অঙ্কুরীশা : শারদীয়া আন্তর্জাল সংখ্যা ১৪২৭
হিমাদ্রিশেখর রায়
বিগত ৮ মাস সারা বিশ্বজুড়ে এক অদৃশ্য ভাইরাসের সম্ভ্রাস সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় এবং কর্মক্ষেত্রে ব্যাপক বিপর্যয় আর বিঘ্ন ঘটিয়েছে। মুদ্রণ এবং প্রকাশনা ব্যবস্থা তার থেকে অব্যহতি পায়নি। ফলে ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে বহু সাহিত্য পত্রিকা তাদের মুদ্রিত সংখ্যা প্রকাশ করতে সমর্থ হয়নি বেশ কিছু সময়। কিন্তু মানুষের সৃজনশীলতা তো আর থেমে থাকতে পারে না, যে কোনও বাধাকেই তা এক সময় অতিক্রম করে তার প্রবাহমানতায় অক্ষুণ্ণ থাকবার চেষ্টা করে। বহু সম্পাদক তাঁদের পত্রিকার মুদ্রিত সংখ্যার পরিবর্তে ইন্টারনেট সংখ্যা(আন্তর্জাল) প্রকাশ করতে থাকেন। গৃহবন্দি সাহিত্যিকেরা তাঁদের সৃজনকর্মে মগ্ন হয়ে ওঠেন নতুন উদ্যমে। পাঠকের মোবাইল ফোনে অথবা কম্পিউটারে ভেসে আসে বিভিন্ন সাহিত্য পত্রের আন্তর্জাল অবয়ব।
এভাবেই আমাদের কাছে এল পূর্ব মেদিনীপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রাম চৌদ্দচুলী থেকে প্রকাশিত একটি সাহিত্য পত্রিকার শারদীয় সংখ্যা—অঙ্কুরীশা (সম্পাদক: বিমল মণ্ডল) দৃষ্টিনন্দন ডিটিপি মুদ্রণে গ্রন্থিত ৩৬ পাতার এক শুদ্ধ সাহিত্য প্রয়াস। এই স্বল্প পরিসরে সাহিত্যের সব ধারাকেই সম্পাদক পরিবেশন করেছেন। আমরা পেয়েছি ৪টি প্রবন্ধ/ব্যক্তিগত গদ্য, ১টি রম্যরচনা, দুই পর্বে ১১টি অণুগল্প এবং চারপর্বে ৫৫টি কবিতা। সে হিসেবে দেখলে এই টালমাটাল অস্থির সময়কে উপেক্ষা করে, বিশ্বত্রাস অতিমারিকে পরোয়া না করে অঙ্কুরীশার সম্পাদক সাহিত্যের ভুরিভোজে বিভিন্ন স্বাদ ও বর্ণের ৭১টি পদ পাঠককে উপহার দিয়েছেন।
কবি আশিস মিশ্রের গদ্য বরাবরই সুখপাঠ্য—তিনি তাঁর নিজস্ব রম্য কলমের টানে "মাস সাতেক সতেরো কিলোমিটার ও তারপর"... নিবন্ধে পাঠকের প্রত্যাশা পূরণ করেছেন। প্রাবন্ধিক তুলসীদাস মাইতির "বিদ্যাসাগরের মহত্ত্ব" প্রবন্ধটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলেখ্য। তিনি বিদ্যাসাগরের বিপুল কর্মকাণ্ডকে তিনটি উল্লেখযোগ্য শ্রেণিতে বিভাজন করে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। তাঁর শ্রেণি বিভাজন এই ধরনের: ক.ধর্মবাদ দিয়ে সমাজ সংস্কার আন্দোলন; খ. শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন; গ.গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশ। লেখক অনীশ ঘোষ "আমার শিক্ষক" শিরোনামে তাঁর কিশোর কালের স্কুল শিক্ষকের এক স্মৃতি মেদুর স্মৃতিচারণে তাঁর জীবনে এক বরেণ্য শিক্ষকের অবদানের ঋণ স্বীকার করেছেন। কবি সম্পাদক বিমল মণ্ডল মার্কিন সাহিত্যিক "এডগার অ্যালান পো-র সাহিত্য" প্রবন্ধে বিশ্লেষণমূলক বিস্তৃত আলোচনা ও তাঁর কবিতা অনুবাদ করেছেন। রচনাটি ও অনুবাদ থেকে পাঠক এই বিদেশী সাহিত্যিকের রচনাশৈলীর একটি স্বচ্ছ রূপরেখা পেতে পারেন।
গল্প বিভাগের শিরোনামে 'অণুগল্প' বলা হলেও অনেকেই অণুগল্পের লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম করে গেছেন— সে ক্ষেত্রে তাঁদের রচনার সংজ্ঞা হতে পারতো 'ছোটগল্প' । গল্পগুলির নির্বাচনে এই সামান্য ত্রুটিকে উপেক্ষা করলে উল্লেখযোগ্য গল্প লিখেছেন কালীপদ চক্রবর্তী, অশোক রায়, শংকর ব্রম্ম,অনন্ত কৃষ্ণ দে, মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি প্রমুখেরা। কবির কাঞ্চন-এর শিশুতোষ গল্পটি মনে দাগ কাটে।
বহু কবিতাই সুলিখিত এবং যথেষ্ট কাব্যগুণ সম্পন্ন এবং সম্পাদক যে বিলক্ষণ নির্বাচনের ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন -তা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না। ছড়া ও কবিতায় প্রবীণ ও স্বনামধন্যদের মধ্যে ছিলেন জ্যোতির্ময় দাশ, রতনতনু ঘাটী, যশোধরা রায় চৌধুরী, বীথি চট্টোপাধ্যায়, দীপ মুখোপাধ্যায়,অশ্রুরঞ্জন চক্রবর্তী, গৌতম হাজরা, সৌমিত বসু, বিপ্লব চক্রবর্তী প্রমুখেরা। নবীনরাও ভালো কবিতা উপহার দিয়েছেন। সুখপাঠ্য রম্যরচনা লিখেছেন কৃপাণ মৈত্র।
সর্বোপরি বলা যায় ৩৬ পাতার ই-ম্যাগাজিনের উপস্থাপনা ও অঙ্গসৌষ্ঠব যথেষ্ট সুরুচিসম্পন্ন ও দৃষ্টি সুখকর। সম্পাদক ও কলাকুশলীদের ধন্যবাদ জানাই।
------------
আরও পড়ুন
0 Comments