জ্বলদর্চি

উত্তরবঙ্গের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দুর্গাপূজা- সংক্ষিপ্ত আলোকপাত/পার্থ সারথি চক্রবর্তী

উত্তরবঙ্গের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দুর্গাপূজা- সংক্ষিপ্ত আলোকপাত 
         

পা র্থ  সা র থি  চ ক্র ব র্তী 


দুর্গাপূজা আজ আর নিছক পূজা  নয়। ভূভারত ছাড়িয়ে এই পূজা গোটা বিশ্বের দরবারে এক আন্তর্জাতিক মানের উৎসবে পরিণত হয়ে উঠেছে।  আর ভারতবর্ষের এক বিস্তীর্ন অংশ ও বাংলাদেশে দুর্গাপূজা এক প্রাণের উৎসবের চেহারা নিয়েছে। তবে যে বিষয়টি এই ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য তা হলো, সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে ওঠা। দুর্গাপূজা আজ আর কোনও সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। জাতি, বর্ণ বা সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলেই মেতে ওঠে এই উৎসবের আনন্দে। এখানেই এই পূজার বিরাট সার্থকতা। এছাড়া দুর্গাপূজা অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও এক বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। আত্মকেন্দ্রিক মানুষজন, যারা সময় ও সুযোগের অভাবে পাশের বাড়ির লোকেদেরও চেনেন না; তারাও এক সামাজিক বন্ধনের কাছাকাছি আসেন। হয়ত বা সাময়িক ভাবে। আর বহু মানুষ সারা বছর কিছু বাড়তি উপার্জনের জন্য এই সময়টার দিকেই চেয়ে থাকে। ব্যাবসা-বাণিজ্য ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে এই পূজার সঙ্গে। এককথায় এটা বলা যেতেই পারে যে, দুর্গাপূজা এক বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উৎসব। আর এই উৎসব ভারত তথা বাংলার মানুষের অন্তঃকরণ ও মজ্জাগত। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর অংশে অর্থাৎ উত্তরবঙ্গও এই উৎসবে একইভাবে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। তবে এটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া উত্তরবঙ্গের দুর্গাপূজা জৌলুস ও জাঁকজমকের দিক দিয়ে কলকাতার থেকে পিছিয়ে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকা তার বড় কারণ। তবে তা কখনই পূজার আন্তরিকতা বা প্রাণবন্ততার দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকেনি। 

এই আলোচনায় আমরা আলোকপাত করার চেষ্টা করব উত্তরের এমনই কিছু উল্লেখযোগ্য ও ঐতিহ্যবাহী পূজার উপর। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই আসে রাজার শহর কোচবিহারের বড়দেবীর মন্দিরের পূজা।


কোচবিহারের বড়দেবী

কথিত আছে কোচ রাজবংশের শুরু করা ভগবতীর পূজাই বর্তমানের বড়দেবীর পূজা । আবার মহারাজা নরনারায়ণের রাজধানী পরিবর্তনের সময় সেনাপতি শুক্লধ্বজের হাতে ভগবতীর আরাধনার কাহিনীও প্রচলিত। শ্রাবণের শুক্লা অষ্টমীর দিন শুরু হয় এই পূজার আয়োজন। ময়না গাছের কাঠ কেটে ' যূপ ' বানানোর পর তাকে নতুন বস্ত্রে সাজিয়ে মদনমোহন মন্দিরে নিয়ে আসা হয়। তারপর বিভিন্ন পদ্ধতিতে শুদ্ধিকরণ ও আচারপালনের মধ্যে দিয়ে মূর্তি নির্মাণ শুরু হয়। এই মূর্তি শোনা যায় মহারাজা নরনারায়ণের স্বপ্নদৃষ্ট মূর্তির আদলেই তৈরি। দেবীর ডান পা সিংহের ওপর আর বাম পা মহিষের উপর অধিষ্ঠিত। সাদা রঙের সিংহটির উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। প্রাণীটি দেখতে অনেকটা ঘোড়ার মত। দেবীর দশ হাতে দশ অস্ত্র। এই বড়দেবীর সাথে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্ত্তিক, গণেশ থাকেন না, বরং দু'পাশে জয়া ও বিজয়া দণ্ডায়মান ।আর দেবীর বর্ণ রক্তের মত। হিউয়েন সাং এর বর্ণনা থেকে কামরূপের রাজা ভাস্কর বর্মার শক্তি পূজার উল্লেখ রয়েছে। কোচবিহারের বড়দেবীর সাথে এই শক্তি পূজার অনেক মিল লক্ষ্য করা যায়। এই পূজার অনেকগুলো পর্ব আছে- সন্ধিপূজা, নিশিপূজা , চালিয়া বাড়িয়া পূজা ও গুপ্তপূজা। এর মধ্যে গুপ্তপূজা গোপনে হয়, কেবল দুয়ারবক্সী, রাজপুরোহিত ও কামসেনাইতেরাই এই পূজার সময় উপস্থিত থাকতে পারেন। আগে বিভিন্ন বলির প্রচলন ছিল শোনা গেলেও বর্তমানে পাঁঠা ও মাছ বলি দেওয়া হয়। তবে  কামসেনাইতেরা কয়েক ফোঁটা রক্ত দিয়ে থাকেন বলে শোনা যায়। পূজার পরে দেবীমূর্তিকে টুকরো টুকরো করে লম্বা দিঘিতে বিসর্জিত করা হয়। দেবীবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে এই পূজা হয়। রাজ আমলের,  রাজবংশের এই পূজা উপলক্ষে এক বিরাট মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সমগ্র কোচবিহার তথা উত্তরবঙ্গে বড়দেবীর পূজা এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে।

এছাড়া কোচবিহার শহর সহ বিভিন্ন মহকুমাস্থিত মদনমোহন মন্দিরগুলোতেও শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দুর্গাপূজা সম্পন্ন হয়ে থাকে।

মা ভাণ্ডানির পূজা

দুর্গাপূজার দশমীতে মায়ের বিসর্জনের পরের দিন পূজিতা হন মা ভাণ্ডানি। একাদশীর সকালে বোধন শুরু হয়, উত্তরবঙ্গের রাজবংশী-প্রধান গ্রামগুলোতে। জলপাইগুড়ি জেলার ধূপগুড়ি, ময়নাগুড়ি, মালবাজার, আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহার জেলার কিছু অংশে এই পূজা দেখা যায়। দুর্গা মায়ের আরেক রূপ ব'লে কথিত মা ভাণ্ডানি ধনসম্পত্তির অধিকর্ত্রী। মা ভাণ্ডানির পাশে থাকেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্ত্তিক ও গণেশ। সবাই বিশ্বাস করেন যে মা ভাণ্ডানি খুব জাগ্রত। এই উপলক্ষে মেলা বসে। উত্তরবঙ্গ সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে পুণ্যার্থীরা এই পূজার সময় উপস্থিত হন।

বনদুর্গা

উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চলগুলিতে দেবী দুর্গার অন্য একটি রূপের পূজা করা হয়। বনবস্তির মানুষ 'বনদুর্গা' র পূজা করেন। তাই সেই উপলক্ষ্যে দেবী দুর্গার বিসর্জনের পর এক উৎসবের সূচনা হয়। কথিত আছে যে বিসর্জনের পর দেবী দুর্গা কৈলাশে ফেরার সময় উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চল দিয়ে ফিরছিলেন। রাত হয়ে যাওয়ার জন্য বা অন্য কোন কারণে এখানে রাত্রিবাস করেন । এমনটাও অনেকে বলেন পথ হারিয়ে পাশের গ্রামে চলে যান। সেখানে গ্রামবাসীদের আতিথেয়তা স্বীকার করেন । সেই জন্য বনদুর্গার পূজার প্রচলন হয়। এই পূজার সঙ্গে বনবস্তির মানুষের আবেগ জড়িত আছে।

আবার অনেকে এটাও মনে করেন যে মা ভাণ্ডানিই  ' বনদুর্গা ' রূপে পূজিতা হন। তবে এটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, সব ই মা দুর্গার বিভিন্ন রূপ মাত্র।

চা বাগানের পূজা

উত্তরবঙ্গের অর্থনৈতিক ভিত্তির অনেকটা জুড়ে চা বাগান। কালের অভিঘাতে চা বাগানগুলো আজ মুমূর্ষু অবস্থায়। এমনিতেই চা বাগানে একটা নিজস্ব সংস্কৃতি বিদ্যমান। দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে চা বাগান এর মানুষজন মেতে উঠত আনন্দে,  হাজার অসুবিধা উপেক্ষা করেও। কিন্তু বর্তমানে যেখানে প্রায় সবকটি বাগানই ধুঁকছে,  সেখানে আনন্দ হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে বাগানবাসীর জীবন থেকে।  মা দুর্গার কৃপায় ভরসা রেখে আজো তারা সুদিন ফেরার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে।


জলপাইগুড়ি রাজবাড়ির দুর্গাপূজা

পাঁচশো বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে জলপাইগুড়ি বৈকুন্ঠপুর রাজ এস্টেটের পূজা। এটাই জলপাইগুড়ি রাজবাড়ির পূজা নামেই পরিচিত। ইতিহাস মতে শিশুসিংহ নামে এক যোদ্ধার হাতে এই পূজার প্রচলন। আড়ম্বর না থাকলেও এই পূজা আজো ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। দেবীমূর্তি উজ্জ্বল কাঞ্চন-বর্ণা। প্রায় ১৫ ফুট উচ্চ, সিংহ ও বাঘ দুই বাহনযুক্তা মা দুর্গা  সপরিবারে রথের উপরে আসীন। চার পুত্রকন্যা আর মহেশ্বর ছাড়াও আছেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু আর জয়া-বিজয়া। কালিকা পুরান মতে পূজা সম্পন্ন হয়। শোনা যায় এখানে নরবলি হত। এখন চালের গুড়ো দিয়ে বানানো পুতুল ও পায়রা বলি দেওয়া হয়। এই পূজার বিশেষত্ব আমিষ ভোগ। সপ্তমী থেকে নবমী অবধি দেবীর ভোগে কাতলা, ইলিশ, চিতল, পাবদা মাছের পাশাপাশি পাঁঠার মাংস নিবেদন করা হয়। তবে পূজা শেষে বিসর্জন হয় না। নিরঞ্জন হয়। মায়ের প্রতিমা সহ রথ টেনে নিয়ে যাওয়া হয় রাজবাড়ির দিঘি পর্যন্ত। আবার এক বছরের অপেক্ষা দিয়ে শেষ হয় দুর্গোৎসব।

এভাবেই উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন ভাবে, বিভিন্ন রূপে শক্তির আরাধনা। এই উৎসব মানুষের হৃদয়ের উৎসব,  যা সমস্ত মানুষকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসে। এখানেই দুর্গাপূজার সার্থকতা ও ব্যাপকতা।

তথ্যসূত্র: ১| কোচবিহারের ইতিহাস' - খান আমানতুল্ল্যা চৌধুরী ২|  সাময়িকী পত্রিকা। 

Post a Comment

0 Comments