জ্বলদর্চি

কুরকুট: জঙ্গলমহলের অনাহার ও স্বাদের আহার/সূর্যকান্ত মাহাতো

কুরকুট: জঙ্গলমহলের অনাহার ও স্বাদের আহার

সূর্যকান্ত মাহাতো

আপাদমস্তক শালবৃক্ষে মোড়া ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ী থেকে আরোও অনেকটাই ভিতরে একেবারে ঝাড়খন্ড লাগোয়া প্রত্যন্ত এক গ্রাম 'আমলাশোল' বেশ কিছু বছর আগে হঠাৎই খবরের শিরোনামে এসেছিল। চারিদিকে তখন ঢি ঢি পড়ে গিয়েছিল এমন সংবাদ শিরোনামে। তা, কী এমন ছিল সেই সংবাদ শিরোনামে? না, অনাহারে এখানকার মানুষ পিঁপড়ের ডিম খেয়ে বেঁচে আছে। গোটা পশ্চিমবঙ্গ সহ এলিট সমাজের মানুষেরা এমন অভিনব সংবাদ শিরোনামে শিউরে উঠেছিল সে সময়। তারপর অনাহার যে কি ভয়ঙ্কর হতে পারে তার একটা নির্মম ছবির কল্পনা সকলেই কম বেশি মনে মনে গেঁথেও নিয়েছিলেন। এমনকি জঙ্গলমহলের জঙ্গলঘেরা গ্রামবাসী সম্পর্কেও শহর ঘেঁষা বাবুদের মনে তখন একটা হীন ধারণাও গড়ে উঠেছিল। শুধু কি তাই? পিঁপড়ে খাওয়া মানুষগুলো তাদের কাছে তখন একেবারেই  অপাঙতেয় হয়ে পড়েছিল। কারণ পিঁপড়ে ও তার ডিমের মতো নিকৃষ্ট মানের অখাদ্য খাবার খাওয়াটা তাদের চোখে একটু কেমন যেন ছিল!

তৎকালীন সময়ে অনাহারের প্রেক্ষাপটটাকে কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না। এমনকি উন্নয়নের আলোটাও সে সময় এইসব প্রত্যন্ত এলাকায় অনেকটাই ম্রিয়মাণ ছিল। তাই পিঁপড়ে বা তার ডিম খাওয়াটা সংবাদের পক্ষে তখন সত্যিই একটা লোভনীয় বিষয় ছিল। কিন্তু বাস্তবটা ঠিক এমন ছিল না। পিঁপড়ে খাওয়াটা কোন অবাক করা ব্যাপার বা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।  বরং অনেক বেশি স্বাভাবিক ছিল।কারণ এই প্রজাতির পিঁপড়ে হল এখানকার একটি আহার্য খাবার। এটা কোন অভাবের আহার নয়, বরং অনেকটাই স্বাদের আহার।
তা কী এমন এই পিঁপড়ে! আর যার জন্য চারিদিকে কেনই বা এত আওয়াজ উঠেছিল? চলুন সেটাই দেখা যাক--- হালকা কমলা কিংবা তামাটে বর্ণের অত্যন্ত ক্ষিপ্র প্রজাতির এই পিঁপড়ে জঙ্গলমহলে  "কুরকুট" নামে পরিচিত। অনেকটা বড়ো আকারের হয় এই পিঁপড়ে। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম-OECOPHYLLA SP সাঁওতাল সম্প্রদায় একে "হাউ" বা "হাও" নামেও ডাকে। গাছের এডাল থেকে ওডাল হয়ে মগডাল সর্বত্র এরা দ্রুত গতিতে ঘোরাফেরা করতে পারে। একবার আক্রান্ত হলেই ছয় পায়ের কাঁটাযুক্ত খাঁজে শত্রুকে চেপে ধরে মরণপণ কামড় লাগায়। আর কামড়ানোর ভঙ্গিটাও বেশ, পিছনের অংশটিকে যতটা সম্ভব উপরে তুলে শরীরটাকে বাঁকিয়ে শেষ কামড়টা বসায়। তখন মুখ থেকে একটু এসিড  জাতীয় তরল কিছু নিঃসৃত হয়। এদের কামড়ে সাময়িক ভাবে একটু জ্বালা করে। অনেক সময় আবার লাল হয়ে একটু ফুলেও যেতে পারে। তবে বিরাট কিছু ভয়ের নয়। এদের সঙ্গে বসবাসকারী চির পরিচিত মানুষেরা এদের তেমন একটা ভয়ও পান না।
কুরকুটের বাসাটাও দারুন! আম জাম শাল সহ যেকোন ধরনের একটু বড় পাতাযুক্ত শাখা-প্রশাখার মগডালের কয়েকটা পাতাকে শরীর নিঃসৃত সাদা ও ঘন জালের মতো একধরনের আঠা জাতীয় পর্দা দিয়ে পরিপাটি করে মুড়ে আটকে দেয়। ভিতরটা বেশ গর্তের মতো তৈরি করে একটা খোলের আকারের ঠোঙা বানায়। আর এটাই হল ওদের বাসা বা ঘর। ঝড় বৃষ্টি সহ আরও নানা বাহ্যিক আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্যই এমন বাসা নির্মাণ করে। আর সেখানে দলবদ্ধ ভাবে তারা বসবাস করে। ফলের রস ও ছোট ছোট উইপোকার মতো গাছ পোকার রস  খেয়ে জীবন ধারণ করে।

কুরকুটের শরীরটাও অদ্ভুত। মুখসহ চারটি ডিম্বাকার অংশ একে অপরের সঙ্গে অনেকটা রেলের কামরার মতো জুড়ে থাকে। প্রথম অংশটি হল মুখ। মুখের মধ্যিখানে দুটো গোলাকার ঘন কালো চোখ। এরপর ছোট ছোট দুটি শরীরে অংশ। যা সামনের ও পিছনের তুলনায় অনেকটাই ছোট। অবশেষে বেশ বড় আকারের পিছনের অংশ। ডিম্বাকার এই অংশটি  একধরণের তরল জলীয় অংশে বেশ পুষ্ট। জলীয় অংশে ভরপুর এই তরলটি বেশ স্বাদযুক্ত। এর স্বাদ হল "টক।"
কুরকুট ঠিক কোন ধরনের খাবার? যেহেতু কুরকুটের স্বাদ টক তাই মূলত "চাটনি" হিসাবেই অধিক জনপ্রিয়। সর্ষের তেল আর কাঁচালঙ্কা ভালো করে মাখিয়ে বেটে এর স্বাদকে আরও দ্বিগুণ বাড়ানো হয়। এছাড়াও ঝোল সহ কুরকুটের আরও নানান ধরনের সুস্বাদু পদ রান্না করা যায়। তবে চাটনিটাই সেরা রান্নার পদ হিসাবে পরিচিত। এই চাটনির স্বাদে জিভের স্বদেরও বেশ একটা বদল আসে।

তবে পথ্য হিসাবে এর উপকারিতা নিয়ে নানান মতভেদ আছে। কারও মতে জ্বর সর্দি কাশিতে মুখ যখন বিস্বাদ হয়ে উঠে তখন কুরকুটের চাটনিই সব থেকে বেশি উপকারী। কেউ বা বলেন, সর্দিকাশির উপশমেও নাকি কুরকুটের যথেষ্ট ভূমিকা আছে। অনেকে আবার শাল পাতায় মুড়ে কুরকুটের শরীরের ওমটুকু গ্রহণ করতে সিগারেটের মতো করে টানও দেয়। এতে গলার অস্বস্তি ভাবটা নাকি চলে যায়। স্বাদ যেহেতু টক, তাই ভিটামিন সি থাকে যথেষ্ট।
এখনতো গোটা জঙ্গলমহল জুড়ে মাছের "চার"(খাবার) হিসাবেও কুরকুটের ডিমের ব্যাপক চাহিদা। অন্যান্য মশলার উপকরণ দিয়ে বানানো কুরকুটের ডিমকে মাছের শ্রেষ্ঠ 'চার' হিসাবে মানেন জঙ্গলমহলের মৎস্য শিকারিরা। বাজারে কিংবা হাটের দিনে তাই চাহিদা মতো কুরকুট ও তার ডিম বিক্রিও হয়। এভাবে অনেকে জীবিকাও নির্বাহ করেন।

বেশ সাবধানতা ও যত্ন নিয়ে কুরকুট ও তার ডিম সংগ্রহ করতে হয়। বড় ছাতা কিংবা পাত্রে কুরকুট ভর্তি পাতার ঠোঙাটি প্রথমে গাছ থেকে পেড়ে এনে ঝেড়ে ঝেড়ে সংগ্রহ করতে হয়। তবে জল দিয়ে ঘিরে ডিমগুলো পত্রের মধ্যিখানে ঢেলে দিলে কুরকুট গুলো জলে আটকে পড়ে। আবার ডিমগুলোও অক্ষত থাকে। এমনভাবেও সংগ্রহ করা যায়।

কুরকুট বা পিঁপড়ের ডিম খাওয়ার পিছনে অনাহারের যে করুণ চিত্রটি প্রতিফলিত হয়েছিল, সেটাও যেমন সত্যি, খাবার হিসাবেও সেটা যে গ্রহণ করা হয় এটাও সমান সত্যি। তাই পূর্ণাঙ্গ চিত্রের পরিসরটা ছিল আরো বড়। না হলে কিছুটা শহর ঘেঁষা মানুষেরা কুরকুট খেত না। তাছাড়া আজ পাকা রাস্তাঘাট, বিদ্যুতের আলো, রেশন ব্যবস্থার এত উন্নতির পরেও তো কিছু কিছু মানুষ এখনও এটা খাবার হিসাবেই গ্রহণ করে থাকেন। কারণ এটা আহারের বস্তু বলে। তাছাড়া জঙ্গলমহলের বেশ কিছু আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ এখনও মেঠো ইঁদুর বা বড় জাতীয় রাজ ব্যাঙ খায়। তাহলে কি বলা যায় যে তারা ইঁদুর ব্যাঙ খেয়েই বেঁচে আছে? নাকি তীব্র অনাহার? তা তো নয়! আসলে এগুলোও তাদের কাছে এক ধরনের খাবার। এটা তাদের খাবারের একটা রুচিগত ব্যাপার। হ্যাঁ তবে এটাও সত্যি যে তীব্র অনাহারের সময়টা তো এইসব খাবার খেয়েই তাদেরকে পেরিয়ে আসতে হয়েছে। তাই অঞ্চল ভেদে মানুষ নিজস্ব খাদ্য সংষ্কৃতিও বেছে নিয়েছে। সেখানে কুরকুট, মেঠো ইঁদুর, ব্যাঙ সবই খাদ্য হিসাবে জায়গা করে নিয়েছে। সময় পরিবর্তনশীল। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের খাদ্যাভ্যাসও বদলায়। রুচি বদলায়। মানুষ তো শারীরিক প্রয়োজনেই খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। এসব খাবার তাই অভাব ও রুচি এই দুই দিক দিয়েই জায়গা করে নিয়েছে। পরে হয়তো আবার এমন দিন আসবে যখন এসব খাবারের প্রয়োজন নাও থাকতে পারে। কারণ নানান আধুনিক খাবারের প্রাচুর্য তখন সেই অভাবকে সহজেই পূরণ করে দিতে পারে।
তবে "কুরকুট" কেবল অনাহারের আহার নয়, স্বাদেরও আহার। আসলে কোন খাবারকেই ঘৃণ্য মনে করা ঠিক নয়। বর্তমানে ডিসকভারি-র মতো চ্যানেলগুলো তো আজকাল খাবারের ব্যাকরণটাই পাল্টে দিয়েছে। বিশেষ করে "ম্যান ভার্সেস উইল্ড" খ্যাত ব্রিয়ার গ্রিলস এর মতো ব্যক্তিরা।

সুতরাং বলতেই পারি কুরকুট জঙ্গলমহলের সামান্য এক ক্ষুদ্র পিঁপড়ে রূপেই নিজেকে কেবল সীমায়িত রাখেনি, বরং সে জঙ্গলমহলের বাদশা হয়ে উঠেছে। কেবল ক্ষুধা নিবৃত্তিই নয় প্রচারের আলোয় এসে একই সঙ্গে আমলাশোল সহ গোটা এলাকায় উন্নয়নের জোয়ারও ডেকে এনেছে। তাই এমন নায়কোচিত কুরকুটের জয়গান গাইতেই হয়।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇



আরও পড়ুন

Post a Comment

1 Comments

  1. খুব ভালো লাগলো। অনেক অজানা তথ্য জানতে পারলুম। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

    ReplyDelete