জ্বলদর্চি

অসুর বধের কাহিনী / কালীপদ চক্রবর্ত্তী

অলংকরণ - সুদেষ্ণা রায়চৌধুরী    

শারদ উৎসব

পর্ব – ২

কা লী প দ  চ ক্র ব র্ত্তী 
 
অসুর বধের কাহিনী

দেবীদুর্গা সতী নামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন দক্ষরাজের কণ্যা হয়ে। পিতার বাধা উপেক্ষা করেই শিবকে পতিরূপে বরণ করেন। দক্ষরাজ তাঁর প্রাসাদে (বর্তমানের হরিদ্বারের কঙ্খল-এ) এক যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন এবং এই যজ্ঞ, দক্ষযজ্ঞ নামে আজও প্রসিদ্ধ। এই যজ্ঞে দক্ষরাজ শিবকে নিমন্ত্রণ না জানানোতে সতী লজ্জায় এবং পতির অপমানে সেখানেই দেহত্যাগ করেন। এতে শিব ক্রোধে পাগল প্রায় হয়ে স্ত্রী সতীর মৃতদেহ কাঁধে তুলে নিয়ে তান্ডব নৃত্য শুরু করেন। তান্ডব নৃত্য এওতি ভয়াবহ ছিল যে, পৃথিবী ধ্বংসের দিকে চলে যায়।

দেবতারা নারায়ণের শরণাপন্ন হলে নারায়ণ তাঁর সুদর্শণ চক্রদিয়ে সতীর শরীর টুকরো টুকরো করে ফেলেন। আর এই টুকরোগূলো নানাস্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে। টুকরোগুলো যেখানে যেখানে পড়েছে সেখানে পীঠস্থান হয়েছে। নারায়নের অনুগ্রহে হিমালয়ের গৃহে মেনকার গর্ভে জন্ম নেন সতী, উমা নামে। নবজীবন প্রাপ্ত উমা হন দুর্গা। নবজীবন লাভের পর উমা, স্বামী শিবের সাথে কৈলাসে গমন করেন। এদিকে রাজা দক্ষ্য তার নিজের ভুল বুঝতে পেরে জামাতা শিবের কাছে ক্ষমা প্রার্থণা করেন। তখন থেকেই উমা  অর্থাৎ দুর্গা তাঁর চার সন্তান কার্ত্তিক, গনেশ, লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে নিয়ে প্রতিবছর পিতৃগৃহে বেড়াতে আসেন। ধরাধামে পূজিত দুর্গার এটিই রূপ। বসন্তকালে বাসন্তী পূজাই মূলত দুর্গাপূজা। শরৎকালে শ্রীরামচন্দ্র, লঙ্কাধিপতি রাক্ষসরাজ রাবণকে বধ করার জন্য অকাল বোধন করেছিলেন শরৎকালে। সেই থেকেই শারদীয় পূজাই প্রধাণ পূজা হিসেবে প্রচলিত হয়ে আসছে। তাই এর অপর নাম অকাল বোধন বা শারদোৎসব।

দেবীদুর্গার অসুর বধের কাহিনীটি অনেক বাস্তবতা সম্পন্ন। কথিত আছে যে, দীর্ঘ আরাধনার পর মহিষাসুর ( রম্ভাসুর-এর পুত্র) নামে এক অসুর, শিবের আনুকূল্য অর্জ্জনে সমর্থ হয়। শিব তার ওপর সন্তুষ্ট হয়ে তাকে অমরত্মের বর দেন। অর্থাৎ কোনো মানুষ বা দেবতা মহিষাসুরকে হত্যা করতে পারবেনা। বরপ্রাপ্ত হয়ে মহিষাসুর ধরাকে সরাজ্ঞান করতে শুরু করে। তার অত্যাচার ও নির্য্যাতনে স্বর্গ থেকে দেব-দেবীরাও বিতাড়িত হন। এইরকম অবস্থায় দেবতারা পরিত্রাণের জন্য শিবের দ্বারস্থ হন। শিব এসব ঘটনা শুনে ক্রোধে ফেটে পড়েন এবং তখন শিবের তৃতীয় নেত্র থেকে এক অলৌকিক শক্তির তেজদ্বারা নারীর অবয়ব তৈরী হয়। সেই সময় অন্যান্য উপস্থিত দেবতারাও তাঁদের নিজস্ব শক্তির কিছু অংশ সেই নারীকে দান করেন। এইভাবে চিরন্তন মা দেবী দুর্গার জন্ম হয়। দুর্গাদেবীর বাহন হয় সিংহ । দশহাতে অস্ত্রধারণ করে সিংহের পিঠে চড়ে তিনি মহিষাযুরকে আক্রমণ করেন এবং বধ করেন। এই কাহিনীটি সংক্ষিপ্ত হলেও এর তাৎপর্য্য অনেক। আমাদের রাষ্ট্রীয় সমাজ জীবনে নিরন্তর অসুর জন্ম নিচ্ছে। আসুরিক শক্তির দাপটে মনবতা বিপন্ন হয়। মানবতা বিপন্নের মূল কারণ মানুষের ভেতরের রিপুগুলোর আস্ফালন। লোভ, হিংসা, ঘৃণা, অহঙ্কার ইত্যাদির কারণে মানুষ তার মানবিক গুণাবলী হারিয়ে পশুতে রূপান্তরিত হয়। তখনই দুর্গতিনাশিনী দুর্গার আগমনের বড় প্রয়োজন দেখা যায়। । মানুষ চায় শান্তি ও সংহতি। সব ধর্মেরই আহ্বান হল শান্তি, শান্তি, শান্তি।

মা দুর্গাকে কখনো দেখি ভীষণ, কখনো দেখি করুণাময়ী জননী রূপে। সকলকে তিনি রক্ষা করেন। কখনো শাষণের সুরে, আবার কখনো বা স্নেহমাখা মমতায়। শক্তির প্রতীক দুর্গাপূজা মূলত মাতৃপূজা। মাতৃপূজায় মা ও সন্তানের মধ্যে এক মমত্বভাব প্রকাশ পায়। মাতৃভাবাশক্তি পরাশক্তিকে কণ্যা ও জননীরূপে এক অপূর্ব বাৎসল্য রসের সৃষ্টি করেছে। সেই অব্যক্ত তন্ত্রশাস্ত্রের তত্ত্ব অনুযায়ী কোথাও তিনি জননী, আবার কোথাও তিনে কন্যারূপে প্রতিভাত। আগমণীও বিজয়ার বাৎসল্যরস বাঙ্গালী জীবনের মর্মগতী। বৈদিক সাহিত্যে বর্ণিত, দেবী দুর্গা, বাঙালী ভক্ত কবিদের হাতে গৃহবধূ, গৃহকণ্যা, গৃহদেবতারূপে পূজিতা। আবার অনেকের মতে দেবী দুর্গা বিশ্বপ্রকৃতি, বিশ্বজননী। কলা বৌ বা নব পত্রিকার বন্দনার মধ্যে দেবীর ধারিত্রীরূপ দেখতে পাই। আমার কাছে মা দুর্গা স্বদেশ প্রেমেরও প্রতীক। তাইতো ভারতবর্ষের স্বাধীণতা সংগ্রামীদের দেখা গিয়েছিলো মাতৃশক্তির আরাধণায় ব্রতী হতে।
স্মৃতি শাস্ত্রে আছে যে দেবী দুর্গার বিসর্জ্জনের পর খঞ্জন পাখি দেখা বিশেষ সৌভাগ্য সূচক। বাংলাদেশের পাবনা জেলার হিন্দু সম্প্রদায়ের কৃষকেরা আশ্বিণ মাসে দেবী জ্ঞানে খঞ্জন পাখিকে প্রণাম করে। বিহারের কোন কোন গ্রামে সনাতন ধর্মালম্বীরাও বিশ্বাস করে যে শ্রীরামচন্দ্র পৃথিবীতে এই পাখিকে প্রতিবছর চাষবাসের ভালমন্দ বিবরণ জানতে পাঠিয়ে থাকেন।

শিবের একনাম নীলকন্ঠ। লোকেরা বিশ্বাস করে যে বিজয়া দশমীর দিন শিব নীলকন্ঠ পাখির রূপধারণ করে মর্ত্তে আসেন, দুর্গাকে কৈলাসে নিয়ে যেতে। নীলকন্ঠ পাখি সরস্বতী পূজার দিন দেখলে বিদ্যালাভ হয় বলে এইরকম সংস্কার আমাদের সমাজে এখনো দেখা যায়। বাংলায় এখনো বিভিন্ন অঞ্চলে বিজয়া দশমীর দিন বেলা অপরাহ্নে গৃবধুরা গৃহাঙ্গনে আলপনা এঁকে দেবীর ‘যাত্রা’- য় মঙ্গল কামনা করে জলপূর্ণ ঘটস্থাপন করে থাকেন। এই আচারকে ‘যাত্রা ঘট’ বলা হয়।

দেবী দুর্গার আবির্ভাব, পূজা, ব্রত, লোকাচারের সাথে পাখি, প্রকৃতি, কৃষিজীবন ও ফসল নানা প্রাসঙ্গিকতায় জরিয়ে আছে। ভাত প্রিয় বাঙ্গালির জন্য শরৎ ঋতু খুবই গুরুত্ত্বপূর্ণ। এই সময়েই সোনালী ধান কৃষকের গোলায় ওঠার সম্ভাবনাময় সময়।

দেবী শব্দটি যে কোন জায়গা থেকেই সৃষ্টি হোক না কেন, বর্তমানে এ শব্দটি ব্যবহার হয় সুন্দর এবং সৌন্দর্য্য প্রকাশের ক্ষেত্রে। দেবী দুর্গার থেকে আমরা কি শিক্ষা পেতে পারি আজকে এটি বড় প্রশ্ন। শুধু ধর্মশাস্ত্রে নয়, বাংলার সব শব্দকোষে দেবী দুর্গার অর্থ করা হয়েছে --- যে দেবীশক্তি দুর্গতি নাশ করে, অর্থাৎ যে দেবী মানুষের দুর্গতি নাশ করে তাই মূলত দুর্গাদেবী। এই দেবীর আরাধনাই হল দুর্গা পূজা। চণ্ডী বা রামায়ণে যেখানেই এর উদ্ভব হোক না কেন, আমরা সহজ ভাবে এটিকে একটি চিন্তা শক্তির বিকাশ বলতে পারি। আবার অন্যভাবে বলা যায় যে মানব মনের একটি কল্পনার শক্তির বাস্তব রূপ এই দুর্গা মূর্ত্তি। হাজার হাজার বছর আগে তখনকার সামাজিক প্রেক্ষাপটে এ ধরণের একটি চিন্তার জন্মদাতাকে আমরা ঋষিও বলতে পারি। যেহেতু তাঁরা কল্পনায় এমন ভেবেছেন তাই তাঁরা কল্পতরু ঋষি।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার:-

১। দুর্গোৎসব ও আমাদের প্রাসঙ্গিক ভাবনা – সুকেশ চন্দ্র দেব
২।     দেবী দুর্গা, রাম-সীতা, কৃষি ও পাখি কথা – সাজাহান সরদার
৩।     দুর্গাপূজা ও শক্তিধর্ম – প্রেমরঞ্জন দেব
৪।     বিভিন্ন দেশে ও বিদেশে পত্র, পত্রিকা।
৫।     দুর্গাপূজায় মহালয়া – স্বপন কুমার মিস্ত্রী





Post a Comment

3 Comments

  1. স্বল্প পরিসরে দেবী দুর্গা সম্বন্ধে বিশদে অনেক কিছু জানা গেলো।
    লেখককে ধন্যবাদ।

    ReplyDelete