জ্বলদর্চি

বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু / পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞান -১
পূর্ণ চন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসু

সে-দিনটা ছিল ৭-ই ফেব্রুয়ারি, ১৯২৪ সাল। বৃহষ্পতিবার। লন্ডনের ইন্ডিয়া হাইজের বক্তৃতা কক্ষে থিকথিকে ভীড়। সাংবাদিক, বিজ্ঞানী, দর্শকে ঠাসা। সকলের নজর একটি স্বয়ংলেখ যন্ত্রের ওপর। সেটি বক্তৃতা কক্ষের জানলার কাছে উঁচু টেবিলের ওপর বসানো।

যন্ত্রটির একটি নির্দিষ্ট স্থানে বিশেষ ভাবে তৈরি কাচের শিশিতে পরীক্ষাধীন জলজ উদ্ভিদ রাখা আছে। শিশি'র মুখে বসানো রাবারের ছিপিতে ফানেলের মতো ইউ-টিউব লাগানো। ফানেলের মধ্যে নির্দিষ্ট ওজনের পারদ ঢালা হল। পারদ সঙ্গে সঙ্গে ইউ-টিউবে চলে যায়। পারদ বিন্দু এখানে ভালবের কাজ করে। শিশিটির ওপর সরাসরি সূর্যের আলো এসে পড়ছে। আলোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়া চালু হবার সঙ্গে সঙ্গে কক্ষের ভেতর হঠাৎই ঘণ্টা বেজে উঠল। একবার নয়, পর পর দু'বার। এ বার বক্তা তার নিজের হাতে তৈরি যন্ত্রটির সামনে এগিয়ে গেলেন।

উৎসাহী দর্শকদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলতে শুরু করলেন, 'শিশি'র ওপর আলো পড়লে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদ অক্সিজেন উৎপন্ন করে। সেই অক্সিজেন শিশি থেকে সোজা ইউ-টিউব দিয়ে বাইরে বেরনোর চেষ্টা করে। কিন্তু ফানেলের মধ্যে থাকা পারদ অক্সিজেন নিষ্কাশনে বাধা দেয়। তার ফলে ইউ-টিউবে অক্সিজেন জমা হয়। যত বেশি অক্সিজেন উৎপন্ন হয়, টিউবের মধ্যে অক্সিজেনের চাপ তত বাড়ে। ফলে নলের পারদ ধীরে ধীরে উপরে উঠতে থাকে। শেষমেশ নির্দিষ্ট পরিমাণ অক্সিজেনের চাপ পারদবিন্দুকে ঠেলে ফানেলের মুখে তুলে ধরে। ফানেলের মুখে দুটি প্লাটিনাম তার ঝোলানো আছে। তার দুটির সঙ্গে তড়িৎ-চৌম্বকীয় লেখনী যুক্ত। বেরিয়ে যাওয়ার সময় পারদবিন্দু ঐ প্লাটিনাম তারের সংস্পর্শে এলে চুম্বক লেখনীর সামনের ঘড়ি একটি কলের সাহায্যে ঘূর্ণায়মান ড্রামের ওপর আঘাত করে। তখন ঘণ্টা বেজে ওঠে।' 

এ পর্যন্ত বলার পর একটু থামলেন। তারপর মঞ্চ থেকে নেমে এলেন বক্তা। দর্শকদের মধ্যে তখন হালকা গুঞ্জন। দর্শকের প্রথম সারিতে বসে আছেন ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী রামজে ম্যাকডোনাল্ড। তার পাশে জর্জ বার্নার্ড'শ, বিজ্ঞানী অলিভার লজ ও ভারতের প্রাক্তন গভর্নর জেনারেল হার্ডিঞ্জ সহ আরও অনেকে। জর্জ বার্নার্ড'শ হঠাৎ প্রধানমন্ত্রীকে বলতে শুরু করেন, 'এই বক্তা শীঘ্রই হয়তো এমন একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করবেন, যা দিয়ে রাজনীতিবিদ ও অন্যান্যদের কার্যক্ষমতা যন্ত্রলিপির মাধ্যমে এঁকে দেখাবেন এবং বিভিন্ন ধরনের কাজে ওঁদের দক্ষতাও নিখুঁতভাবে পরীক্ষা করতে সক্ষম হবেন।' 

সেদিনের যন্ত্রটির নাম 'ফটো সিন্থেটিক বাবলার' এবং তার উদ্ভাবক ছিলেন পরম শ্রদ্ধেয় আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু। ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর ব্রিটিশ ভারতের (অধুনা বাংলাদেশ) বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত ময়মনসিংহে তাঁর জন্ম। পৈত্রিক ভিটা মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রামে। তাঁর মাতা বামা সুন্দরী বসু। তাঁর পিতা ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী ভগবান চন্দ্র বসু তখন ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তার আগে তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ইংরেজ সরকারের অধীনে উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার হয়েও এ দেশীয় সংষ্কৃতি ভোলেননি তিনি। তাই ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের বাংলা মাধ্যমে ছোট্ট জগদীশকে ভর্তি করে দেন। তাঁর যুক্তি ছিল ইংরেজী ভাষা শিক্ষার আগে এ দেশের ছেলেমেয়েদের মাতৃভাষা আয়ত্ত করে উচিত। 

সেখান থেকে ১৮৬৯ সালে কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হলেন। তারপর কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল। ১৮৭৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'এন্ট্রান্স পরীক্ষায়' সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি খ্রিস্টীয় যাজক ইউজেন ল্যাফন্ট-এর সংস্পর্শে আসেন। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে শ্রীবসুর আকৃষ্ট হওয়ার পেছনে খ্রিস্টান এই যাজকের অবদান অপরিসীম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি B.A. ডিগ্রি লাভ করেন। গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর যুবক জগদীশ চেয়েছিলেন Indian Civil Service (ICS) পরীক্ষায় বসতে। আদ্যোপান্ত ভারতীয় পিতার অনিচ্ছায় তার সে আশা পূরণ হয়নি। তার বাবা চেয়েছিলেন ছেলে একজন বিদ্বান (স্কলার) হোক। পিতার সে বাসনা পূরণ করতে তিনি লন্ডনে পাড়ি জমান ১৮৮০-তে। লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে মেডিসিন পড়তে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে মাঝপথে মেডিসিন পড়া ছাড়তে বাধ্য হন। 

পরে ভগিনীপতি (বোনের স্বামী) ভারতের প্রথম Wrangler আনন্দমোহন বসুর মধ্যস্থতায় কেমব্রিজের 'ক্রিস্টস কলেজ'-এ ভর্তি হলেন। প্রিয় বিষয় প্রকৃতি বিজ্ঞান পড়তে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে B.A. (Natural Science Tripos) এবং লন্ডন ইউনিভার্সিটির অন্তর্ভুক্ত ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে ১৮৮৪ সালে B.Sc. ডিগ্রি আয়ত্ত করেন। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে পুনরায় D.Sc. উপাধিতে সম্মানিত হন ১৮৯৬ সালে। কেমব্রিজে অধ্যয়ন কালে তিনি শিক্ষক হিসেবে মহান বিজ্ঞানী লর্ড র্যালে, মাইকেল ফস্টার, জেমস ডেওয়ার, ফ্রান্সিস ডারউইন, ফ্রান্সিস বাল্ফার এবং সিডনি ভিনস-এর সান্নিধ্য লাভ করেন।

শ্রীবসু যখন কেমব্রিজের পড়ুয়া, ঠিক সে-সময় আরেক বাঙালি দিকপাল আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তখন এডিনবরা'র শিক্ষার্থী। দুজনে লন্ডনে মিলিত হন এবং তারপর থেকে আজীবন একে অপরের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হন। শ্রীবসুর জীবনে আরেকজন মহিয়সী মহিলার বিশেষ ভূমিকা ছিল। তিনি পরম প্রিয় ভগিনী নিবেদিতা। এই মহামানবী শ্রীবসুর একনিষ্ঠ গুণগ্রাহী ছিলেন যিনি বসুর পাণ্ডুলিপিগুলো সম্পাদনা করে দিতেন ও মনে প্রাণে চাইতেন শ্রীবসু তাঁর উদ্ভাবনী কার্য চালিয়ে যান। শুধু তাই নয়, তার তীব্র আর্থিক সংকটে অর্থনৈতিক সাপোর্ট সংগঠিত করতে বিশেষ তৎপরতা গ্রহণ করেছিলেন।

১৮৮৫ সালে জগদীশ চন্দ্র দেশে ফিরে আসেন। তৎকালীন ভারতের গভর্নর জেনারেল জর্জ রবিনসন, প্রথম মার্কুইস অব রিপনের অনুরোধে স্যার আলফ্রেড ক্রফট শ্রীবসুকে প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক নিযুক্ত করেন। বসুর নিয়োগের চরম বিপক্ষে ছিলেন কলেজের অধ্যক্ষ চার্লস হেনরি টনি। তবে নিয়োগ আটকাতে পারলেন না। প্রতিশোধ নিলেন অন্যভাবে। প্রেসিডেন্সি কলেজে গবেষণার কোন রকম সুযোগ সুবিধা দেওয়া হল না তাঁকে। শুধু তাই নয়, তখন বেতনের বৈষম্য ছিল চোখে পড়ার মতো। কলেজের অধ্যাপক হিসেবে যেখানে ইউরোপীয়ানরা পেত ৩০০ টাকা মাসিক, সেখানে ভারতীয় অধ্যাপকদের জন্য মাসিক ২০০ টাকা বরাদ্দ ছিল। শ্রীবসুর ক্ষেত্রে আরও কম। মাসিক ১০০ টাকা। এ হেন বৈষম্যের পেছনে মাষ্টারমাইন্ড ছিলেন অধ্যক্ষ হেনরি টনি। এত কিছুর পরও জগদীশ চন্দ্র বসু পরাজয় স্বীকার করেননি, বরং এর প্রতিবাদে তিনি বেতন নেওয়া বন্ধ করে দেন। তিন বছর ধরে অবৈতনিকভাবেই অধ্যাপনা চালিয়ে যান। ঠিক এমন দুঃসময়ে ১৮৮৭ সালে তিনি অবলা দাসের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। শ্রীমতি অবলা ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের বিখ্যাত সংস্কারক দুর্গামোহন দাসের কন্যা। বেতন নেবেন না বলে গোঁ ধরে আছেন আর এদিকে বাড়িতে নতুন বধূর আগমন। হাতে পয়সা-কড়ির তীব্র সংকট।

তবে এই দীর্ঘ প্রতিবাদের ফলস্বরূপ কলেজ কর্তৃপক্ষ হার স্বীকার করে তার বেতন ইউরোপীয় শিক্ষকদের সমতুল্য করে এবং বিগত তিন বছরের বকেয়া বেতন উপযুক্ত সম্মানের সঙ্গে শ্রীবসুকে প্রদান করা হয়।

এত প্রতিকুল পরিবেশের মধ্যেও বিজ্ঞান সাধনায় তাঁর আগ্রহ এতটুকু কমেনি, বরং দিনকে দিন বেড়েই চলে। আর জগদীশচন্দ্রের এ ব্যাপারটাই ভগিনী নিবেদিতাকে বিষ্মিত করেছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গবেষণার কাজও চলতে থাকে। প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষকতা কালে তিনি ছাত্র হিসাবে পেয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ, শিশির কুমার মিত্র, দেবেন্দ্রমোহন বসু প্রমুখ ব্যক্তিবর্গকে। 
  
কলেজে গবেষণার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় ২৪ বর্গফুট (২.২ বর্গমিটার) একটি ছোট ঘরে গবেষণার কাজ চালিয়ে যান তিনি। সে-সময় তাঁর অর্থ সংকট প্রকট ছিল। তিনি সীমিত অর্থ ব্যয়ে স্থানীয় মিস্ত্রীদের শিখিয়ে পড়িয়ে গবেষণার জন্য উপকরণ প্রস্তুত করতেন। তাঁর এই কাজগুলোর গুরুত্ব বিচার করে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ১৮৯৬ সালের মে মাসে তাঁকে D.Sc. খেতাব প্রদান করে। 

ঊনবিংশ শতকের শেষ দশকে তিনি খুব ক্ষুদ্র দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ আবিষ্কারে মনোনিবেশ করেন। ১৮৯৫ সালে অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ সৃষ্টি এবং কোনও তার ছাড়া এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তা প্রেরণ করার পরীক্ষায় তিনি সফলতা পান। জগদীশচন্দ্র সর্বপ্রথম ৫ মিলিমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিশিষ্ট তরঙ্গ তৈরি করেন। এ ধরনের তরঙ্গকে অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ বা মাইক্রোওয়েভ বলা হয়। উল্লেখ্য, দৃশ্যমান আলো, মৃদু এক্স-রশ্মি ও তীব্র গামা রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য যথাক্রমে ১০^(–৫), ১০^(–৭) ও ১০^(–১০) সেন্টিমিটার মাপের। আধুনিক রাডার, টেলিভিশন ও মহাকাশ যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই মাইক্রো তরঙ্গের অবদান অনস্বীকার্য। মূলত এর মাধ্যমেই বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ তথ্যের আদান প্রদান ঘটে থাকে। ফলে এই কলকাতা শহরে জন্ম হল বিশ্বের প্রথম মাইক্রোতরঙ্গ। এই পাঁচ মিলিমিটার তড়িৎচুম্বকীর তরঙ্গের সাহায্যে তিনি দৃশ্য আলো ও অদৃশ্য আলো'র সহধর্মিতা প্রমাণ করতে সক্ষম হলেন।

১৮৯৫ সালে কলকাতার টাউন হলে এই মাইক্রোওয়েভের সাহায্যে বিনা তারে সংবাদ প্রেরণ করার সফল পরীক্ষা করেছিলেন। তাঁর প্রথম চেষ্টাতে বিনা তারে সংবাদ প্রায় ৭৫ ফুট দূরত্ব অতিক্রম করতে সমর্থ হয়। মাঝে দুটি দেওয়াল ভেদ করে। টাউন হলে সেদিন উপস্থিত ছিলেন বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জি। অবশ্য তাঁর এই বিপুল সাফল্য অচিরেই বেদনার অন্ধকারে ঢেকে গেল। কারণ এ হেন ঘটনা তিনি অনেক পূর্বে আবিষ্কার করলেও ইতালির বিজ্ঞানী গুগ্লিয়েল্মো মার্কনি জগদীশচন্দ্রের আগেই পেটেন্ট আকারে প্রকাশ করে ফেলেন। ফলে সিংহভাগ কৃতিত্ব মার্কনির দখলে চলে যায়। অবশ্য তার বিহীন যোগাযোগ ব্যবস্থার জনক (Father of Wireless communication) হিসেবে জগদীশচন্দ্র বসু খ্যাতি লাভ করেন।

যদিও শ্রীবসুর নাম স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করা আছে অন্য একটি ঘটনা আবিষ্কারের সৌজন্যে। তা হল গাছের প্রাণ। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন উদ্ভিদ উত্তেজনায় সাড়া দেয়। সেই ঘটনা প্রমাণ করবার জন্য বিংশ শতকের শুরুর দিকে তিনি ক্রেসকোগ্রাফ যন্ত্র উদ্ভাবন করেন। এটি উদ্ভিদের বৃদ্ধিমাপক যন্ত্র। ঘড়ির যন্ত্রাংশ ও ধোঁয়া সিঞ্চিত কাচের প্লেটের মাধ্যমে তিনি এই যন্ত্রটি তৈরি করেন। এর সাহায্যে গাছের অগ্রভাগের বৃদ্ধি এক ইঞ্চির ১০,০০০ ভাগের এক ভাগ সুক্ষ্মতায় পরিমাপ করতে সমর্থ। যন্ত্রে দুটি লিভার আছে। প্রতিটি লিভারের বিবর্ধণ ক্ষমতা ১০০ গুণ। 

এর বৈদ্যুতিক যন্ত্রটি এক ইঞ্চির দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ সূক্ষ্ম পরিমাণে উদ্ভিদের বৃদ্ধি পরিমাপ করতে পারে। কলকাতার বসু বিজ্ঞান মন্দিরে ক্রেসকোগ্রাফ যন্ত্রের একটি মডেল আজও সংরক্ষিত আছে। 
                  

১৯১৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করলেন তিনি। অবসর গ্রহণের পর দেশীয় রাজা মহারাজাদের দান ও নিজের সঞ্চিত অর্থে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রতিষ্ঠান 'Bose Research Institute' (বসু বিজ্ঞান মন্দির) প্রতিষ্ঠা করলেন ১৯১৭ সালে। সেখানে আমৃত্যু গবেষণায় ডুবে রইলেন। ১৯১৬ সালে 'নাইটহুড' উপাধিতে সম্মানিত হন। ১৯২০ সালে ইংল্যান্ডের 'রয়্যাল সোসাইটি অব সায়েন্স'-এর সদস্য নির্বাচিত হন।

১৮৯৬-তে তিনি প্রথম বাংলা ভাষায় কল্প-বিজ্ঞানের প্রবন্ধ লেখেন। 'নিরুদ্দেশের কাহিনী' বাংলা ভাষায় মুদ্রিত সর্বপ্রথম তাঁর সায়েন্স ফিকশন প্রবন্ধ। বোধিসত্ত্ব চট্টোপাধ্যায় তার ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। এ ছাড়া শ্রীবসু আরও অনেক পুস্তক লিখেছেন। যেমন অব্যক্ত (১৯২২), Response in the Living and Non-living (১৯০২), Plant response as a means of physiological investigation (১৯০৬), The Nervous mechanisms of Plants (১৯২৬), Motor Mechanism of Plants (১৯২৮) প্রভৃতি।

জগদীশচন্দ্র বসু যে গ্যালিলিও-নিউটনের সমকক্ষ বিজ্ঞানী ছিলেন, তার স্বীকৃতি দিয়েছিল লন্ডনের ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকা, ১৯২৭ সালে। বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন তাঁর সম্পর্কে বলেছেন― 'জগদীশচন্দ্র যে অমূল্য তথ্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন তার যে কোনটির জন্য বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত।' 

তাঁর প্রিয় বান্ধব বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঋষিতুল্য বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র সম্বন্ধে বলেছেন― 'ভারতের কোন বৃদ্ধ ঋষির তরুণ মূর্তি তুমি হে আর্য আচার্য জগদীশ।' 

তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। একাধারে তিনি পদার্থবিদ, উদ্ভিদবিদ, জীববিজ্ঞানী ও কল্পবিজ্ঞানের রচয়িতা। এ হেন বিজ্ঞানীকে সম্মান জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ চাঁদে একটি গভীর খাদের (Crater) নামকরণ আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর নামে রাখা হয়― 'Bose Crater'। সেটি ৯১ কিলোমিটার চওড়া এবং চাঁদের দূরতম প্রান্তে অবস্থিত।

অতি সম্প্রতি ব্যাংক অব ইংল্যান্ড তাদের ৫০ পাউন্ড নোটে নতুন কোন বিখ্যাত মানুষের মুখ যুক্ত করার জন্য নমিনেশন দিয়েছে। তাদের মতে, গত ২৬ নভেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত প্রায় ১,৭৫,০০০ নমিনেশন গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে তারা ১,১৪,০০০ নমিনেশন প্রকাশ করে যেখানে স্যার জগদীশচন্দ্র বসুকে সেরা তালিকায় মনোনীত করা হয়েছে। মূলত তাঁর তার বিহীন প্রযুক্তির কথা মাথায় রাখা হয়েছে, আজকে যার কল্যাণে আমরা ওয়াইফাই, ব্লুটুথ, স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ খুব সহজে ব্যবহার করতে পারছি। তাই যদি নির্বাচিত হয়, তাহলে ২০২০ সালে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের ৫০ পাউণ্ডের নোটে দেখা যাবে এই মহান বিজ্ঞানীর নাম ও ছবি।

এ হেন মহান বিজ্ঞানী ১৯৩৭ সালের ২৩-শে নভেম্বর ৭৮ বছর বয়সে ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমানে ঝাড়খণ্ড) অন্তর্ভুক্ত গিরিডিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এই মহান বিজ্ঞানীর চরনে আমার ভূমিষ্ঠ প্রণাম, আন্তরিক ভালোবাসা এবং অবনত মস্তকে অপরিসীম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇


আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments