জ্বলদর্চি

পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা -৮/ বিমল মণ্ডল

Spoken language of the fishing community of East-Medinipur district / Bimal Mondal

পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা

বিমল মণ্ডল 
পর্ব-৮

ধ্বনিতত্ত্ব(Phonology) 

৩.৩.৭.মহাপ্রাণীভবন-পূর্ব-মেদিনীপুর জেলার কথ্যভাষায় প্রায়শই উচ্চারণে অল্পপ্রাণ ধ্বনি মহাপ্রাণে আবার মহাপ্রাণ ধ্বনির অল্পপ্রাণ ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়ে এই জেলার মৎস্যজীবী   সম্প্রদায়ের উপভাষায় এমনই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন-

পুকুর>,পুখুর, পুস্তক>পুথি, কাটারি>কাঠারি, 
পাট>পাঠ, মোটা>মোঠা, একটা>একঠা, 
ঠুঁটো>ঠুঠো, 

অল্পপ্রাণীভবন-
মধু>মদু, মুখ>মুক, রথতলা>রততলা, নথ>নত, দুধ>দুদ, মাঝি>মাজি, মাছ>মাচ, 
সুখ>সুক, 

৩.৩.৮. নাসিক্যীভবন-

 ঙ,ঞ, ণ, ন, ম  তৎসম শব্দে কখনো কখনো লোপ পায়। তার জন্য এই জেলার কথ্যভাষায় কিংবা উপভাষাতে নাসিক্যধ্বনির উচ্চারণে আধিক্য দেখা যায়। এছাড়া এখানকার উপভাষায় স্বতোনাসিক্য ভবনের প্রভাব দেখা যায়। যেমন-

নাসিক্যীভবন-
ক.'ঙ' যুক্ত নাসিক্যীভবন- 
পঙ্ক>পাঁক, কঙ্কর>কাঁকর, অঙ্কুশী>আঁকশি, বঙ্ক>বাঁক  
খ. 'ঞ' যুক্ত নাসিক্যীভবন-
অঞ্চল>আঁচল, গঞ্জিকা>গাঁজা, পঞ্চ>পাঁচ 
গ.'ণ' যুক্ত নাসিক্যীভবন- 
ভণ্ড>ভাঁড়, কণ্ট>কাঁটা, ষণ্ড>ষাঁড়, 
ঘ.'ন'   যুক্ত নাসিক্যীভবন-
বন্ধ>বাঁধ, ফন্দি>ফাঁদ, দন্ত>দাঁত
ঙ. 'ম' যুক্ত নাসিক্যীভবন-
কম্প>কাঁপা, চম্পা>চাঁপা, ঝম্প>ঝাঁপা 
চ. বাস্তবধ্বনির অনুকরণে নাসিক্যীভবন-
ঝাঁঝাঁ, চোঁ-চোঁ, বোঁ-বোঁ,  ছোঁ ছোঁ,  
ছ. অনুস্বারযুক্ত নাসিক্যীভবন-
হংস>হাঁস, চোংগা>চোঁঙ্গা, বংশী>বাঁশ,রং>রোঁঙ্গ

স্বতোনাসিক্যীভবন-
লুচি>লুঁচি, কাদা>কাঁদা, দাড়ি>দাঁড়ি, কাটা>কাঁটা, কাজ>কাঁজ, বাক>বাঁক, পাক>পাঁক, আখ>আঁখ,খোকা>খোঁকা, যারা>যাঁরা, ছাই>পাঁউশ/পাঁশ, বাসা>বাঁসা, হাসপাতাল>হাঁসপাতাল, ঘুটে>ঘুঁটে /ঘুঁটিয়া

৩.৩.৯. মূর্ধন্যীভবন-
এই জেলার উপভাষায় এই  ধরনের ধ্বনি পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন-

ত>ড়- মৃত>মড়া
দ>ড়- বৃদ্ধ>বুড়া, ষণ্ড>ষাঁড়, দণ্ড>দাঁড় 
র>ট-রবার>রাবাট, কর্ণার>কর্ণাট,  
ত>ট- মৃত্তিকা>মাটি, 

৩.৩.১০. ল-কারীভবন-
    পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের  কথ্যভাষায় এই ধ্বনি পরিবর্তনই হল এখানকার উপভাষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।যেমন- 
ন>ল- নাড়ু>লাড্ডু, নোংরা>লোঙরা, ন্যায্য>লায্য, ন্যাঙটা>ল্যাঙটা, নগদ>লগদ,নজর>লজর,নদী>লোদী,  নাতি>লাতি,  নুপুর>লুপুর  

ল>ন- লুঙ্গি>নুঙ্গি, লুচি>নুচি, লবন>নুন, লেজ>ন্যাচ, 

র>ল- রাত>লাত,  করলা>কল্লা,  

৩.৩.১১.ব্যঞ্জন দ্বিত্ব-
এই জেলায় সমস্ত সম্প্রদায়ের কথ্যভাষায় ব্যঞ্জন দ্বিত্বের প্রভাব যেমন  দেখা যায়, ঠিক এই জেলার উপভাষায় এই ধরনের ধ্বনি পরিবর্তনই হলো উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। যেমন-
অত>অততো,  উঁচু>উচ্চা, ছেলে>টককা, সকাল>সক্কাল, ছোটো>ছোট্ট, পাকা>পাক্কা, কাঁচা>কাঁচ্চা, সবাই>সব্বাই,   কোটিপতি>কোট্টিপতি, 

৩.৩.১২. সংকোচন-
এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় উচ্চারণের দ্রুততার জন্য শব্দের সবকটি ধ্বনি উচ্চারণ না করে কতগুলো ধ্বনিকে  একসাথে মিলিয়ে ছোটো ছোটো করে উচ্চারণ করা  এখানকার উপভাষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যেমন- 

জামাইবাবু>জামাই, বৈবাহিক>বেয়াই>বেই, যখন-তখন>যঁখোতখো, 

৩.৩.১৩.অপিনিহিত-
এই জেলার উপভাষায় অপিনিহিতি ধরা পড়ে।  কথ্যভাষায় অপিনিহিতি এখানকার এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। তিন ধরনের অপিনিহিতি এখানে লক্ষ্য করা যায়। যেমন-

ক. ' ই'   ধ্বনির পূর্ব উপস্থাপন-
জাতি>জাইত, আঁটি>গাঁইট,খেলিয়া>খেইল্যা, নারিকেল>নাইরকেল,খাড়িয়া>খাইড়্যা

খ.'ই' 'উ' বিহীন শব্দে 'উ' এর আগম-
চাল>চাউল, যাচ্ছিস>যাউটু, খাচ্ছিস>খাউটু, টাঁক>টাঁউক, বাঁক>বাঁউক, মেসো>মাউসা

গ.  'ই' 'উ' বিহীন শব্দে 'ই'এর আগম-
শুয়ে>শুইয়্যা, খেয়ে>খাইয়্যা, চলে>চইল্যা,মেয়ে>মাইঝি, মানা>মাইনা, টানা>টানিয়্যা, 
ঘ.'উ' ধ্বনির উপস্থাপন-
রুমাল>উরমাল, মহুয়া>মউহা,  বাড়ুয়া>বাউড়া
৩.৩. ১৩.১.অর্ধ-অপিনিহিতি
এই জেলায় মৎস্যজীবীদের  কথ্যভাষায় বেশ কিছু শব্দ উচ্চারণের সময়  এই উপভাষায় অপিনিহিত 'ই'  ধ্বনি ক্ষীণ হয়ে লুপ্ত হয়। তখন এই অপিনিহিত অর্ধ-অপিনিহিতি হিসেবে ব্যবহার হয়। যেমন- 
পড়িয়া>পইড়্যা>পড়্যা ধরিয়া>ধইর‍্যা>ধর‍্যা,মারিয়া>মাইর‍্যা>মার‍্যা, কাটিয়া>কাইট্যা>কাট্যা, ছুটিয়া>ছুইট্যা>ছুট্যস, হাঁটিয়া>হাইট্যা>হাঁট্যা।   

৩.৩.১৪.অভিশ্রুতি-
অভিশ্রুতি এই জেলার উপভাষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় এই জেলায় অভিশ্রুতি পরিলক্ষিত হয়।  যেমন-
রাইত>রাত, জাতি>জাত, আসিয়া>এসে, বসিয়া>বুসে, খাই>খেতে,ভাবিয়া>ভেবে, ঘুরিয়া>ঘুরে, আইসো>এসো

এছাড়া এই  উপভাষায় 'ই'  ও ' উ' ধ্বনিযুক্ত  অভিশ্রুতি পরিলক্ষিত হয়। যেমন-
কাটিয়া>কাটি/কাটু, ছুটিয়া>ছুটি/ছুটু, লাফিয়া>লাফি/লাফু, ধরিয়া>ধরি/ধরু, ঘুরিয়া>ঘুরি/ঘুরু।    

৩.৪. ধ্বনির স্থানান্তর-
চলিত বাংলার উচ্চারণ অনুযায়ী এই জেলার কথ্যভাষায় উচ্চারণ করবার সময় শব্দের মধ্যে   ধ্বনি অদলবদল হয়।এই জেলায় মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেও এমন পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন-

ধ্বনি বিপর্যয়-
রিকসা>রিসকা, ট্যাস্ক>ট্যাকস, ট্যাক্সি>ট্যাসকি, আন্দাজ>আনদাজ,ডেস্ক>ডেকস,বারাণসী>বেনারস, তলোয়ার>তরোয়াল,   মাঝ>মাইঝ।
----------------
আরও পড়ুন 

পূর্বমেদিনীপুর জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় মৎস্যজীবী  সম্প্রদায়ের মানুষদের কথ্যভাষায় প্রায়শই 'ঐ'এবং' ঔ' -এই দুটি যৌগিক স্বরধ্বনির  ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
জ্বলদর্চি পেজ-এ লাইক দিন।👇




Post a Comment

0 Comments