জ্বলদর্চি

শ্রদ্ধায় ,স্মরণে কিংবদন্তি অভিনেতা ও আবৃত্তিশিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় /অনিন্দিতা শাসমল

শ্রদ্ধায়, স্মরণে কিংবদন্তি অভিনেতা ও আবৃত্তিশিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় 

অনিন্দিতা শাসমল

আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগের কথা। সম্ভবত উনিশশো নব্বই সাল। বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে এসেছিলেন। 'মান্না দে নাইট 'অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইন্দা বয়েজ স্কুলের মাঠে। সেই সংগীতানুষ্ঠানের প্রথমে একঘন্টার  আবৃত্তির অনুষ্ঠান ছিল। সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সৌম্যদর্শন একজন আবৃত্তিশিল্পী মঞ্চে উঠলেন, হাতে সঞ্চয়িতা। আবৃত্তি শুরু করার পরেও সামনের সারির দর্শকরা নিজেদের মধ‍্যে কথা বলে চলেছেন দেখে, মাঝপথেই আবৃত্তি থামিয়ে শিল্পী মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন কোনো কথা না বলে। সংগঠকদের অনেক অনুরোধে আবার মঞ্চে ফিরে এলেন। একের পর এক কবিতা কখনও আবৃত্তি, কখনো পাঠ করে চলেছেন। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলেন সামনের অগণিত দর্শক, সঙ্গে আমি। বাবা-মার ডাকে সম্বিত ফিরলো। চোখ বন্ধ করলে দুটি আবৃত্তি আজও স্পষ্ট শুনতে পাই তাঁর কন্ঠে -- বিশ্বকবির 'আমি' এবং "হোরিখেলা' -- আমার কয়েক হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করছেন অভিজাত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সুদর্শন এক আবৃত্তিশিল্পী। হ‍্যাঁ তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। 

  আমাদের বাড়িতে সেই  সময়ে টেলিভিশন আসেনি, সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখার সুযোগও তেমন  ছিল না। সুতরাং তাঁর  অভিনয় সম্বন্ধে এত কিছু জানতাম না।তাঁর ভক্ত, আমার বাবা- মা'র মুখে শুনতাম তাঁর অভিনয়ের কথা ,তাঁর অভিনীত সিনেমা 'অপুর সংসার' ,'সমাপ্তি' ,'বসন্ত বিলাপ','কোনি','সাত পাকে বাঁধা' -- আরও কতো সিনেমার কথা। কবিতাকে,আবৃত্তিকে ভালোবাসতে শুরু করা আমি কিন্তু সেদিন যে আবেশ নিয়ে বাড়ি ফিরেছি ,তা অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের গ্ল‍্যামার নয়, আবৃত্তিশিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের উদাত্ত কন্ঠের রেশ কানে, মনে আর প্রাণে নিয়ে। সেদিন  আমার জীবনে এতটাই প্রভাব ফেলেছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আবৃত্তি,যে তারপর থেকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেললাম আবৃত্তিশিল্পকে।

    পরবর্তীকালে সিনেমার পর্দায়, দূরদর্শন- এর পর্দায় অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে যত দেখেছি ,মুগ্ধ হয়েছি। কেবলই ভাবতাম , এই মানুষটাকে আমি এত কাছ থেকে দেখেছি ! উনি না জানলেও আমার আবৃত্তির প্রতি  ভালোবাসার অনুপ্রেরণা এই ব‍্যক্তিত্ব !
তাঁর অভিনীত অতি পরিচিত চরিত্র অপু, ফেলুদা, ক্ষিদদা, উদয়ন পন্ডিত ছাড়াও বেশ কিছু চরিত্র আমার মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। মনে হয়েছিল এই অভিব‍্যক্তি কেবল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো অভিনেতার পক্ষেই সম্ভব।তা হল 'আতঙ্ক' এর মাস্টারমশাই ও তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের 'অগ্রদানী"তে অগ্রদানী ব্রাহ্মণের ভূমিকায় তাঁর অসামান্য অভিনয়। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ও তার পরবর্তী কালে একটার পর একটা তাঁর অভিনীত  সিনেমা দেখছি আর আকর্ষিত হচ্ছি এই ব‍্যক্তিত্বের প্রতি।তাঁর শেষের দিকের ছবি 'বেলাশেষে', 'বসু পরিবার','সাঁঝবাতি' যতবার দেখি ,আবারও দেখতে ইচ্ছে করে।কতখানি ব‍্যক্তিত্ব থাকলে আর অভিনয়ের প্রতি ডেডিকেশন ও ভালোবাসা থাকলে, এত দীর্ঘ দীর্ঘদিন  সিনেমাজগতে  সমানভাবে সমাদৃত থাকতে পারেন কেউ,তার এক এবং অদ্বিতীয় উদাহরণ তিনি। এই লকডাউনের সময়ে যতবার টিভিতে 'বসন্তবিলাপ' হয়েছে, ততবার দেখেছি আর মনে মনে গর্বিত হয়েছি তিনি আমাদের মেদিনীপুর শহরের সাথে, মেদিনীপুর স্টেশনের সাথে একাত্ম হয়েছিলেন বলে।

গতবছর , 2019 সালের 30শে মার্চ প্রদ‍্যোৎ স্মৃতি সদনে 'ফেরা' নাটকে অভিনয় করতে আসেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সঙ্গে বিশিষ্ট নাট‍্যব‍্যক্তিত্ব দেবশঙ্কর হালদার ও কন‍্যা পৌলমী বসু । এই সুযোগ হাতছাড়া করবো না বলে সব কাজ ফেলে ছুটলাম কিংবদন্তি প্রতিভাবান শিল্পীকে কাছ থেকে দেখতে।অঞ্চলপ্রধানের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।আগেই শুনে গেছলাম, তিরিশ বছর আগে মুখ‍্য চরিত্রে তিনিই অভিনয় করতেন, যে চরিত্রটি সেদিন দেবশঙ্কর হালদার করেছিলেন। পার্শ্বচরিত্রেও অঞ্চল প্রধানের ভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অসামান্য অভিনয় সামনে থেকে দেখে মুগ্ধ হয়েছি সেদিন। শেষ দৃশ্যে পর্দার পেছন থেকে নেপথ‍্যে তাঁর কন্ঠের উদাত্ত আবৃত্তি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল সেই তাঁকে প্রথম দেখার দিনে-- উনিশশো নব্বই সালে।    
                 
বাড়ি ফেরার আগে, হলের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। না, ছবি তুলতে নয় -- একবার তাঁর পা স্পর্শ করবো বলে। তখন থেকেই তিনি নানারকম শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন বলে, কন্যা পৌলোমী আড়াল করে নিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁকে, যাতে দর্শকরা বিরক্ত না করেন। তাই আমার  ইচ্ছেপূরণ হল না, শুধু দেখলাম ঋজু উন্নতশির কিংবদন্তি সেই  অভিনেতা পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেলেন; হাত জোড় করে নমস্কার করলাম শুধু।

     গত চল্লিশ দিন ধরে যখন লড়াই করেছেন তিনি কখনো ভালোয় কখনো মন্দ'য় থেকে  প্রতি মুহূর্ত ভেবেছি -- চিরদিনের লড়াকু এই মানুষটি ঠিক জিতবেন এই লড়াই। অভিনয়ের মধ‍্যে, লেখার মধ্যে নিজেকে তিল  তিল করে নিয়োজিত করে রেখেছেন যিনি, এত সহজে তিনি হার মানবেন না। আমাদের সব হিসেব ভুল প্রমাণিত করে তিনি চলে গেলেন ,পাড়ি দিলেন অনন্তলোকের পথে। ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে তিনি আর  নেই। বাঙালির হৃদয়ে এই শিল্পী অভিনেতা কবি-লেখকের  নাম চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে  লেখা থাকবে। আমরা কোনোদিন ভুলবোনা এই শিল্পী অভিনেতা সর্বোপরি খাঁটি বাঙালি ও  ভালোমানুষ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে। বাঙালি হৃদয়ের অনেকটা জুড়ে ছিলেন তিনি,আছেন ও থাকবেন আজীবন।যেখানেই থাকুন ,ভালো থাকুন তিনি। 'জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে' বাঙালির মনে চিরভাস্বর হয়ে থাকুন।
-----------
আরও পড়ুন
চলে গেলেন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। 

Post a Comment

0 Comments