জ্বলদর্চি

বাংলা ব্যাকরণ ও বিতর্ক - ৩/অসীম ভুঁইয়া

Bengali grammar and debate
বাংলা ব্যাকরণ ও বিতর্ক

পর্ব ৩
অসীম ভুঁইয়া

বাংলা অব্যয়ের বহু বিবাহ

এই ব্যাকরণ ধারাবাহিকে আমরা মূলত বাংলা ব্যাকরণের নতুন ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি। বহু প্রথিতযশা ব্যাকরণবিদদের উৎসাহ ও তাদের গ্রন্থ পাঠের নমুনা হিসেবেই ধারাবাহিকটি এগোতে চাই। প্রথাগত ব্যাকরণের সঠিক ধারণাগুলি যেমন এখানে রেখে দেব, তেমনি সচেতন পাঠের মধ্য দিয়ে তার ত্রুটিগুলো পেছনে ফেলে নতুনকে স্বাগত জানাব। বর্তমান স্কুলপাঠ্য ও সাধারণ ব্যাকরণ - ভাষাতত্ত্বের বইয়ে নতুন ধারণার বেশ কিছু সংযোজন এক্ষেত্রে ভালো লক্ষণ বলেই মনে হয়। 
   
  যাইহোক যে বিষয়টি নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করব তা হল অব্যয়পদ। পদ কেন, অব্যয়শব্দ বলতে ক্ষতি কী? পদ তো শুধু বাক্যে প্রয়োগ হয়। তাই আমরা আলাদাভাবে অব্যয়শব্দই বলব।  অনেক ব্যাকরণবিদই অব্যয় ও তার শ্রেণি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এবং সে প্রশ্ন অতি সঙ্গত বলেই আমরা মনে করি। ড. পবিত্র সরকার তো সরাসরিই  বলেছেন-  "অব্যয়কে তো আমরা বাংলা ব্যাকরণ থেকে কুলোর বাতাস দিয়ে তাড়াতে চাই।" অনেক ভাষাবিদের তাই মত। কারণ চালু ব্যাকরণে সংস্কৃত - অনুসরণে যাদের অব্যয় বলে আসছি তারা তো অন্যান্য শব্দের সঙ্গে কবেই মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।  তারা কখনো অনুসর্গ, কখনো বিশেষণ বা ক্রিয়াবিশেষণ, কখনো সংযোজক শব্দ, আবার কখনো আবেগ শব্দে বিলীন হয়ে গিয়েছে।  

  প্রথাগত ব্যাকরণে যার ব্যয় নেই অর্থাৎ কাল- লিঙ্গ- পুরুষ- বচন - বিভক্তিভেদে যার পরিবর্তন নেই, তাই অব্যয়। অথচ প্রথাগত ভাবনাতে পাশ, কাছ, ভেতর প্রভৃতি অব্যয় শব্দগুলোর সঙ্গে বেমালুম বিভক্তি যুক্ত হতে পারে।  যেমন- পাশ+এ= পাশে।  কাছ+এ= কাছে। ভেতর+এ = ভেতরে। অর্থাৎ সংজ্ঞাতেই সঙ্গতি নেই। অন্যদিকে কারকের ক্ষেত্রে কর্তা বা কিছু কর্মবাচক শব্দে বিভক্তি যুক্ত হয় না। তবে কি তাদেরও অব্যয় বলা যায়?  স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণে অনুসর্গ অংশে দেখানো হচ্ছে, পাশে, দূরে, সামনে, বাইরে প্রভৃতি অনুসর্গ, আবার অব্যয় অংশে এদের অব্যয় বলা হচ্ছে। কেউ কেউ আবার এদের অব্যয় নামে চিহ্নিত করে অনুসর্গ হিসেবে প্রয়োগ হয়েছে বলে দেখাচ্ছেন। যদি তাই হয়, তাহলে অনুসর্গ হিসেবে আলাদা নামেরই বা কী দরকার? 

  এ ধরনের  সংশয়ের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ পাঠকদের সহজে ব্যাকরণ শেখা কি সম্ভব? তাদের মনেই তো নানা দ্বন্দ্ব... ব্যাকরণ বিমুখতার  অনেক কারণের এটিও একটি অন্যতম কারণ। 
      
 যাইহোক, মূল আলোচনা থেকে বেরিয়ে যেতে চাই না। "ঈষৎ ঠান্ডা"- 'ঈষৎ'কে এখানে বিশেষণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে, আবার অব্যয়ও বলা হচ্ছে। তাহলে এটি আসলে কী শব্দ? বিশেষণ না অব্যয়? কোনো উত্তর নেই। 'টুকটুক' শব্দটিকে বিশেষ্য বলা যায়। আবার "টুকটুকে লাল ঠোঁট।" এখানে 'টুকটুকে' বিশেষণের বিশেষণ। অথচ অব্যয় অংশে একে "ধ্বন্যাত্মক অব্যয়" বলা হচ্ছে। এরকম আরও নানা দিক উল্লেখ করা যায় যেখানে অব্যয়ের অস্তিত্ব নিয়ে সত্যিই প্রশ্ন উঠে যায়।  

   তাই আমাদের মতে স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণ থেকে খুব দ্রুত এই অব্যয় শব্দটিকে থেকে তুলে দিয়ে এদের নতুন নামে নতুনভাবে শ্রেণি নির্মাণ করা উচিত। এতে ছাত্র ছাত্রী থেকে সাধারণ পাঠক তথা শিক্ষকদের মন থেকেও অব্যয় সংক্রান্ত বিভ্রান্তি দূর হবে। 
 
  আমরা সেই ধরনের একটি রূপরেখা দেওয়ার চেষ্টা করছি যেখানে প্রথাগত অব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই নতুন বিভাজন করা হচ্ছে। মূলত ভাষাচার্য পবিত্র সরকারের আধুনিক যুক্তিপূর্ণ শ্রেণিটিকেই আমরা একটু অন্য ভাবে সাজিয়ে আলোচনা করছি। এখানে প্রথাগত শ্রেণির নামগুলিকে বিকল্প রেখে, অপ্রাসঙ্গিক ও অতিরিক্ত শ্রেণিনামকে  মার্জ করে একটি  সহজবোধ্য শ্রেণি নির্মাণের চেষ্টা করছি। 

   প্রথাগত ব্যাকরণে এবং, ও, কিন্তু, আর, অবশ্য, অতএব, অতঃপর, ইদানিং, তথা, তথাপি, যদি, সাথে, অথচ, আবার, ওগো, আহা, হায় হায়, মরি মরি, শেষ পর্যন্ত, মাগো মা, বাবা গো, প্রভৃতি শব্দগুলি অব্যয়। প্রথাগতভাবে এই অব্যয়কে চারটি ভাগে ভাগ করা হত। এরা যথাক্রমে- পদান্বয়ী অব্যয়, সমুচ্চয়ী অব্যয়, অনন্বয়ী অব্যয় ও ধ্বন্যাত্বক অব্যয়।  

এবার আমরা প্রথাগত ও আধুনিক শ্রেণি পাশাপাশি দেখাচ্ছি।  

প্রথাগত শ্রেণি        আধুনিক শ্রেণি
-------------------       --------------------
পদান্বয়ী অব্যয়           অনুসর্গ
 সমুচ্চয়ী অব্যয়         সংযোজক
 অনন্বয়ী অব্যয়        আবেগ শব্দ
ধ্বন্যাত্বক অব্যয়          নেই  (এটি বিশেষ্য ও বিশেষণ শব্দের সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচিত।) 
  অনুসর্গ - থেকে, হতে, দিয়ে, পাশে, কাছে, দূরে, উপরে, নিচে ভেতরে, বাইরে প্রভৃতি। সংযোজক-  এবং, ও, আর, নতুবা, বরং, যদি না, কিংবা, তথা, অথবা, সেজন্য, যদি, তবে, পক্ষান্তরে, কাজেই, আবার, প্রভৃতি। সংযোজক শব্দগুলি বাক্যের সঙ্গে বা বাক্যের কোনো পদের সঙ্গে অন্যপদের সংযোগ ঘটায়। এখানে সংযোজক শব্দটি ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করা হয়েছে।  অর্থাৎ সংযোজক আসলে একাধিক বাক্য বা পদের মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপন করে। সেক্ষেত্রে সংকোচক, বিয়োজক প্রভৃতিকেও বোঝায়। কয়েকটি বাক্যে প্রয়োগ করে দেখাচ্ছি- ১.রোদ  'এবং'  বৃষ্টি দুটো একসঙ্গে হচ্ছে। ২.কাজের মাসি 'আর' তার মেয়েটা এসেছিল। ৩. ওর লেখার হাত খুব ভালো 'তথা' গানও গায় ভীষণ সুন্দর। ৪. তুমি 'না হয়' আমি যে কেউ গেলেই চলবে। শেষ সংযোজকটি দুটো বাক্যের মধ্যে বিরোধ নির্দেশ করছে। অর্থাৎ একটি বাক্যের ফল যা হওয়া উচিত তা না হয়ে তার বিপরীত ফল প্রকাশ করছে বা সংশোধনের একটা ভাব প্রকাশ করছে। এগুলো সাধারণত বিরোধমূলক সংযোজক। আবার হেতুবাচক সংযোজক - "আজ স্কুলে যাব না কারণ খুব শিলাবৃষ্টি হচ্ছে।" সাপেক্ষ সংযোজক - "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।" 

 এবার আসি আবেগসূচক শব্দে। আবেগসূচক শব্দগুলি হল- আহা, আচ্ছা, তো, নারে, ওগো, হে রাম, কী দারুন, বাহ, হায় হায়, ওমা, বেশ, কী জ্বালা প্রভৃতি। যেমন, বাক্য - "ছিঃ ছিঃ! এমন কথা বলতে নেই।" "হে রাম! কী কান্ড করলি?" এই শব্দগুলি মনের নানা আবেগ প্রকাশ করছে অথচ এরা সরাসরি বাক্যের সঙ্গে যুক্ত নয়,  অনেকটা স্বাধীনভাবেই এরা বাক্যে ঘোরাফেরা করে। 

  প্রথাগত ব্যাকরণে যাদের অনন্বয়ী অব্যয় বলা হয় এখানে তারাই আবেগশব্দ। আবেগ শব্দগুলি প্রশংসা, আনন্দ, ভয়, দুঃখ, যন্ত্রণা, বিরক্তি, ঘৃণা, করুণা, শোক, সম্মতি, অসম্মতি, সিদ্ধান্ত, সম্বোধন, প্রভৃতি  প্রকাশ করে।  আলংকারিক হিসেবেও এগুলো ব্যবহৃত হয়। যেমন: "সে 'তো' আর আসবে না 'রে'।" "কী  'যে' বলছ  তার কোনো মাথামুন্ডু নেই।"  এই আলংকারিক শব্দগুলো মূলত বাক্যে অর্থের পরিবর্তন না ঘটিয়ে সৌন্দর্য, মাধুর্য, কমনীয়তা প্রভৃতি প্রকাশ করে। আবার এরা নানা বিচিত্র মনোভাব প্রকাশ করতেও সক্ষম।   

  সংযোজক শব্দগুলি আবার অন্যান্য পদ হিসেবেও ব্যবহৃত  হতে পারে। যেমন: "আবার বল।" এখানে 'আবার' সংযোজক, কিন্তু ক্রিয়া বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত।  অর্থাৎ বাংলায় শব্দের উৎস ও তার প্রয়োগবিধি বিচিত্র। মানে উৎসে শব্দটি যেভাবে প্রয়োগ হত, পরে তা অন্যভাবে প্রয়োগ হতেই পারে।  
  
  আরেকটি উদাহরণ: "এ রাম! একী কাণ্ড করেছে?" এখানে  "এ রাম" সংযোজক হওয়া সত্ত্বেও বিশেষ্যপদ হিসেবে ব্যবহৃত।  

  অনুসর্গও একপ্রকার সংযোজকের কাজ করে। তবে এর অগাধ বিস্তৃতি ও ব্যাকরণগত গঠন আলাদা হওয়ায় আমরা পরে বিশেষভাবে একে আলোচনা করতে চাই।

জ্বলদর্চি পেজ-এ লাইক দিন।👇


আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments