জ্বলদর্চি

দিল্লি দর্পন – ১৮ /কালীপদ চক্রবর্ত্তী

দিল্লি দর্পন – ১৮

কালীপদ চক্রবর্ত্তী, নতুন দিল্লি

কিছু দ্রষ্টব্য স্থান

করোনা মহামারীর প্রকোপ দিল্লিতে কিছুদিন আগে কমে গিয়েছিল কিন্তু এখন আবার চারগুণ বেশি হয়েছে ঠিকই কিন্তু দিল্লি আজও থেমে নেই প্রতিদিন এগিয়ে চলেছে তাঁর তীব্র গতিতে। ভিড় ক্রমশই বেড়ে চলেছে। অনেক বছর আগে একটি পরিসংখ্যানে দেখেছিলাম, দিল্লিতে প্রতিদিন ৫০০ নতুন মোটর গাড়ি রাস্তায় চলাচল শুরু করে। এখন সংখ্যাটা নিশ্চয়ই আরও অনেক বেড়ে গেছে। আজকাল প্রদূষণ ও বহু অঘটনের কথাও পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। কিন্তু কোথাও কোনও বিরাম চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। সবাই দৌড়ে চলেছে যেন দম দেওয়া কলের পুতুলের মত।  
দিল্লিতে বেড়াতে এলে যে জায়গাগুলো না দেখলে ভ্রমণ অসমাপ্ত থেকে যাবে তা হল – ইণ্ডিয়া গেট, রাষ্ট্রপতি ভবন, মুঘল গার্ডেন, যন্তর মন্তর, রাজঘাট, শক্তি-স্থল, বীরভূমি, লাল কেল্লা, জামা মসজিদ, কুতুব মিনার বাহাই মন্দির বা লোটাস টেম্পল, বিড়লা মন্দির, দিল্লির কালীবাড়িগুলো ইত্যাদি। বর্তমানে রেপ্লিকা পার্ক একটি নতুন সংযোজন। 
দিল্লির লাল কেল্লা হল পুরাতন আর ঐতিহ্যবাহী একটি স্থাপত্য। পুরাতন দিল্লির চাঁদনী চকের বিপরীতে এটি অবস্থিত। এই দুর্গটি মোঘল সাম্রাজ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। দুর্গের দেওয়ালটি প্রায় ২ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। লাল ইটের এই দেওয়ালটি তৈরি করা হয়েছিল শত্রুর আক্রমণ থেকে দুর্গকে রক্ষা করার জন্য। পর্যটকদের মনে মোঘল সাম্রাজ্যের সেই প্রাচীন অনুভূতি এনে দিতে প্রতিদিন সন্ধ্যায় একটি লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো হয় যেখানে ইতিহাসের বেশ কিছু ঘটনা তুলে ধরা হয় দর্শকদের সামনে। লাল কেল্লায় প্রবেশের এবং লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো দেখতে প্রবেশ মূল্য লাগে। সোমবার বন্ধ থাকে।
জামা মসজিদ ও পুরাতন দিল্লির আরেকটি চমৎকার স্থাপনা। এটি ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় মসজিদ। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে এই মসজিদের অঙ্গনে একসাথে ২৫০০ জন একসাথে নমাজ পড়তে পারেন। জানা যায় এই মসজিদটি তৈরি করতে সময় লেগেছিল প্রায় ১৩ বছর। এটি প্রতিদিনই খোলা থাকে তবে নমাজের সময় প্রবেশ নিষেধ এবং সূর্যাস্তের আগে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

পুরাতন দিল্লির প্রধান রাস্তা হল চাঁদনী চক। এখানে অনেক কিছুই পাবেন। আগে যে পরাঠাওয়ালা গলির ও দোকানের উল্লেখ করেছিলাম তা এখানেই দেখতে পাওয়া যায়। ছোট্ট সরু গলির মধ্যে অসংখ্য পরটার দোকান। একসময় এই গলি দেশি ঘি দিয়ে তৈরি পরোটার জন্য বিখ্যাত ছিল। দূর-দূরান্ত থেকে লোকেরা ছুটে আসতো এখানকার পরটা খেতে। সেখানে মাটির পাত্রে দেশি ঘি দিয়ে পরোটা বানিয়ে গরম গরম অনেক রকম তরকারির এবং আচারের সাথে পরিবেশন করা হয়। তবে আজকাল সে স্বাদে ভাঁটা পড়েছে। দিল্লিতে স্ট্রীট ফুডের স্বাদ নিতে হলে চাঁদনী চকের একসময় খুবই নাম ডাক ছিল। 
আমাদের যেমন কলেজ স্ট্রীট আছে এখানেও তেমনি বই-এর বড় বাজার আছে। নাম চাউরি বাজার। নতুন, পুরাতন বই, খাতা সবই এখানে পাওয়া যায়। ম্যানেজমেন্ট পড়ার সময় আমিও এই বাজারে বেশ কয়েকবার গেছি। কিনারী বাজার-এ পাবেন নাটক, যাত্রার বিভিন্ন জিনিসপত্র এবং মহিলাদের হাতের কাজের বিভিন্ন সামগ্রী। কলকাতার বড়বাজারের মত এখানে আছে ‘সদর বাজার’। খাড়ি বাউলি-তে পাবেন বিভিন্ন মশলা-পাতি, কাঁচামাল ইত্যাদি। চাঁদনী চকের ভগীরথ প্লেস আজও ইলেকট্রিকের পাইকারী ও খুচরো বাজার হিসেবে বিখ্যাত।  দিল্লিতে ইলেকট্রনিক্স এবং মোবাইল-এর বাজার হিসেবে জন্য বিখ্যাত করোল বাগের গফর মার্কেট। তবে অভিজ্ঞ লোক না হলে ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে খুব বেশি। কম্পিউটার এবং কম্পিউটারের সামগ্রীর জন্য এশিয়ার মধ্যে বিখ্যাত একটি বাজার হল ‘নেহেরু প্লেস’। সেখানে সস্তায় অঢেল সফটওয়্যারও পেয়ে যাবেন, তবে দেখে কিনতে হবে এবং দরদাম করতে হবে। 
২০০৫ সালে দিল্লিতে তৈরি হয় স্বামী নারায়ণ অক্ষর ধাম। ভারতীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরার জন্য এটি নির্মাণ করা হয়। মন্দিরের মঠগুলোতে ব্যবহার করা হয়েছে অদ্ভুত সুন্দর সুন্দর সব গোলাপি পাথর আর সাদা মার্বেল। ভেতরে রয়েছে বিশাল বাগান আর নৌকা চড়ার ব্যবস্থা। মন্দিরের ভেতরে মোবাইল এবং ক্যামেরা নিয়ে এখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ। এটি যমুনার তীরে এবং নয়ডা মোড়ের কাছে। 

এছাড়াও এখানে দেখার জন্য আছে বাদশা হুমায়ূনের কবর (টুম্ব)। মুঘল সাম্রাজ্যের  ২য় বাদশাহ হুমায়ূনের কবর দেওয়া হয় একটি রাজমহল নির্মাণ করে। ভারতবর্ষে এটিই প্রথম এ ধরণের স্থাপত্য। এরপর সাড়া ভারত জুড়ে মুঘলরা এরকম আরও অনেক স্থাপত্য নির্মাণ করেছেন। বাদশা হুমায়ূনের কবরটি ভবনের বিশাল কমপ্লেক্স জুড়ে করা হয়েছে । ভেতরের সাজানো গোছানো বাগানটিও অতি মনোরম। এটি নিজামুদ্দীন স্টেশন থেকে বেশি দূরে নয়। এখানেও প্রবেশ করতে হলে প্রবেশ মূল্য লাগে।
দিল্লির কুতুব মিনারের নাম তো সকলেরই জানা। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু মিনার হল দিল্লির এই কুতুব মিনার। এটি পুরাতন ভারতবর্ষের আর্কিটেকচারের একটি অনন্য নিদর্শন। এখানেও প্রবেশ করতে হলে আপনাকে টিকিট কেটে ঢুকতে হবে। এটি মেহরোলীতে অবস্থিত। 

দিল্লির লোদী গার্ডেনে গেলেই আপনার মনে হবে আপনি শহুরে জীবন থেকে যেন প্রশান্তির এক জায়গায় পৌঁছে গেছেন। ক্লান্ত অবসান্ত মনকে বিশ্রাম দিতে এখানে ভিড় করে পর্যটকেরা। অনেকেই সকালে জগিং করতে বা যোগ ব্যায়াম করতে নিয়মিত এখানে আসেন। তরুণ যুগলদেরও প্রিয় জায়গা এটি।
এই প্রসঙ্গে জানাই, দিল্লিতেও যে ছোট-খাট জঙ্গল পরিবেষ্টিত পার্ক আছে তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন ছিল। যেমন সাউথ দিল্লিতে ডিয়ার পার্ক এবং শেখ সরাই, ফেস – ২ এর কাছে জাঁহাপনা ফরেস্ট একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এরকম আরও কয়েকটি জায়গা আছে দিল্লিতে। কলকাতা থেকে বেড়াতে এসে একবার একজন আমাকে বলেছিলেন, দিল্লিতে এরকম জঙ্গল থাকতে পারে তা কল্পনাও করা যায় না। 

১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারিতে গান্ধীজীকে হত্যা করা হয়। তাঁর স্মৃতি-তে এখানে আছে গান্ধী স্মৃতি মেমোরিয়াল। আমাদের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী-কে যেখানে হত্যা করা হয়েছিল সেখানেও গড়ে উঠেছে একটি স্মৃতি মিউজিয়াম। আজকাল সেটিও একটি দর্শনীয় স্থান । 
ইন্ডিয়া গেট-এ গেলে দেখতে পাবেন ব্রিটিশদের হয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ হারানো শহীদদের স্মরণে একটি স্থাপনা। এখানে ২৪ ঘণ্টা অমর জোয়ান জ্যোতি জ্বলতে থাকে। এখানে শীতের দুপুর এবং গ্রীষ্মকালীন বিকেল কাটানোর আদর্শ জায়গা। দিল্লি বেড়াতে এলে এই অনন্য স্মৃতি স্থাপনা দেখতে আসেন না এরকম পর্যটক খুঁজে পাওয়া ভার। এর কাছেই বীর জোয়ানদের জন্য সম্প্রতি তৈরি হয়েছে একটি মিউজিয়াম।

দিল্লির লোটাস টেম্পল বা বাহাই মন্দিরটি দেখতে পদ্ম ফুলের মত। রাতের আলোতে সজ্জিত এই মন্দিরটি দেখতে অপূর্ব লাগে। মন্দিরটি সাদা মার্বেলের তৈরি। বাহাই ধর্মাবলম্বীদের মন্দির এটি। এরা সমস্ত মানুষের মধ্যে ভালবাসা ও সৌহার্দ্যে বিশ্বাস করেন। যে কেউ এখানে এসে প্রার্থনা করতে পারেন। মন্দির ঘিরে থাকা বাগানটিও বেশ সুন্দর। 

দিল্লিতে সম্প্রতি চালু হয়েছে  রেপ্লিকা পার্ক নামে একটি থিম পার্ক। সেখানে গেলে দেখতে পাবেন বর্জ্য (ফেলে দেওয়া) দিয়ে বানানো আইফেল টাওয়ার, তাজমহল, পিসার লিনিং টাওয়ার ইত্যাদি। দক্ষিণ দিল্লি পৌরসভা (এস ডি এম সি) এটিকে নাম দিয়েছেন ‘ওয়ান্ডার্স অফ ওয়ার্ল্ড পার্ক’। 
দেখলে দর্শকেরা অবাক হবেন যে শিল্প-কলকারখানার ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে ছয় একর জায়গায় থিম পার্কটির সব ভাস্কর্য ও রেপ্লিকা তৈরি হয়েছে। বর্জ্য থেকে শিল্প ধারণাকে জনপ্রিয় করতেই এমন উদ্যোগ। জানা যায়, সব মিলিয়ে প্রায় ১১০ টন (অন্য একজন বললেন ১৫০ টন) বর্জ্য লেগেছে এটি বানাতে। একইসঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে গড়ির যন্ত্রাংশ।   

রেপ্লিকাগুলোর একেকটির উচ্চতা একেক রকম। সব রেপ্লিকার পাশে সেলফি তোলার সুবিধের জন্য রাখা হয়েছে বিশেষ স্থান। পার্কের আলোকসজ্জা, বিভিন্ন থিমের সবুজ এলাকা, সোলার প্যানেল, ক্যাফেটেরিয়া, শিশুদের খেলাধুলার বিশেষ স্থান ও হর্টিকালচার বিভাগের বিভিন্ন প্রকল্প দর্শকদের মুগ্ধ করবেই। 
খোঁজ নিয়ে জানলাম, এই পার্কটি নাকি রাজস্থানের কোটায় অবস্থিত ‘ 7 Wonders Park’ – এর অনুপ্রেরণায় তৈরি হয়েছে। কোটায় কিশোর সাগর লেক সংলগ্ন একইরকম একটি পার্ক আছে। এটির নির্মাণ করতে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ২০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে ওই পার্কটির উদ্বোধন হয়। তবে সেখানকার রেপ্লিকাগুলো বর্জ্য দিয়ে বানানো নয়। দিল্লির এই পার্কটি তৈরি করতে প্রায় ৭,৫০,০০,০০০ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানা গেল। এই পার্কে প্রবেশ করতে গেলে তিন বছর পর্যন্ত শিশুদের এবং ৬৫ বছরের বেশি ঊর্ধ্বে লোকেদের কোনও প্রবেশ মূল্য লাগেনা। 

জিনিসপত্র কেনার জন্য দিল্লিতে অজস্র মল আছে, আছে পাড়ায় পাড়ায় দোকান। তবে করোলবাগ এবং সরোজিনী নগর মার্কেটের পক্ষে অনেকেই রায় দেবেন। কোয়ালিটির বা মূল্যবান জিনিস কিনতে হলে কর্নাটপ্লেস, লাজপথ নগরে খুঁজে দেখতে পারেন। বিদেশী জিনিস দিল্লির বহু জায়গাতেই পাওয়া যায়, তবে কর্ণাট প্লেসের আন্ডারগ্রাউন্ড পালিকা বাজারও ঘুরে দেখতে পারেন। দরদাম করতে পারলে সস্তায় অনেক কিছুই পেয়ে যেতে পারেন, তবে ঠকবার চান্সও আছে।

Post a Comment

1 Comments

  1. Please share the contact details of Mr Kalipada Chakraborty,Delhi.Thanks.

    ReplyDelete