জ্বলদর্চি

ধারাবাহিক-প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান- ৭/অনিন্দ্যসুন্দর পাল


প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান
(Ancient India, History & Science)

অনিন্দ্যসুন্দর পাল
অলংকরণ- শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য

সপ্তম পর্ব

"ঐতিহাসিক উৎস, প্রকারভেদ ও ধারণা- ৪"

প্রাচীন ভারতের উৎস হিসাবে অলিখিত সূত্র (প্রত্নতত্ত্ব, ঐতিহ্য, চিত্রকলা, ও কার্বন) এবং প্রত্নতথ্য থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন লিখিত তথ্য সূত্র (লেখমালা মুদ্রা) ইত্যাদির ভূমিকা যেমন অনস্বীকার্য, ঠিক তেমনই লিখিত সাহিত্য সূত্রকেও অন্যতম শ্রেষ্ঠ পথ হিসাবে বেছে নিতে হবে। তাই লিখিত সাহিত্য বিভাগ যথা দেশীয় ও বেদেশীয় লেখকদের রচনা প্রাচীন ভারতের স্থায়িত্ব ও স্থাপত্য নির্বাচনের সাক্ষ্য প্রমাণ হিসাবে সমানভাবেই ব্যবহৃত হয়। কারণ একমাত্র সাহিত্যের মাধ্যমেই লেখক তার ব্যাখ্যা ও প্রতিব্যাখ্যাগুলোকে পর্যায়বৃত্ত আকারে সুন্দরভাবে উপস্থাপনা করতে পারেন। উল্লেখ্য, গ্রীক ও রোমের ইতিহাস লিখিত তথ্যের দ্বারা পুনর্গঠন সম্ভব কিন্তু এই লিখিত তথ্যের উপর নির্ভর করে প্রাচীন ভারতের সম্পূর্ণ ইতিহাসের ধারাবাহিকতা নির্মাণ করা সম্ভব না।

তবে, বিস্তীর্ণ ভারতবর্ষের ভৌগলিক অবস্থান অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন ভাষার বৈচিত্র্য দেখা দেওয়ায় ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় সাহিত্য রচনা যেমন সম্ভব হয়েছে ঠিক তেমন সেই ভাষার বৈচিত্রের উপর নির্ভর করে জানা গেছে সেই সব আঞ্চলিক পরিধির খুঁটিনাটি। তাই পঞ্চাদশ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত সময়কাল যতটা অব্যাতিক্রমী ঠিক ততটাই সমানভাবে উল্লেখযোগ্য। জ্ঞাতব্য, ভাষার উৎপত্তির প্রাথমিক পর্যায়ের সময়কালটি সম্ভবত পঞ্চাদশ শেষ হয়ে গেছে বলে মনে করা হয়। এছাড়াও আরো একটি বিশেষ বক্তব্য, মুঘল শাসক তথা গুপ্ত মৌর্য্য শাসকগণ যতই আদি সাহিত্য অথবা মধ্যযুগীয় সাহিত্যকে গৌরবান্বিত করুক না কেন তাদের উৎপত্তি যে সেই প্রাচীন ভারতেই ঘটেছিল সেকথা অস্বীকার করার কোনো জায়গা আমাদের কারো নেই। কারণ এই সংস্কৃত, বাংলা, প্রাকৃত, হিন্দি,ওড়িয়া, কাশ্মীরি প্রভৃতি ভাষা তারই বা তাদেরই নিদর্শন।

প্রাচীন ভারতের সাহিত্যকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। এক সংস্কৃত সাহিত্য, দুই সঙ্গম সাহিত্য ও তিন সাহিত্য বাংলা। আবার এই সংস্কৃত সাহিত্য পুষ্ট হয় বেদ, রামায়ণ মহাভারত, জৈন বুদ্ধ ও অন্যান্য সাহিত্য কে নিয়ে। উল্লেখযোগ্য, পরবর্তী ও আধুনিক নামে আরো দুটি ভাবে সংস্কৃত সাহিত্যকে পর্যায়ভুক্ত করা যায়।

প্রঙ্গত, ঋকবেদ থেকে যেমন "সপ্তসিন্ধু" অঞ্চলে অধিষ্ঠিত আর্যদের বসতি, সামাজিক রাজনৈতিক সম্পর্কিত খুঁটিনাটি জানা যায় ঠিক তেমন বাকি বেদগুলো আর্য-অনার্য-সংস্কৃত সংমিশ্রণের ঐতিহাসিক নিদর্শন। তবে সংস্কৃত ভাষায় রচিত রামায়ণ মহাভারতের মতো বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মগ্রন্থগুলিতেও এই সংস্কৃত ভাষার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। উল্লেখযোগ্য, অশ্বঘোষের 'বুদ্ধচরিত', বানভট্টের 'হর্ষচরিত', বিহ্লনের বিক্রমাঙ্কদেবচরিতে ধ্রুপদ সংস্কৃতের ব্যবহারের পাশাপাশি 'সারিপুত্র প্রকরণ', 'বৌদ্ধ মহাজন' ইত্যাদিতে বিশুদ্ধ সংস্কৃতির প্রাদুর্ভাবও দেখা যায়। বলাবাহুল্য, ধ্রুপদী সময়কালেই বিষ্ণুপুরাণ, বায়ুপুরাণ, মৎসপুরাণ মতো বিখ্যাত পুরাণগুলিতে সংস্কৃতের প্রভাব ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়।

কিন্তু আমরা যদি পরবর্তী ও আধুনিক সংস্কৃত সাহিত্যের দিকে নজর রাখি তবে একটি বৈশিষ্ট্য বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয় যে, একাদশ শতকের পরবর্তীকালে সংস্কৃত সাহিত্যের ধারা যেমন বদ্ধ হয়ে পড়তে শুরু করেছিল ঠিক তেমনই আধুনিক সাহিত্যের ক্ষেত্রে শুধু সংস্কৃতের প্রধানই নয়, কর্মনিযুক্তির ক্ষেত্রেও সংস্কৃতের ভূমিকা অপরিহার্য হয়ে উঠছিল। তবে বলাই বাহুল্য, জয়দেবের "গীতগোবিন্দ", সোমদেবের "কথাসরিৎসাগর"একাদশ শতকের সংস্কৃত সাহিত্যে অন্যতম নক্ষত্র হিসাবে উদীয়মান হয়। তবে একথা স্মরণে অবশ্যই রাখতে হবে ব্রাহ্মণ্য ধারাবাহিকতায় যেমন সংস্কৃতের শিক্ষণীয় দিকটি পরিস্ফুটিত হয় ঠিক তেমনই মুসলিম সাহিত্যসভায় একপ্রকার রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতাও লাভ করতে শুরু করে।

উল্লেখযোগ্য, ভারতীয় সংস্কৃতির দুই ধারা- একটি ধারা উত্তর-ভারতকেন্দ্রিক, আর অন্যটি দক্ষিণ-ভারতকেন্দ্রিক, যার সম্পূর্ণ উৎকর্ষতা ছড়িয়ে পড়েছিল সঙ্গমযুগীয় লিখিত সাহিত্যের মাধ্যমেই। যা, অন্যান্য সাহিত্য পর্যায়ের মতোই ব্যতিক্রম না। স্মরণে রাখা প্রয়োজন, সংস্কৃত সাহিত্য পর্যায়ের মতো এই পর্যায়ের সাহিত্যিকরাও নারী পুরুষ, দৈনন্দিন দেশীয় জীবনচক্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এইসব বিষয় নিয়েই ইতিহাস সাহিত্য রচনায় নিবেশিত হয়েছিলেন। প্রথমদিকের প্রায় সাড়ে চারশ কবি ও পরবর্তী পর্যায়ে ১০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কবিরা সমাজ বিজ্ঞানের নানা দিক নিয়েও সাহিত্য রচনা করেছেন। এই বিষয়ের প্রসঙ্গে একটি উদ্ধৃতি আনলে বিবরণীটি অধিক স্পষ্ট হবে -

" In their antiquity and their contemporaneity, there is not much else in any Indian literature equal to these quiet anf dramatic tamil poems. In their values and stances, they represent by ironies and nuances of design, impresonality by vivid detail, austerity of line by richness of implication. These poems are not just the earliest evidence of the Tamil genius. The Tamils, in all their 2000 years of literary effort, wrote nothing better." (Kamil Zvelebil Quotes A.K.Ramanujan)
প্রসঙ্গত, বলে রাখা ভালো যে সঙ্গম কবিতা বা সাহিত্য একদিকে যেমন প্রকাশ করে প্রেম ও যৌনতা ঠিক তেমনই অন্যদিকে মানুষের সামাজিক ও জাতিত্বের বাহ্যিক দিকটিও প্রকাশ করে, শুধু তাই নয়, এর সাথে সাথে উঠে এসেছে পরিবেশের বিভিন্ন খুঁটিনাটি। যার দৃষ্টান্ত হিসাবে আমরা "কোলকাপ্পিয়াম'র" নামটি উল্লেখ করতে পারি। বলাবাহুল্য, "সঙ্গম" শব্দটির উৎপত্তি ঘটেছিল সেই ইন্দো-আর্য ভাষা থেকেই আর বিশেষত "সঙ্ঘ" শব্দটির আগমন ঘটে জৈন বা বৌদ্ধ ধর্মের তীর্থঙ্করের সভাকক্ষ থেকে। বর্তমানে এ.নাভালার, এস.ভি.দামোদরম পিল্লাই, ইউ.ভি.স্বামীনাথ আয়ার প্রমুখগণ সঙ্গম সাহিত্যের ফুরিয়ে যাওয়া দিকগুলোকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন।

প্রসঙ্গত, সঙ্গম সাহিত্যের মতোই বাংলা সাহিত্যেরও দুই ধারা। একটি ১৩৬০-১৮০০, অর্থাৎ মধ্যযুগ পর্যন্ত এবং অন্যটি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ যা আধুনিক যুগের সময়ানুবর্তী। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন "চর্যাপদে"র পাশাপাশি মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের অন্তর্গত "গৌড়ীয় বৈষ্ণবাদ", বরু চন্ডীদাসের "শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন", বিদ্যাপতির "বৈষ্ণব পদাবলী", চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতির বৈষ্ণব গীতি কাব্য, মালাধর বসু ও কৃত্তিবাস ওঝার ভাগবৎ পুরাণ, রামায়ঢ়, শ্রীকৃষ্ণ বিজয় কাব্য, এবং চৈতন্য পরবর্তী বৈষ্ণব পাদবলী সাহিত্য শুধু বাংলার ইতিহাস নয়, ধর্মনিরপেক্ষতা, মধ্যযুগীয় সাহিত্যে বাংলা ভাষার ইতিহাস ও প্রয়োগ এবং মৈথালি ও বাংলা ভাষার যে নিজস্ব স্বর্ণখচিত প্রভাব তার বিবরণ মেলে এই সমস্ত সাহিত্যের দ্বারাই। এই লিখিত সূত্র প্রাচীন ভারত তথা বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাস দুটোকেই সমানভাবে মহিমান্বিত করেছে। উল্লেখ্য, বলরাম দাস, গোবিন্দ দাস, জয়ানন্দ, বৃন্দাবন দাস প্রমুখগণ বৈষ্ণব সাহিত্যের ও ইতিহাসের এক একটি নক্ষত্র।
(ক্রমশ..)
---------------
আরও পড়ুন 

ঐতিহাসিক হোক বা সাহিত্যিক উভয়কেই ইতিহাস অথবা সমাজবিজ্ঞান চর্চার জন্য প্রচলিত শিলালিপি, মুদ্রা বা তাম্রলেখ অথবা মহাফেজখানা বা অভিলেখগারের প্রত্ন-সামগ্রীকের উপরই নির্ভরশীল হতে হয়, তা লিখিত-ই হোক বা অলিখিত।

জ্বলদর্চি পেজ-এ লাইক দিন।👇


Post a Comment

0 Comments