জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -১৯/ শ্যামল জানা


আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -১৯

শ্যামল জানা


ফিউচারইজম (দ্বিতীয় অংশ)

আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ১৯০৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রথম “ম্যানিফেস্টো অফ ফিউচারিজম” প্রকাশ পেয়েছিল, এবং তার কিছু কিছু অংশ আমরা আগের পর্বে উল্লেখ করেছি৷ কিন্তু আমরা যদি পুরো ম্যানিফেস্টোটির সারাংশ করি, তাহলে এই রকম দাঁড়াবে— তারা (ম্যারিনেত্তি লিখিত) স্পষ্টতই ঘোষণা করেছিল যে— যা কিছু পুরোনো বা অতীত, সব কিছুকেই তারা অত্যন্ত ঘৃণা করে! বিশেষ করে রাজনীতি ও শিল্পকলার যে সব ঐতিহ্য আছে৷ “অতীতের কোনো কিছুরই কোনও প্রয়োজন নেই!” তারা আরও লিখল— “আমরা যৌবনোদীপ্ত এবং প্রবলভাবে ভবিষ্যবাদী৷” আমরা, ফিউচারিস্টরা, প্রসংশার চোখে দেখি গতিকে, প্রযুক্তিকে, যৌবনকে, হিংস্রতাকে, গাড়িকে, এরোপ্লেনকে, এবং শিল্প-শহরকে৷ প্রকৃতিকে অতিক্রম করে এই যে প্রযুক্তিগত মানবতার জয়জয়কার, তার প্রকৃত প্রতিনিধি এরাই, এবং এরাই প্রগাঢ় জাতীয়তাবাদী৷ অতীতের যা কিছু ধর্মাচরণ, অনুকরণযোগ্য, প্রসংশিত মৌলিক সমস্তকিছুকে তারা অস্বীকার করল! এত কিছু করার পরেও তারা ছিল দুঃসাহসী ও হিংস্র! উন্মাদরা যেরকম প্রকটভাবে তাদের খারাপ আচরণ প্রকাশ করে, সেইভাবে তারা সদম্ভে বিরক্ত প্রকাশ করত৷ স্বাভাবিকভাবেই চিত্র-সমালোচকদের তারা বরখাস্ত করল৷ যা কিছু সুন্দর বোধ, সুরেলা বা সুন্দর স্বাদের যা কিছু, এই সব কিছুর বিরুদ্ধেই তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করল! অতীত শিল্পের যেগুলি মূল চিন্তা-ভাবনা বা বিষয়, সব সব তারা যেন ঝাঁটা দিয়ে ঝেঁটিয়ে সাফ করে দিল, সে সবের কোনো অস্তিত্বই রাখল না৷ তারা মনে করল বিজ্ঞানই একমাত্র গর্ব করার বিষয়!

ফিউচারিস্টদের প্রথম ম্যানিফেস্টোতে ইতিবাচক শিল্পসংক্রান্ত কোনো কার্যক্রম (Programme) ছিল না৷ পরবর্তীকালে, ১৯১০ সালের ১১ এপ্রিল ইতালিতে ফিলিপ্পো ম্যারিনেত্তির ম্যাগাজিন— “পোয়েসিয়া”-তে লিফলেট আকারে প্রকাশ পেল— “টেকনিক্যাল ম্যানিফেস্টো অফ ফিউচারিস্ট পেন্টিং”৷ এই  ম্যানিফেস্টোতে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল “সার্বজনীন গতিশীলতা(Universal dynamism)”-কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে৷ এবং এই সার্বজনীন গতিশীলতাই তাদের ছবিতে সরাসরি প্রতিনিধিত্ব করবে৷ আর, তারা বলল— বাস্তবতার ভেতরে যে উদ্দেশ্যগুলি থাকে, সেগুলি একটা আর একটার থেকে কখনোই বিচ্ছিন্ন নয়৷ এমন কি, আমার চারপাশে ঘটা বাস্তবতার থেকেও তারা বিচ্ছিন্ন নয়৷
প্রথম দিকে ফিউচারিস্ট শিল্পীদের ছবিতে নির্দিষ্ট কোনো স্টাইল বা বিষয়বস্তু ছিল না৷ পরে, আস্তে আস্তে তারা ব্যাপারগুলি আয়ত্ত করল৷ তাই, নিজস্ব স্টাইল না থাকায়, তারা প্রথম এক বছর ছবিতে “ডিভিশনিজম”-এর থেকে নেওয়া টেকনিক ব্যবহার করত৷ এই টেকনিকের প্রথম ব্যবহার ইমপ্রেশনিস্টরা শুরু করলেও ডিভিশনিস্টরা নিজেদের মতো করে বদলে নিয়েছিল৷ সেটি হল— ক্যানভাসে তারা ভাঙা ভাঙা আলো ব্যবহার করত৷ আর, এটা করতে গিয়ে তারা রঙকে বিন্দু দিয়ে দিয়ে রেখা ও ডোরা(Stripes)র মাধ্যমে ব্যবহার করত৷ ডিভিশনিজম-এর এই টেকনিক ফিউচারিস্টরা মূলত নিয়েছিল ইতালিয়ান চিত্রশিল্পী গিওভান্নি সেজান্তিনি-র ছবি থেকে৷ এ প্রসঙ্গে বোচ্চিওনির একটি ছবি— “দ্য সিটি রাইসেস” উল্লেখযোগ্য(ছবি-১)৷ ছবির দৃশ্যটি একটি নির্মাণকার্যের৷ যেখানে ম্যানুয়েল লেবারদের সঙ্গে প্রচুর লাল রঙের পালিত ঘোড়াকে দেখা যাচ্ছে অ্যাবস্ট্রাক্ট ফর্মে৷ 

পরের ধাপে, শিল্পী গিনো সেভেরিনি ছবিতে পুরোপুরি অ্যাবস্ট্রাক্ট চিন্তা প্রয়োগ করলেন৷ তিনি ছবির স্টাইল ও মেথড-এর মধ্যে পশ্চাদপদতা আারোপ করলেন৷ আর, এই সেভেরিনিই প্রথম কিউবিজম আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হলেন ১৯১১ সালে৷ তাঁর মাধ্যমেই ফিউচারিস্ট শিল্পীরা তাঁদের ছবিতে কিউবিজমকে অবলম্বন করলেন৷ এই কিউবিজমই ফিউচারিস্টদের পথ দেখাল৷ একটা পেন্টি-এর মধ্যে বিশ্লেষণাত্মক শক্তি বলতে কী বোঝায়? এবং একটি পেন্টিং-এর সাহায্যে গতিকে কীভাবে প্রকাশ করবে! এভাবে ফিউচারিস্টরা নিজেদের চলার রাস্তাটা খুঁজে পেল৷
সে সময় চিত্রশিল্পীরা সাধারণত দৃশ্য বলতে ল্যান্ডস্কেপই বুঝত৷ কিন্তু ফিউচারিস্টরা শহরের বিভিন্ন সমসাময়িক ইভেন্টের ছবি আঁকতে শুরু করল৷ শিল্পী কার্লো কারা “ফিউানেরেল অফ অ্যানার্কিস্ট গালি”(১৯১০-১৯১১)নামে একটা বিশাল ছবি আঁকল ক্যানভাসে(ছবি-২)৷ তার বিষয়বস্তু ছিল— শহরে দাঙ্গা বেঁধেছে৷ ঘোড়ার পিঠে চড়ে পুলিশ-অ্যাকশন তাদের অ্যাটাক করেছে৷ শিল্পী আড়াআড়িভাবে এই অ্যাকশন দৃশ্যটি রেখেছেন৷ সমতলকে কিউবিস্ট ফর্মে ভেঙেছেন৷ ওই ফর্মে ওপরে সূর্যকেও দেখা যাচ্ছে৷ আবার একই সময়ে আঁকা তাঁর “লিভিং দ্য থিয়েটার” ডিভিশনিস্ট টেকনিকে আঁকা (ছবি-৩)৷ যেখানে মুখাবয়বহীন একদল মানুষকে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের তলায় দেখা যাচ্ছে, যারা, মধ্যরাতে ভীষণ ক্লান্তিতে কোনো রকমে নিজের শরীরটাকে টেনে বাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে৷                                                  (ক্রমশ)


---------------
আরও পড়ুন 

মানুষের দ্বারা মানুষের আকস্মিক ও চরম সর্বনাশ ঘটানো হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে৷ এরই নগ্ন রূপ বিভিন্নভাবে ক্যানভাসে তুলে ধরাই এদের উদ্দেশ্য ছিল৷ তাই, তাঁরা ছবিতে প্রাকৃতিক দৃশ্য(Landscape)ও শারীরিক নগ্নতা(Nudity)আঁকতেন না, বর্জন করেছিলেন৷ 

Post a Comment

3 Comments

  1. শ্যমলের লেখাটি পড়লাম। বেশ ঠিকঠাক লেখা ।

    ReplyDelete
  2. অসাধারণ লাগছে।ছবিগুলো তো তুলনাবিহীন।ফিউচারিস্টদের আঁকার সাথে সাথে তখনকার মানুষের মন মানসিকতার পরিচয় ঘটছে,,,দারুণ প্রাপ্তি।

    ReplyDelete
  3. ফিউচারইজম এর প্রবক্তা ফিউচারিস্টরা অতীতকে
    নস্যাৎ করা ও ভবিষ্যতকে
    আলম্ব করার মধ্য দিয়ে প্রগাঢ়
    জাতীয়তাবাদি হয়ে উঠেছিল
    কেমন করে তা শ্যামল সুন্দর
    ভাবে দেখিয়েছে। পাশাপাশি
    কিউবিজম কে তাদের শিল্প
    কর্মের একটি ফর্ম হিসেবে কি
    ব্যাপক ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে
    শেষ পর্যন্ত তারা গ্রহণ করেছিল
    তাও আমরা জানতে পারি।
    এই কঠিন কাজটি সহজ করে
    পাঠকের দরবারে হাজির করার
    ব্রতে, ব্রতী শ্যামল।তাকে শুভেচ্ছা।

    ReplyDelete