Spoken language of the fishing community of East-Medinipur district / Bimal Mondal
পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা
পর্ব-১০(তৃতীয় অধ্যায়)
রূপতত্ত্ব(Morphology)
২. অসমাপিকা ক্রিয়া
পূর্বমেদিনীপুর জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তীতে বসবাসকারী মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষা ছাড়াও এই জেলার সমগ্র মানুষের কথ্য ভাষায় বাংলা মান্য চলিতের ন্যায় অসমাপিকা ক্রিয়ার যথেষ্ট প্রয়োগ রয়েছে। --আ,-য়্যা,- অ্যা, বো, থলো, ইলে,তে, লে, লা,লু, নু প্রত্যয় যোগে অসমাপিকা ক্রিয়া গঠিত হয়। এখানে ক্রিয়ার রূপে স্বরসঙ্গতি, অভিশ্রুতি এবং অপিনিহিতির রূপটি বেশি ধরা পড়ে।
যেমন —
খাই+ইয়া=খাইয়া >খায়্যা (অভিশ্রুতি)
ডাক+ইয়া= ডাকিয়া >ডাকলা>ডাকা (অভিশ্রুতি)
পড়+ইয়া= পড়িয়া >পড়লো>পড়থোলো>পড়থালা (স্বরসঙ্গতি)
যা+ইতে=,যাইতে>যাতে >য্যায়া (অপিনিহিতি)
ঘুর +ইয়া=ঘুরিয়া> ঘুরল্যা (অপিনিহিত)
বস+ইয়া=বসিয়া>বুসিয়া >বুসে (অভিশ্রুতি)
হাঁক+ইয়া=হাঁকিয়া>হেঁকে (অভিশ্রুতি)
ফেল+ইয়া=ফেলিয়া>ফ্যালে(স্বরসঞগ)
খা+লে=খালে
ছুট+লো=ছুটলো>ছুটথলা
আস+বো=আসবো>আসবা
কহ+ইয়ে=কইয়ে>কওয়া
নাচ+ইতে=নাচিতে >নাচতে >লাচতে>লাচে
খা+তে=খেতে>খাতে (স্বরসঙ্গতি)
আঁক+লে=আঁকলে>আঁকেটে
উঠ+তে=উঠতে
বুস+তে=বুসতে>বুসিয়া
কর+আ=করা
বাক্যে প্রয়োগ
ক. তোনে স্কুলে য্যায়া কি করবু?
(তোরা স্কুলে গিয়ে কি করবি?)
খ.তানে ছুটিয়া আইসেটে।
(তারা ছুটে আসছে)
গ.ঘরে টাকিমারিয়া বুসিয়া আছি।
(ঘরে চুপচাপ বসে আছি)
ঘ.তুই খাইলিয়্যা আসবু।
(তুই খেয়ে আসবি।)
ঙ. তুই খ্যায়া পালি যা।
(তুই খেয়ে পালিয়ে যা)
চ.তুই কথা কইতে কইতে চুপ করিয়া যাউ কেন?
(তুই কথা বলতে বলতে চুপ করে যাস কেন?)
ছ.তানে নদীর ধারে জাল দিয়া মাছ ধরেটে।
(তারা নদীর ধারে জাল দিয়ে মাছ ধরছে।)
জ.গেড়িয়্যা ধারে টকাটা খ্যালতে যায়।
(পুকুর ধারে ছেলেটা খেলতে যায়।)
২.সংযোগমূলক ক্রিয়া
এই জেলার উপভাষায় প্রায়শই সংযোগমূলক ক্রিয়ার ব্যবহার চোখে পড়ার মতো।এই ক্রিয়া সাধারণত গঠিত হয় বিশেষ্য/বিশেষণ, ক্রিয়া যোগে। অর্থাৎ
সংযোগমূলক ক্রিয়া=বিশেষ্য/বিশেষণ +ক্রিয়া।
এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় বিশেষ্য, বিশেষণ ও ধ্বন্যাত্মক অব্যয়ের সঙ্গে সংযোগে এই ক্রিয়ার ব্যবহার রয়েছে। এই সংযোগ মূলক ধাতুকে মান্য চলিত বাংলা ভাষার মতো এই উপভাষায় দু'ধরনের ধাতু নিষ্পন্ন ক্রিয়া দেখা যায়। যেমন—
যুক্ত ক্রিয়া ও যৌগিক ক্রিয়া।
২.১ যুক্ত ক্রিয়া- এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্য ভাষাতে যুক্ত ক্রিয়ার ব্যবহার দেখা যায়। যেমন—
ক.√কর ধাতু যোগে :
i.টকাটা কাজ করুছি। (ছেলেটা কাজ করছে।)
ii.লোকটা জিগেস করথালা। (লোকটা জিজ্ঞেস করছিল।)
iii.তানে নদীরো নামিয়া পটপট করিয়া মাচ ধরুছি। (তারা নদীতে নেমে চটপট করে মাছ ধরছে।)
খ.√হ ধাতু যোগে:
i.তোনে আর মানুষ হবুনু রে।
(তোরা আর মানুষ হবি না।)
ii.আমফানে ঘর ঘর পচুর খোতি হইচে।
(আমফানে ঘর ঘর প্রচুর ক্ষতি হয়েছে।)
iii. নৌকা ধারে কি হইথলা। (নৌকার পাশে কি হয়েছিল।)
গ.√ধর ধাতু যোগে :
i.নৌকা ধরি কি বুসিয়ালা। (নৌকা ধরে বসে গিয়েছিল।)
ii.গেড়িয়ারো জল ধরি রাখা যায়নি। (পুকুরের জল ধরে রাখা যায়নি।)
iii.জালো ধরিয়া উঠাইবু। (জাল ধরে উঠাবি।)
ঘ.√উঠ ধাতু যোগে :
i.নদীরো জল উঠি আসুছি। (নদীর জল উঠে আসছে।)
ii.অনান্য লুকো নৌকারো উঠিবে। (অন্যান্য লোক নৌকার উঠবে।)
iii. ঘরো ধানো উঠাইবা। (ঘরে ধান উঠাবো।)
ঙ.√যা ধাতু যোগে:
i. সবু মাচ বিক্রি হি যায়?(সব মাছ বিক্রি হয়ে যায়?)
ii.বউমোনে সকাঁউ ফুল তুলেতে যাটে। (বৌরা সকালে ফুল তুলতে যায়।)
iii.বোট বহুত বেগমে জাঁতা হ্যা। (নৌকাটি খুব দ্রুত যাচ্ছে।)
চ.√খা ধাতু যোগে:
i.কেলা খাবু?(কলা খাবি?)
ii.মেইঝিটা গেড়িয়ায় পড়ি যায়্যা হাবুডুবু খাতলা। (মেয়েটা পুকুরে পড়ে গিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছিলো।)
iii. নৌকারো উপরে বুসিয়া খাই লউছি। (নৌকার উপরে বসে খেয়ে নিচ্ছে।)
ছ.√ঝাড়া ধাতু যোগে :
i.জালু ঝাড়ু হউছি। (জাল ঝাড়া হচ্ছে।)
ii.তানে ধান ঝাড়েটে। (তারা ধান ঝাড়ায়।)
iii. লোকটা কতগুয়া টাকা ঝাড়ি লিয়া পালি জালা। (লোকটা অনেক টাকা ঝেড়ে নিয়ে পালিয়ে গেল।)
২.২.যৌগিক ক্রিয়া
চলিত বাংলার মতো এই জেলার কথ্যভাষায় যে উপভাষা উঠে আসে তাতে বেশ যৌগিক ক্রিয়ার প্রয়োগ চোখে পড়ে ।এই জেলায় যে যৌগিক ক্রিয়া চোখে পড়ে তাতে ৪ প্রকার ক্রিয়া-বাক্যাংশ নিয়ে এই যৌগিক ক্রিয়া গঠিত হয়। তা হল-
২.২.১.- দুই পদী ক্রিয়া-বাক্যাংশ
ক. রাম পড়িয়া চলিয়ালো।
(রাম পড়ে চলে গেল)
খ.জেলে পাড়ায় আইজকে চোর ধরা পড়থালা।
(জেলে পাড়ায় আজ চোর ধরা পড়েছে)
গ.টকাটা অঁখো বুসিয়া আছে।
(ছেলেটা এখন বসে আছে)
ঘ.তুমানে মাচ লিয়া আসবো।
(তোমরা মাছ নিয়ে আসবে)
ঙ.মাজু গাঙে কতো ঢেউ উঠথলো।
(মাঝ নদীতে অনেক ঢেউ উঠেছিল।)
ক.মেঘ ঘোর হয়া বৃষ্টি পড়তে লাগলা।
(মেঘ ঘন হয়ে বৃষ্টি হতে লাগল।)
খ.তুই ট্রলারে মাচ ধরিয়া লিয়া আয়।
(তুই ট্রলারে মাছ ধরে নিয়ে আয়।)
গ.মাইঝিটা চুমুড় মাচ এক গাড়ু ধরি লিয়া আইসেটে।
(মেয়েটি চিংড়িমাছ এক হাঁড়ি ধরে নিয়ে আসছে।
ঘ.পাড়ায় পাড়ায় করোনার জানে লুকিয়া লুকিয়া ঘুরেটে।
(পাড়ায় পাড়ায় করোনার জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে ঘুরছে।)
ঙ.তোনকের আর পড়াশুঁয়া কত্তে হবেনি।
(তোদের আর পড়াশোনা করতে হবে না।)
২.২.৩. চার পদী ক্রিয়া-বাক্যাংশ
ক.টকাটাকে তুলিয়া লিয়া গাড়িতে পালিলো।
(ছেলেটাকে তুলে নিয়ে গাড়িতে চলে গেল।)
খ.তুই একটা মাস্ক পরিয়া রইতে পারুনু কেনি?
(তুই একটা মাস্ক পরে থাকিতে পারিস না কেন?)
গ.এবছর মানুষ রেশনের চাল ধরিয়া লিয়া আইসিয়া খায়।
(এ বছর মানুষ রেশনের চাল ধরে নিয়ে এসে খায়।)
ঘ.তারে বুড়াটা মরিয়া পড়িয়া আছে দেখুটু?
(তারে বুড়োটা মরে পড়ে আছে দেখছিস?)
ঙ.আইজ কাল মাছের দাম হু হু করিয়া বাড়েটে।
(আজ কাল মাছের দাম হু হু করে বাড়ছে।)
২.২.৪.পাঁচ পদী ক্রিয়া -বাক্যাংশ
ক.আমারে মাইঝিটা ঘরকে যাওয়ার সময় খায়া করিয়া বাঁধিয়া লিয়া যায়।
(আমারে মেয়েটি বাড়িতে যাওয়ার সময় খেয়ে নিয়ে বেঁধে নিয়ে যায়)
খ. টকাটা পড়াশুঁয়া নাই করিয়া লাচিয়া লাচিয়া ঘুরেটে দেখ।
(ছেলেটা পড়াশোনা না করে নেচে ঘুরছে দেখ।)
গ.তুমার ঘরে টকা হলে খাতে আসবা দেখি লুবো।
(তোমার ঘরে ছেলে হলে খেতে আসবো দেখে নেবে।)
ঘ.আমফান ঝড়ে কত ঘর ভাঙিয়া বিছিয়্যা পড়িয়্যা আছে দেখছি।
(আমফান ঝড়ে কত ঘর ভেঙে বিছিয়ে পড়ে আছে দেখেছি।)
ঙ.কচিয়া মেইঝিটাকে ধরিয়া লিয়া যায়া মারিয়্যা দিছে।
(ছোটো মেয়েটিকে ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে দিয়েছে।)
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষায় মান্য চলিত বাংলার বৈশিষ্ট্যের থেকে এখানকার উপভাষায় রূপতত্ত্বের বিভিন্ন ধারার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যে ফারাক উঠে এসেছে তা সেই অনুযায়ী ক্রিয়ায় শ্রেণি বিভাগ পরবর্তী পর্বে বাক্য সংযোগে আলোচনা করব।
আরও পড়ুন
0 Comments