বাইরের খাবার খাচ্ছেন না।একটা দুটো করে কাস্টমার বাড়ছে তাদের প্রতিদিন।যে দিদিটার ঐ খাবারের দোকান তারও দেখলাম বে-রোজগেরে হয়ে চোখমুখ কত শুকিয়ে গিয়েছে ঐ চিন্তায় চিন্তায়।মেঘকে বলে রেখেছিলাম তুই কিছু করতে যাবি না রাতে ইয়ার।আমায় পেয়ে ও আজ যেন একলা রাতের নীরব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে উজ্বল হয়ে উঠলো।আমি বললাম-তোর চিন্তাটা থাক তবে বেশি দুশ্চিন্তায় নিজেকে ভেতরে ভেতরে ক্ষয় করিস না।

হয় রে হয়!কী করি বল?- মেঘ আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।
কেন আমরা যখন আড্ডায় বসি আর বলি-তুই কিন্তু সালতাকে খুব ভালোবাসিস বল?তুই তখন কী বলিস-ছোড় ইয়ার ওসব ভালোবাসাবাসি কিস্যু হয়না।সব বেকার কী বাত!মনের মতন বন্ধু তাই একসাথেই থাকি।ব্যাস এই!আসলে কী জানিস মানুষের নেচার কিন্তু বহুগামীতা নয় একগামীতা।বন্ধন দেবার চেষ্টা করলে বহুগামিতার দিকে ঝুঁকে পড়ে আর মুক্ত করে দিলে সে একগামীতাই খোঁজে।এই যেমন তুই আমার সাথেও থাকতে পারতিস আবার সালতামামির সাথেও।কী আর হতো? কিন্তু তুই একজনের সাথেই থাকা ঠিক করলি।বল?

কী ব্যপার রে বুদ্ধ?আমায় একলা পেয়ে এইসব বাতচিত উদ্দেশ্যপূর্ণ নয় তো।

তোর যদি এই বিশ্বাসটুকু না থাকে আমি এখুনি কাটবো কিন্তু।
মেঘ বলে-তোর এই গাড়োল রাগ আর ঠুনকো রাগ জীবন ভোর থাকবে।যা ফ্রীজে দুটো বাঁটুল আছে একটা বের করে নিয়ে আয়।আজ দুঃখের দিনেও বাঁটুলের তরলে গলা ভিজিয়ে ভাবি আমাদের কথা।

আমি বললাম আজ তোকে নিয়ে সালতার ডায়েরী পড়বো।সালমার লেখা পেলে তো আমি এমনিতেই গোগ্রাসে গিলি আর এই নিভৃতে রাতের আঁধারে লেখাগুলি একলা পড়তে মন চাইছে না।তোকে নিয়েই পড়বো।তুই শুনবি আমি পড়ে যাবো।

এমন সময় মেঘের মোবাইল বেজে উঠলো।মেঘ মোবাইলের স্ক্রীনে চোখ বুলিয়ে বলে উঠলো-বাবা ফোন করেছে।তোর নিউজটা টিভিতে  দেখানোর পর অনেক ফোন এসেছে আমি ধরিনি।আমি তো টিভি দেখিনি বা দেখিও না এ কদিন ধরে।সোসাইটির লোকজন খবরটা দেওয়ার পর বুঝতে পারলাম হঠাৎ করে কেন এত ফোন এসেছিলো।বাবাকে আমি কলব্যাক করছি।কেটে গেলো।

মেঘ হ্যালো বলে শুরু করলো ওর বাবার সাথে কথা মোবাইলে।

হাঁ।ঠিক খবর-ই পেয়েছো।ঠিকই দেখেছো।আজ পাঁচদিন হলো। চিন্তা করো না।এর আগেও পাগলটা অমন না বলে দু দুবার কোথায় গিয়ে দুদিন কাটিয়ে ফিরে এসেছে।এবারও ফিরে আসবে।

না না এই সময়ে তোমাদের হুট করে আসতে হবে না।আমি সব খবর দিয়ে দেবো।

কদিন দেইনি কারণ কী দরকার তোমাদের মাথায় চাপ দেওয়ার।আমিতো নিজেই কোন দুশ্চিন্তা করছি না।না বুদ্ধ আছে তো!আরে এই  বাজে সময়ে অন্যেরা পাশে না থাকলেও বুদ্ধ একলাই সব সামাল দিচ্ছে।

হাঁ আজ রাতে ও আমাদের ফ্লাটেই থাকবে।

এইসব বলে ছেড়ে দিলো।বলল তারপর-একটা সত্তর বছর বয়সী লোককে এইসব জানিয়ে কী লাভ বল?এই সময়ে।কাল আবার সকালে মা দেখবি কত জ্বালায়!জানিস বয়স যত বাড়ছে ঠিক ততই মা বাবার টানটা তাদের ছেড়ে এসে বেশি করে মনে ধরে। এখনও মায়ের চিন্তাধারা আমল না দিলেও তার সংসারের প্রতি নিজের সর্বস্ব ত্যাগ মনে একটু ব্যথা জাগায়।

আমি বললাম কাল সকালে আরও অজস্র ফোন তোর আর আমার আসবেই বুঝলি।একটা বেশ বড় খবর হবে আমাদের নিউজ পেপারে।

ধ্যাৎ! একটা সপ্তাহ দেখে নিয়ে তারপর এ সব খবর করতি।মেঘ আনমনা হয়ে বলে।আমার জানিস কেন মনে হয় সালতামামি ফিরে আসবেই।ও যদি চিরদিনের জন্য হারিয়ে যেত অন্তত আমাকে একটা শেষ মেসেজ করতোই করতো।

তাই যেন হয় রে মেঘ।আমি বলি।

পানীয়তে গলা ভেজালাম।খাবার খেতে খেতে আজ দুই বন্ধুতেই আড্ডায় বসলাম।ব্যাগের থেকে সালতার ডায়েরীটা বের করে পাশে রাখলাম।

আমার কন্ঠে উঠে এলো মেঘের জন্য কবিতা-

কোনো ব্যথিতাকে

এখন অনেক রাতে বিছানা পেয়েছ।
নরম আঁধার ঘরে
শান্তি নিস্তব্ধতা
এখন ভেবো না কোনো কথা।
এখন শুনো না কোনো স্বর।
রক্তাক্ত হৃদয় মুছে
ঘুমের ভিতর
রজনীগন্ধার মতো মুদে থাকো।

মেঘ বলে ওঠে জীবনানন্দ।দেশ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়।তবে আমি এত তাড়াতাড়ি বিছানায় শুতে যাচ্ছি না।এবারে ডায়েরীটা পড়তে শুরু কর।শুনবো।

ডায়েরীটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকি।দেখি কোথা থেকে পড়া যায়।

আরে এটা কী লিখেছে সালতামামি দেখ।মেঘ হুমড়ি খেয়ে পড়ে বলে- কোথায়? দেখা।

(এর পর পরের পর্বে)

Post a Comment

0 Comments