জ্বলদর্চি

বাংলা সিনেমার কিংবদন্তী অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়/সিদ্ধার্থ সাঁতরা

বাংলা সিনেমার কিংবদন্তী অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

সিদ্ধার্থ সাঁতরা 

দীর্ঘ যমে মানুষে টানাটানি, ডাক্তারদের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও চলে গেলেন বাংলা সিনেমার কিংবদন্তী অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। জন্ম ১৯/০১/১৯৩৫ মৃত্যু ১৫/১১/২০২০। করোনা ভাইরাস ও তৎজনিত কারণে  ৮৫ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন জনপ্রিয় অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় । পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য বাঙালির হৃদয়ে থাকা অসম্ভব গুণী মানুষটির প্রয়াণে আজ শোকাহত অগণিত মানুষ।

১৯৫৯ সালে অপুর সংসার দিয়ে শুরু করে ২০২০ পর্যন্ত দুটি হিন্দি ছবি সহ শতাধিক বাংলা ছবিতে অভিনয় করে সিনেমাপ্রেমী বাঙালির হৃদয়ে পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছিলেন এই কিংবদন্তী অভিনেতা। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন সহ সমস্ত প্রথম সারির বাংলা সিনেমা পরিচালকদের ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। সত্যজিৎ রায়ের ১৪টি ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ছবিগুলি হলো  অপুর সংসার(১৯৫৯), দেবী(১৯৬০), তিনকন্যা(১৯৬১), অভিযান(১৯৬২), চারুলতা(১৯৬৪), কাপুরুষ(১৯৬৫), অরণ্যের দিনরাত্রি(১৯৭০), অশনি সংকেত(১৯৭৩), সোনার কেল্লা(১৯৭৪), জয়বাবা ফেলুনাথ(১৯৭৯), হীরক রাজার দেশে(১৯৮০), ঘরে বাইরে(১৯৮৪), গণশত্রু(১৯৮৯) ও  শাখা প্রশাখা(১৯৯০)। প্রতিটি ছবিতে তাঁর অভিনয় দেশে-বিদেশে সাড়া জাগিয়েছিল। আরেক পৃথিবী বিখ্যাত পরিচালক  মৃণাল সেনের তিনটি ছবিতে তিনি কাজ করেছেন। ছবিগুলি হলো ১) পুনশ্চ(১৯৬১), ২) প্রতিনিধি (১৯৬৪) ও  ৩)আকাশ কুসুম(১৯৬৫)। তপন সিনহার তিনটি ছবির মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ছবিগুলি হলো ক্ষুধিত পাষাণ(১৯৬০), ঝিন্দের বন্দী(১৯৬১) ও  আতঙ্ক(১৯৮৬)। তরুণ মজুমদারের যে তিনটি ছবিতে কাজ করেছেন সেগুলি হলো একটুকু বাসা(১৯৬৫), সংসার সীমান্তে(১৯৭৫) ও গণদেবতা(১৯৭৮)। এছাড়াও তিনি গৌতম ঘোষের  শূন্য অঙ্ক(২০১৩), দেখা(২০০১), অসিত সেনের  স্বয়ম্বরা(১৯৬১) ও  স্বরলিপি(১৯৬১), ঋতুপর্ণ ঘোষের  অসুখ(১৯৯৯), দীনেন গুপ্তের বসন্ত বিলাপ(1973) এই ছবিতে অভিনয় করার সূত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ১৯৭২ সালে মেদিনীপুরে এসেছিলেন। এছাড়াও দীনেন গুপ্তের সঙ্গিনী(১৯৭৪) এবং নিশিমৃগয়া(১৯৭৫) ছবিতে তিনি নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। তিনটি ছবিই অর্থকরী দিক দিয়ে চূড়ান্ত সফল ছবি। এছাড়াও আরেক বিখ্যাত পরিচালক অজয় করের ছ'টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। ছবিগুলি হলো অতল জলের আহ্বান(১৯৬২), সাত পাকে বাঁধা(১৯৬৩), বর্ণালী(১৯৬৩), কাঁচ কাঁটা হীরে(১৯৬৫), পরিণীতা(১৯৬৯) ও মাল্যদান(১৯৭১)। সুখেন দাসের প্রতিশোধ(১৯৮১), সন্দীপ রায়ের ছবিতেও  কাজ করেছেন। এখনকার পরিচালক অর্থাৎ সৃজিত মুখার্জীর হেমলক সোসাইটি(২০১২), শিবপ্রসাদ মুখার্জী ও নন্দিতা রায়ের বেলাশেষে(২০১৫) ও পোস্ত(২০১৭), সুজয় ঘোষের অহল্যা(২০১৫) এবং অতনু ঘোষের ময়ূরাক্ষী(২০১৭) ছবিতে সাবলীল অভিনয় করে দর্শকদের মোহিত করেছেন। এমনকি এই ২০২০ সালেও দুটি ছবি করেছেন নাম বরুনবাবুর বন্ধু( পরিচালক -অনিক দত্ত) ও শ্রাবনের ধারা( পরিচালক- অমিতাভ সরকার)। এত সাবলীল সহজ চরিত্রের সঙ্গে মিশে গিয়ে  অভিনয় করতেন যে দর্শক চরিত্র ও অভিনেতা আলাদা করতে পারতেননা। পর্দায় অভিনেতাকে ছাপিয়ে চরিত্রই দাপিয়ে বিরাজ করতো। কতবড় অভিনেতা হলে স্থান পরিবেশ ও চরিত্রের সঙ্গে মিলেমিশে চরিত্রকেই এক এবং একমোদ্বিতীয়ম করে  দর্শকের চোখের সামনে হাজির করা সম্ভব হয় সেকথা আপামর বাংলা সিনেমার দর্শকদের স্মৃতির  মনিকোঠায় অনন্তকাল রয়ে যাবে। প্রতিটি চরিত্রের চিত্রায়নে যেন পাশের বাড়ির ছেলেটি পরিচিত চোখের অভ্যস্ততায় সিনেমার পর্দায় ফুটে উঠেছে সাবলীল স্বাভাবিকত্বে।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় দুটি হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছেন তাঁর প্রথমটি হলো নিরুপমা(১৯৮৬) এবং দ্বিতীয়টি হলো হিন্দুস্থানী সিপাহী(২০০২)। এছাড়াও উনি ছবি পরিচালনা করেছেন নাম 'স্ত্রী কা পত্র '(হিন্দি- ১৯৮৬), ছবিটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রীর পত্র অবলম্বনে।

প্রতিভাবান অভিনেতা হিসেবে অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। অল্প কিছু উল্লেখ করছি  পদ্মভূষণ(২০০৪), চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ জাতীয় পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে(২০১১), ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড কয়েকবার পেয়েছেন, BFJA বেস্ট এক্টর অ্যাওয়ার্ড আটবার পেয়েছেন। চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য ফরাসি দেশের সর্বোচ্চ সন্মান লিজিওঁ দ' নর পুরস্কারে(২০১৮) ভূষিত হয়েছেন, এছাড়াও ইতালি, বাংলাদেশে পুরস্কৃত হয়েছেন।

    নাটক করতেন সেখানেও অসামান্য প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন। চোখ বন্ধ করলে মনের পর্দায় ভেসে ওঠে কিং লিয়ার। তাঁর অভিনীত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হলো জীবন(১৯৭৮), রাজকুমার(১৯৮২), ফেরা(১৯৮৭), নীলকণ্ঠ(১৯৮৮), ঘটক বিদায়(১৯৯০), ন্যায়মূর্তি(১৯৯৬), টিকটিকি(১৯৯৫) ইত্যাদি। শুধু অভিনয় করেননি নাটক লিখেছেন ও পরিচালনা করেছেন। এর জন্য সংগীত নাটক একাডেমী পুরস্কারও  পেয়েছেন(১৯৯৮)। তাঁর লেখা নাটকের দুটি সংকলন আছে। নাটক সমগ্র ১(২০১৫ সাল)ও নাটক সমগ্র ২(২০১৭ সাল)।
বাংলা ভাষার একজন প্রথম সারির কবিও তিনি, ভালো কবিতা পাঠও করতেন। কবিতার বই আছে শ্রেষ্ঠ কবিতা(১৯৯৩), কবিতা সমগ্র(২০১৪), শব্দরা আমার বাগানে ইত্যাদি।

পঁচাশি বছর বয়স কিন্তু একেবারে সুস্থ সবল সৃষ্টিশীল মানুষ ছিলেন। অগণিত মানুষের ভালোবাসার এবং ভালোলাগার জায়গা ছিলেন  । করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে কোথা দিয়ে কি হয়ে গেল কিছু বুঝে উঠতেই পারলামনা। এই কঠিন সময়ে সংস্কৃতি মনস্ক অভিভাবক মানুষটি হটাৎই চলে গেলেন... এক গভীর শূন্যতা তৈরি হলো। এ অভাব পূরণ হবার নয়। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে শুধু বলি তোমার রেখে যাওয়া অপূর্ণ স্বপ্নটা যেন বাঁচিয়ে রাখতে পারি এই আশীর্বাদ করো তুমি। গভীর শ্রদ্ধা ও আন্তরিক ভালোবাসা সহ শোকাহত এক সিনেমাপ্রেমী।
----------
আরও পড়ুন 

চলে গেলেন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। 

Post a Comment

0 Comments