জ্বলদর্চি

হাজার বছরের বাংলা গান-২২ / তুলসীদাস মাইতি



হাজার বছরের বাংলা গান ।। পর্ব-২২

তু ল সী দা স   মা ই তি

'পঞ্চকবি' পরবর্তী বাংলা গান:
আধুনিক গানের সূচনার ইঙ্গিত

বাংলা গানের জগতে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়কালের গানের যে বৈশিষ্ট্য তাঁর পূর্বসূত্র উনিশ শতকের প্রথমার্ধেই সূচিত হয়েছিল। স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্যে ছিল উজ্জ্বল ছিল পঞ্চকবির গান। এইসব গানের নামও ছিল তাঁদের নামের সাথে যুক্ত। রবীন্দ্রসংগীত, নজরুল গীতি, দ্বিজেন্দ্রগীতি, অতুলপ্রাসাদের গান , রজনীকান্তের গান। পঞ্চকবি ছাড়াও সমকালীন বহু কবি সাহিত্যিক সহ সংগীত রচনা করেছিলেন। ঈশ্বর গুপ্ত, বঙ্কিমচন্দ্র, মধুসূদন, হেমচন্দ্র, বিহারীলাল, গিরিশ ঘোষ প্রমুখ নবজাগরণের যুগে গান রচনা করেছিলেন। এ সমস্ত গানই ছিল পরম্পরার গান। রবীন্দ্রনাথের সময়ে বিবেকানন্দ সহ আরো অনেক গুণীজন সংগীত রচনা ও চর্চা করে বাংলা গানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতার আগেই এই পর্যায়টি অনেকটাই রূপ পরিবর্তন করতে শুরু করেছিল। বাংলায় যাকে 'আধুনিক গান' বলি তার বীজ তৈরি হতে থাকে। নজরুলের পর এই ধারার গান নতুন আঙ্গিকে প্রকাশ লাভ করে। বলাবাহুল্য, এই সময়কাল থেকে গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী পৃথকভাবে তাঁদের প্রকাশ করতে থাকেন। তখন থেকেই বাংলা গানের একটা পৃথক পর্যায় শুরু হয়। এ পর্যায়ের গানের ক্ষেত্রে কয়েকজন সঙ্গীতগুণীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁরা হলেন দিলীপ রায়, ভীষ্মদেব চট‍্যোপাধ্যায়, হিমাংশু দত্ত, শচীনদেব বর্মন, পঙ্কজকুমার মল্লিক, জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী প্রমুখ। গীতিকারের মধ্যে অজয় ভট্টাচার্য ও সুবোধ পুরকায়স্থ, হেমন্ত গুপ্ত শৈলেন রায় প্রমুখের নাম উঠে আসে। উনিশ শতকের তিনের দশক থেকেই এই পর্বটির সূচনা হয়েছিল বলে পণ্ডিতগণ মনে করে থাকেন।

 বাংলা গানে  দিলীপ রায়ের অবদান অনেক। তিনি যত বড়ো গায়ক ও সুরকার অর্থাৎ সংগীতস্রষ্টা ততো বড়োই একজন 'চিন্তাবিদও সংস্কৃতিনায়ক'। তিনি ছিলেন "আমাদের দেশের একজন অগ্রগণ্য বেসরকারি সাংস্কৃতিক দূত, যিনি বিশ্বের সঙ্গে এদেশের ভাবের আদান-প্রদানের এক প্রধান মাধ্যম রূপে কাজ করে গেছেন আজীবন। পাশ্চাত্য ভূভাগ ও ভারতের মধ্যে তিনি ছিলেন সংস্কৃতির যোজক সেতু স্বরূপ"। তাঁর কথা বলার আগে একটা কথা বলা জরুরি। নতুন বাংলা গানের আঙ্গিকের সূচনা যাই হোক, রবীন্দ্রসংগীত ও নজরুলগীতি জনপ্রিয়তা কখনোই কমে যায়নি। বরং তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিসরেই আধুনিক গানের জগতে এলেন দিলীপ রায় ও ভীষ্মদেব চট্যোপাধ্যায়। দিলীপ রায়ের গানে আধুনিকতার চরিত্র থাকলেও তিনি নজরুলের মতোই বিদেশি গানের সুরে বাংলা গানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে করে গেছেন। কোনো কোনো সমালোচক তাঁকে গায়ক অপেক্ষা সুরকার হিসেবেই এগিয়ে রাখেন। তাঁর সুর-সংযোজনার অভিনবত্ব বাংলা গানের নব দিকের সূচনাকে ত্বরান্বিত করেছিল বলাই যায়। পিতা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা কোরাস গানগুলিকে একালের সমবেত গানের মতো   'উপযোগী ও স্বরক্ষেপ অনুযায়ী' জোরালো ভাবে গাওয়ার  নতুন রীতির প্রবর্তন করেন। আর নানা দেশের সংগীতরীতির সুরভঙ্গিকে বাংলা গানে ব্যবহার করার ক্ষেত্রেও তিনি ভূমিকা নেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর 'বুলবুল মনফুল সুরে ভেসে (রুশ লোক সংগীত), 'চাঁদের হাসি বাজলো আকাশ ছেয়ে' (ফরাসি সুর), 'ঘুম যাই মা, আজ ঘুম যাই'(জার্মান সুর), তোমারি পানে অকুল টানে'(ইতালীয় সুর), মধুর স্বরে শয়নে স্বপনে (জিপসি সুর), 'অকূলে সদাই চল ভাই ছুটে যাই'(ইংরাজি সুর) গানগুলির কথা উঠে আসে। বিখ্যাত মার্কিন হয় পল রবসনের  গানের অনুসরণেও তিনি গান সৃষ্টি করেছেন। বিচিত্র বিদেশী সংগীতের ও ভঙ্গি অনুসরণ করে তাঁর সুর অনুসন্ধান বাংলা গানের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর মাধ্যমে বিদেশি সুরগুলি বাংলা গানের জগতে চলাচল করতে পেরেছিল। 'অনামী','ত্রিবেণী' 'সুরবিহার' নামে কয়েকটি সংগীত গ্রন্থও তিনি রচনা করেছেন। তাঁর 'সাঙ্গীতিকী' নামক সংগীত গ্রন্থটি একটি উল্লেখযোগ্য নির্মাণ।

ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় বাংলা রাগপ্রধান গানের উঠোনে একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। সমসময়ের গানের ক্ষেত্রে  উৎকৃষ্টতর মাত্রার সংগীতে তারাপদ চক্রবর্তী, জ্ঞান গোস্বামীদের সঙ্গে তিনিও বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। প্রকৃত অর্থে, পরবর্তী যাবতীয় রাগপ্রধান বাংলাগান, আধুনিক গান, ছায়াছবির গান ইত্যাদি এই বীজ থেকেই উদ্ভব হয়েছিল। বাংলা গানের ভীষ্মদেব সুরের জাদুকর ছিলেন। বাল্য ও কৈশোর কালে তিনি নগেন্দ্রনাথ দত্ত ও  পরিণত বয়সে ওস্তাদ বাদল খাঁ সাহেবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। কণ্ঠের সম্পদে ও স্বরের মিষ্টত্বে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। আধুনিক গানের প্রবর্তনার যুগে তার সুরবিস্তার, স্বরগমের অনবদ্য প্রয়োগ, বোলতানের নতুন নতুন সংযোজনায় তিনি ছিলেন অনন্য। তিনি যতটাই ভালো গায়ক ততখানিই  বড়ো সুরস্রষ্টা। তিনি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যকে গানে অপূর্ব মুন্সিয়ানায় পরিবেশন করতে পেরেছিলেন। চড়া স্কেলে বেঁধে তিনি গান গাইতেন। টপ্পা, ঠুমরি খেয়াল সবেতেই দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছিলেন। তাঁর চৌদ্দ বছর বয়সের দুটি টপ্পা অঙ্গের গান গ্রামোফোন কোম্পানির রেকর্ডে শুনতে পাওয়া যায়। তিনি দ্রুত লয়ের গান গাইতে ভালোবাসতেন।  এক্ষেত্রে তিনি শ্রোতাকে তাকে লাগিয়ে দিতেন। বাহার, সুহা, সুঘরাই, বসন্ততিলক, আড়ানা প্রভৃতি  উল্লাসপ্রবণ রাগে তিনি ছিলেন স্বচ্ছন্দ। তাছাড়া উত্তরাঙ্গ রাগগুলির প্রতি বেশি টান ছিল। পূর্বঙ্গ রাগের দিকে এটা কমও যেতেন। জনপ্রিয় সংগীতগুলির মধ্যে ফুলের দিন হলো যে অবসান (জয়জয়ন্তী), তবে লাগি ব্যাথা ওঠে গো( দেশি টোড়ি),আলোক লগনে(রামকেলী), 'নবারুণ রাগে তুমি সাথী গো' (ভৈরবী) প্রভৃতি উলেখযোগ্য। গানগুলি গ্রামোফোন কোম্পানিতে রেকর্ডিং হয়েছে।
বাংলা গানের জগতে হিমাংশুকুমার দত্ত এক উল্লেখযোগ্য নাম। তিনি সুরসাগর উপাধি পেয়েছিলেন অল্প বয়সেই। আধুনিক গানের সুরকার হিসেবে তিনি এমনই সব অবদান রেখে‌ গেছেন‌। বাংলা গানের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বৃহৎ সংগীতস্রষ্টা ছিলেন কিন্তু সঙ্গীত রচনা করেননি। গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য ও সুবোধ পুরকায়স্থ, শৈলেন রায়, হেমন্ত গুপ্ত প্রমুখের রচিত গানে সুরারোপ করেছেন। তাঁর 'যদি ভুলে যাবে মোরে' (অজয় ভট্টাচার্য) অলখে যে ব্যথা রহে/, আঁখিতে সে হয় বারি' (অজয় ভট্টাচার্য), যে গান হারিয়ে গেছে কবে' হেমন্ত গুপ্ত), বেদনার মাঝে তোমারে খুঁজিয়া পাই (শৈলেন রায়), তব স্মরণখানি ওগো আমার প্রাণে / 'আজি বাজায় বীণা মৃদু করুণ তানে' (সুবোধ  পুরকায়স্থ)  প্রভৃতি গানগুলি বাংলা গানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে।
বিষ্ণুপুর ঘরানার বিখ্যাত সংগীতশিল্পী রাধিকা প্রাসাদ গোস্বামীর পরিবারের উত্তরসূরী জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী বাংলাগানের এক বিশেষ ঘরানা। বাবা জগৎচাঁদ গোস্বামী ছিলেন একজন বড়ো পাখোয়াজ শিল্পী। ছোটো থেকেই উচ্চাঙ্গ সংগীতের প্রতি তাঁর অগাধ টান ছিল সঙ্গে বিচিত্র মাত্রার বাংলা গান তিনি চর্চা করেছেন। গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে তার বহু প্রকার গানের রেকর্ড হয়। রবীন্দ্রনাথের 'অল্প লইয়া থাকি' ও 'বিমল আনন্দে জাগো' - গানগুলি তাঁর গলায় মাত্রা পেয়েছে। তিনি নজরুলের গানও বহু গেয়েছেন। শূন্য এ বুক পাখি মোর আয় ফিরে আয় গানটি চমক প্রদ। তাঁর গান সম্পর্কে দিলীপ রায় বলেছিলেন- "জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদের গানের সবচেয়ে বড় সম্পদ ছিল তার ওজস। - জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদের অলোকসামান্য গীতপ্রতিভা ও ওজঃশক্তি শ্রোতার মনকে পুলকিত করে তুলত মুহূর্তে। গান শুরু করার আগে উদাত্ত কণ্ঠে তিনি যখন ‘সা’তে দাঁড়াতেন, তখন মনে শিহরণ জাগত সত্যিই।" জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদের নানা প্রকার শাস্ত্রীয় ও লঘু শাস্ত্রীয় গান বাঙলা গানকে অনেকখানি সমৃদ্ধ করেছে। 

তারাপদ চক্রবর্তী (১৯০৯-১৯৭৫) বাংলায় টপ্পা ও ঠুমরি গানের অন্যতম প্রবর্তক। পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ সবাই সংগীত গুণী ছিলেন। অল্প বয়সেই কলকাতা বেতারের সাথে যুক্ত হয়ে তবলা বাদকের চাকরি নেন। পরে কণ্ঠ সংগীতে ক্রমশ উচ্চাঙ্গের শিল্পী হিসাবে সুখ্যাতি অর্জন করেন। তারাপদ বিভিন্ন সময়ে ওস্তাদ এনায়েত খাঁ, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ হাফিজ আলী খাঁ প্রমুখ সঙ্গীত গুণীদের সান্নিধ্য লাভ করেন ।  তাঁদের তবলা সঙ্গত করেন। তাঁর সংগীত গুণের স্বীকৃতিস্বরূপ  তিনি বিভিন্ন উপাধি লাভ করেন। সেগুলি হল সঙ্গীতাচার্য, সঙ্গীতার্ণব, সঙ্গীতরত্নাকর প্রভৃতি। ১৯৭৩ সালে ভারত সরকার প্রদত্ত পদ্মশ্রী সম্মান লাভ করেন। সুরর্তীর্থ নামের একটি সংগীতগ্রন্থও তিনি রচনা করেন। তাঁর, 'বনে বনে পাপিয়া', 'ফুলে ফুলে কি কথা,' প্রভৃতি গানগুলি বাংলা গানের ভাণ্ডারকে যেমন  সমৃদ্ধ করেছে তেমনি তাঁরই দেখানো পথটি পরবর্তী শিল্পীরা গ্রহণ করে বাংলা গানেরই পর্যাদা বৃদ্ধি করেছে।
(চলবে)

Post a Comment

1 Comments

  1. খুব ভালো লাগল। চালিয়ে যাও বন্ধু।

    ReplyDelete