জ্বলদর্চি

'বিষ শুধু বিষ দাও অমৃত চাই না আর'/গৌতম বাড়ই

'বিষ শুধু বিষ দাও অমৃত চাই না আর'

গৌতম বাড়ই

(সময়ের কথায় একটা জনপ্রিয় গানের লাইন ধার করে শিরোনামে বলতেই হল)

সময় শুধু কিছু দাগ রেখে যায় মনে। আমরা শুধু সময়ের স্রোতে ভেসে যাই। পরিবর্তন বা অদলবদলে আমরা কতটা বদলালাম বা বদলাইনি? প্রশ্ন তো থাকাই উচিত মনে। আমাদের উন্নত জীবনে প্রবেশ, নাকি অধঃপতনের তরল অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছি রোজ?

আমার একটা গল্প প্রায়ই মনে পড়ে। আপনাদের তা এখানে যতটুকু পারি সংক্ষেপে বলছি।

সেই ভুলোমনের মাষ্টারমশাই এর কথা। শ্রদ্ধেয় তারাপদ রায় খুব সুন্দর করে বলেছিলেন। সেই যে এক গ্রামের হাই স্কুলের ভুলোমনা মাষ্টারের গল্প।মাষ্টারমশায়ের গোয়ালে আগের দিনের গোধূলিবেলায় ধবলী নামের প্রিয় গাইগোরুটি ফেরেনি। পরদিন মাষ্টারমশাই সকাল সকাল খেয়েদেয়ে নিজের গ্রাম, পাশের গ্রাম, অন্য গ্রামে আঁতিপাতি করে ধবলী নামের গোরুটিকে খুঁজছেন। এদিকে বেলা নেমে আসছে।না, কোথাও ধবলীর দেখাটি নেই। এইভাবে খুঁজতে খুঁজতে কখন যেন নিজের গ্রামে ফিরে এসেছেন।তৃষ্ণার্ত হয়ে সামনের এক গেরস্থের বাড়িতে গিয়ে দেখলেন একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তাকেই বললেন-ভাই একগ্লাস জল খাওয়াতে পার? ছেলেটি আর কেউ নয়, ঐ মাষ্টারমশায়ের ছেলে। আর বাড়িটি তার নিজের। এতক্ষণ একটু দূর থেকে ওনার স্ত্রী সব শুনছিলেন। এবার সামনে এসে বললেন-তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? মাষ্টারমশাই বললেন-গোরু হারালি অমনি হয় মা, অমনি হয়!
চারিপাশটা দেখে তাই মনে হয় ঐ ভুলোমন মাষ্টারমশাই এর মতন আমাদের প্রত্যেকের ঐ  গোরু হারিয়ে গিয়েছে। আমরা শুনি আর উদাস হয়ে থাকি।আমরা ভাবি আর ভাবতেই থাকি। আমরা শোকে দুঃখে পাথর হয়ে স্থবির। নিস্পৃহ। এর শুরুটা কিন্তু আমরাই করেছিলাম। ঐ যে চাই, আরো চাই। এই চাইয়ের একটা অনন্ত জগত তৈরী করে। টাকা আরও টাকা চাই। ফ্ল্যাট চাই গাড়ি চাই সোনাদানা শেয়ার মদ মাংস সুন্দরী নারী স্বদেশ বিদেশ সব আমার চাই।আমি-আমি একটা জগত তৈরী করে ফেললাম।কোভিড-১৯ সেই নিজস্ব জগতে সারাবিশ্বে কফিনে শেষ পেরেকটি গুঁজে দিল। তার প্রতিফলন তো সমাজের সব দর্পণে।

ধরুন খবরের কাগজের প্রথম পাতায় একটু চোখ বুলিয়ে আপনি আঁতকে উঠবেন আজকাল। একগাদা মৃত্যুর খবর লেগে। তারপর মৃত্যুর ধেয়ে আসার খবর।একটা জবরদোস্ত লোমহর্ষক খুন নিজস্ব আত্মীয়-স্বজন এর মধ্যে। একটা নিরীহ মেয়েকে জ্বলন্ত পুড়িয়ে মারা। একটা সমাজের দলিত নিষ্পেষিত লোককেও ঐ পৈশাচিক ভাবে খুন। তবে আগে কি হত না এই ধরণের খুন জখম ঘটনা? হত কিন্তু এমন আকছার ঘটত না। আর কিছু রাজনীতির খবর, আপনি বুঝতেও পারছেন অনর্গল মিথ্যে বলে চলেছেন আমাদের রাজনীতির তাবড় দাদা আর দিদিরা। কী করবেন আর! আমাদের প্রত্যেকের গোরু হারিয়ে, সেই ভুলোমনা মাষ্টারমশায়ের মতন সবাই।

গতকালের এক জনপ্রিয় বাঙলা দৈনিকের একটি পাতার খবর দেখছি আর ভাবছি, এই কলকাতা মহানগরীর একদম খোদ কলকাতার ভেতরে এক ফ্লাটের ভেতর থেকে বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধার পচা গলিত লাশ উদ্ধার। আত্মহত্যা। আর্থিক টানাপোড়েনের জন্য। ঐ পাতার আবার অন্য একটি জায়গায় এক যুবকের আত্মহত্যার খবর। যুবকটি লকডাউনে কাজ হারিয়ে ফেলে। সোনার দোকানের কারিগর ছিল বৌবাজারে।এও ঘটেছে কলকাতা শহরে। শহরের বাইরে এক ব্যবসায়ীর রহস্য মৃত্যু। একই পাতায় বেশিরভাগ জায়গা নিয়েছে এই খবরগুলো। আমরা আগে আলোচনা করতাম। এখন দেখেও পরিবারের অন্য সদস্যদের এই খবরগুলো শেয়ার করিনা। হয়ত আমাদের গায়েও লাগে না। আমরা মৃত্যুর বিছানা পেতে নিয়েছি এই সুন্দর পৃথিবীতে।

তাই বিষ শুধু বিষ দাও অমৃত চাই না আর।

আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments