জ্বলদর্চি

বাংলা ব্যাকরণ ও বিতর্কপর্ব -৫/অসীম ভুঁইয়া

Bengali grammar and debate
বাংলা ব্যাকরণ ও বিতর্ক || পর্ব- ৫
অলংকরণ - শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য 

অসীম ভুঁইয়া

বাক্যের গঠনগত আড়াই প্যাঁচ 

বাক্য ও বাক্যের "ঢং ও অর্থগত শ্রেণি" সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা আগের পর্বেই করা হয়েছে। তবে কতদূর সফল তা পাঠকের সদর্থক চিন্তায় বিচার্য... 

   এবার বাক্যের গঠনগত প্রকাশের স্টাইল সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই। প্রথমেই আমরা চারটি বাক্য নেব। 
১.  মৃত্যুকূপের উঁচু প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ওকে দেখলাম।
2. মৃত্যুকূপের উঁচু প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ালাম এবং ওকে দেখলাম 
৩. যখন মৃত্যুকূপের উঁচু প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ালাম তখনই ওকে দেখলাম।
এবং
৪. মৃত্যুকূপের উঁচু প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ালাম এবং যখন দাঁড়ালাম তখন ওকে দেখলাম। 

   যে চারটি বাক্য উদাহরণ হিসেবে নেওয়া হল, তাদের মূল বিষয়ে কিন্তু কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য শুধু প্রকাশভঙ্গিতে। 

   এই একই বিষয় সম্বলিত বাক্যগুলির স্টাইল পরিবর্তনের জন্য গঠনের দিক থেকে এদের চারটি ভাগে ভাগ করা হয়। এরা সরলবাক্য, যৌগিকবাক্য, জটিলবাক্য ও মিশ্রবাক্য।  
   
   প্রথমেই আসি সরল বাক্যের প্রসঙ্গে। কয়েকটি উদাহরণ নেওয়া যাক।
১. সিমি বাড়ি এল।
২.  মৃত্যুকূপের উঁচু প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ওকে দেখলাম।
৩ . তিন্নি বাড়ি গেলে সবই বলবে। 

   এই বাক্যগুলিতে সমাপিকা ক্রিয়া যথাক্রমে 'এল', 'দেখলাম' ও  'বলবে।' অর্থাৎ  প্রতিটি বাক্যে একটি করে সমাপিকা ক্রিয়া রয়েছে । এই একক সমাপিকা ক্রিয়াযুক্ত বাক্যগুলিই সরলবাক্য। অর্থাৎ সরলবাক্যের মূল শর্ত : বাক্যে একটি সমাপিকা ক্রিয়া থাকবে। তবে উদ্দেশ্য বা কর্তা একাধিক হতে পারে। 
   তবে দুই এবং তিন নম্বর বাক্যটি নিয়ে একটু সমস্যা রয়েছে।  কারণ এখানে একটি করে সমাপিকা ক্রিয়া থাকলেও বাক্যগুলিতে দুটি বাক্যের সম্ভাবনা আছে। বলা ভালো, দুটি বাক্যের দুটি ভিন্ন  বিষয় রয়েছে। 
২ নং বাক্যে  "মৃত্যুকূপের উঁচু প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো" ও "ওকে দেখা।"
৩ নং বাক্যে "তিন্নির বাড়ি যাওয়া" ও "সবই বলা।" 
২ নং বাক্যে ' দাঁড়ানো ' অসমাপিকা ক্রিয়াটিকে সমাপিকার রূপ দিলেই পরিষ্কার দুটি বাক্য হয়ে যায়। 
আর ৩ নং বাক্যে তো "সবই বলা" অংশটি "তিন্নির বাড়ি যাওয়ার" উপর নির্ভর করছে, অর্থাৎ শর্তসাপেক্ষে যুক্ত, যা মূলত জটিল বাক্যের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সরল বাক্য মানেই একটি সমাপিকা ক্রিয়াযুক্ত একক বিষয় বা একক  অর্থ সম্বলিত বাক্য। তাই এ ধরনের বাক্যকে অনেকেই সরল বাক্য বলতে নারাজ। আমাদেরও তাই মত। পরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছি। 
 
  এবার আসি জটিলবাক্যের প্রসঙ্গে। আগে কিছু বাক্য নেওয়া যাক। 
১.  যখন মৃত্যুকূপের উঁচু প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ালাম তখনই ওকে দেখলাম। ২. যদি তিন্নি বাড়ি যায় তবেই সে সব বলবে। 
 ৩. রনি জানে এবার ওকে পাশ করতেই হবে।
৪.  আমাকে না ডাকলে কিন্তু আমি যাব না।
১ নং বাক্যে দুটি সমাপিকা ক্রিয়া রয়েছে। ' দাঁড়ালাম ' ও ' দেখলাম।' আর এই দুটি ক্রিয়াকে নিয়ে দুটি পৃথক বাক্য তৈরি হয়েছে, যাদের এখানে খণ্ডবাক্য বা উপবাক্য বলছি। এই বাক্যদুটি হল "মৃত্যুকূপের উঁচু প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ালাম" ও  "ওকে দেখলাম।" এখানে অর্থের দিক থেকে প্রধান খণ্ডবাক্য "ওকে দেখলাম।"  কারণ পুরো বাক্যের মূল বিষয় এটাই।  এই প্রধান খন্ডবাক্যটির আশ্রয়ে  আছে "মৃত্যুকূপের উঁচু প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ালাম"  এই অপ্রধান খন্ডবাক্যটি। এটি আশ্রিত বাক্য যা পুরোপুরি স্বাধীন নয়। অন্যদিকে প্রধান খন্ডবাক্যটি তার আশ্রিত বাক্যের তুলনায় স্বাধীন হলেও সম্পূর্ণ স্বাধীন কিন্তু সেও নয়।  এই ধরনের বাক্যই জটিলবাক্য।
 
   ২ নং বাক্যে দুটি খণ্ডবাক্য।"তিন্নি বাড়ি যায়" ও "সে সব বলবে।" এক্ষেত্রে বাক্য দুটি শর্তসাপেক্ষে অবস্থান করছে। " তিন্নি বাড়ি যায়" এই খন্ডবাক্যটি-  "সে সব বলবে"  অংশটির শর্ত। এ ধরনের শর্তাধীন  বাক্যও জটিল বাক্য। আর হ্যাঁ, শর্তাধীন বাক্যের শর্তবাক্যটি অপ্রধান খান্ডবাক্য। আর যে খন্ডবাক্যটি শর্তে যুক্ত সেই প্রধান খন্ডবাক্য। 
৩ নং  বাক্যে "যখন-তখন" বা "যদি- তবে"  এ ধরনের সাপেক্ষশব্দজোড় নেই। কিন্তু "রনি জানে" ও "এবার তাকে পাশ করতেই হবে।"-  পরিষ্কার দুটো খন্ড বাক্য। "রনি জানে" এই প্রধান খন্ডবাক্যটিতে আশ্রয় নিয়েছে "এবার তাকে পাশ করতেই হবে" এই খন্ডবাক্যটি। তাই এও এক জটিল বাক্য। 
৪ নং বাক্যে "আমাকে না ডাকলে" উপবাক্যটি অসমাপিকা ক্রিয়াযুক্ত। অবশ্য একে সমাপিকার রূপ দেওয়াই যায়। "আমাকে না ডাকো" বা "আমাকে ডাকলে না।" ইত্যাদি ইত্যাদি। অন্য উপবাক্য "আমি যাব না।"  দুটি বাক্যের মাঝে "কিন্তু"  সংযোজক শব্দটি থাকলেও এটি জটিলবাক্য। কারণ এখানেও শর্তসাপেক্ষ ভাব রয়েছে। "আমি যাব না" অংশটি নির্ভর করছে "আমাকে না ডাকলে" এই শর্ত বাক্যটির উপর।  তাই একেও জটিল বাক্যের মধ্যে ধরতে হয়।  

   প্রসঙ্গত এ ধরণের বাক্যকেই আগে সরলবাক্যের মধ্যে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের নতুন ব্যাকরণে এটি জটিলবাক্য।  অর্থাৎ জটিলবাক্যে একটি প্রধান খন্ডবাক্যের সঙ্গে এক বা একাধিক অপ্রধান খণ্ডবাক্য আশ্রিত বা শর্তাধীন অবস্থায় যুক্ত থাকবে। 
 
  জটিলবাক্যে ব্যবহৃত সাপেক্ষবাচক শব্দগুলো হল:  যখন - তখন, যে সে - সে, যার - তার, যেমন- তেমন, যাদের- তাদের, যেহেতু- সেহেতু, যদি - তাহলে,  যেভাবে- সেভাবে, যদি - তবে, যেরকম- সেরকম,  যেখানে - সেখানে,  যাকে-তাকে প্রভৃতি। তবে সাপেক্ষ শব্দজোড় ছাড়াও জটিল বাক্য নির্মাণ করা যায়। 

   এবার যৌগিকবাক্য দেখে নেওয়া যাক। 
১. মৃত্যুকূপের উঁচু প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ালাম এবং ওকে দেখলাম।
২. তোমরা যাও, নচেৎ আমরাই চলে যাব। 
৩. তোমরা যাও, আমি এখানে অপেক্ষা করব। 
 প্রথম দুটি বাক্য আগে লক্ষ করা যাক। এই দুটি বাক্যের প্রতিটিতেই আলাদা সমাপিকা ক্রিয়াযুক্ত দুটি করে বাক্য রয়েছে। এবং বাক্যগুলো কেউ কারুর উপর নির্ভরশীল নয়। অর্থাৎ প্রত্যেকে স্বাধীন ও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই একটি বাক্যের ভেতর যে দুটি বাক্য আছে তার মাঝে সংযোজক হিসেবে যথাক্রমে 'এবং' ও 'নচেৎ' এই শব্দ দুটি রয়েছে। এরা দুটি স্বাধীন বাক্যকে যুক্ত করে একটি বাক্যের রূপ দিয়েছে। আর ৩ নং  বাক্যটিতে  সংযোজক হিসেবে কমা (,)  চিহ্ন রয়েছে। এ ধরনের বাক্যগুলিই  যৌগিকবাক্য। 
মনে রাখতে হবে জটিলবাক্যেও দুটি বাক্য থাকে আর যৌগিক বাক্যেও অন্তত দুটি বাক্য থাকে। তবে জটিল বাক্যের অন্তর্গত বাক্যগুলি পরস্পর স্বাধীন নয় আর যৌগিক বাক্যের অন্তর্গত বাক্যগুলি পরস্পর স্বাধীন। 

   তাহলে মোটকথা, যৌগিকবাক্য একাধিক সরল স্বাধীন বাক্য নিয়ে গঠিত। যার মাঝে সংযোজক শব্দ বা সংযোজক চিহ্ন থাকে। 

   এবার আসি মিশ্র বাক্যের প্রসঙ্গে। 
১. আমরা সকলে গিয়েছিলাম কিন্তু তোমরা যাওনি, যেহেতু তোমরা যাওনি তাই সভাটি ঠিকঠাক জমে ওঠেনি।
 এখানে  "আমরা সকলে গিয়েছিলাম" এবং "তোমরা যাওনি" এ দুটি সরল বাক্য। "আমরা সকলে গিয়েছিলাম কিন্তু তোমরা যাওনি" এই বাক্যটি যৌগিক বাক্য। আর "যেহেতু তোমরা যাওনি তাই সভাটি ঠিকঠাক জমে ওঠেনি"-  বাক্যটি জটিল বাক্য। অর্থাৎ এখানে সরল, যৌগিক ও জটিল বাক্য নিয়ে একটি বাক্য তৈরি হয়েছে। মানে একটি বাক্যের ভেতর তিন ধরনের বাক্য রয়েছে। একেই বলে  মিশ্রবাক্য।   

   প্রথাগত ব্যাকরণে একে এক সময় জটিলবাক্যের মধ্যে আলোচনা করা হত। পরবর্তীকালে একে মিশ্রবাক্য নামে আলাদা শ্রেণিনাম করা হয়। জটিলবাক্য বলার কারণ ছিল - মিশ্রবাক্যের মধ্যে যেহেতু জটিল বাক্যের ভাবটি বেশি অংশ জুড়ে থাকে তাই। তবে যৌগিক এবং সরলবাক্যেরও ভাব থাকায় একে মিশ্রবাক্য বলতে আমাদের কোনো বাধা নেই।
 আর একটি বিষয় মনে রাখতে হবে-  শুধু সরল ও যৌগিকবাক্য নিয়ে মিশ্রবাক্য তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। কারণ একটি যৌগিক বাক্যের মধ্যেই তো সরলবাক্য থাকে। আর দুইয়ের বেশি সরলবাক্য যদি যুক্ত করা হয় যৌগিক বাক্যের নিয়মে তবুও তাকে জটিল বাক্য না বলে যৌগিক বাক্যই বলতে হয়। কারণ তার মধ্যে জটিল বাক্যের কোনো ভাব থাকে না। অর্থাৎ একটি সরল বাক্য আর অন্তত দুটি সরল বাক্য নিয়ে গঠিত একটি যৌগিকবাক্য এবং তার একটি অংশ এবং অন্য একটি অংশ নিয়ে তৈরি জটিল বাক্য একটি বাক্যের মধ্যে থাকলে তবেই তাকে মিশ্রবাক্য বলা যায়। 

   এভাবে বাক্যের গঠনগত শ্রেণির সামান্য কিছু সমস্যা বাদ দিলে মোটামুটি ঠিকই আছে।
জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇



আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments