জ্বলদর্চি

দীপাবলির আগের সন্ধ্যায়../অনিন্দিতা শাসমল

দীপাবলির আগের সন্ধ্যায়..

অনিন্দিতা শাসমল

আমার কাছে আলোর উৎসব মানে শুধু দীপাবলি নয়। সারা বছরই আমি আলোর উৎসব দেখতে যাই বাড়ির খুব কাছে মেদিনীপুর স্টেশনে। শীত, গ্রীষ্ম বা যে কোনো ঋতুতেই সন্ধ্যার আলো ঝলমল মেদিনীপুর স্টেশন আমার বড় প্রিয়। বিশেষ করে শিশিরভেজা হেমন্ত সন্ধ্যায়, দীর্ঘ প্ল‍্যাটফর্মের নির্জন শেষ প্রান্তে যেখানে শেড নেই, মাথার ওপরে তারায় ভরা খোলা আকাশ, সেখানেই একটা বেঞ্চে বসে বসে ট্রেনের চলে যাওয়া দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। ট্রেনের শব্দ ক্রমশ মিলিয়ে যেতে যেতে লম্বা ট্রেনের শেষ কম্পার্টমেন্টের আলোর বিন্দুটাও একসময় মিলিয়ে যায় .... যতদূর চোখ যায় তাকিয়েই থাকি। প্রায় আট মাস হয়ে গেল, আমার সেই প্রিয় জায়গায় গিয়ে বসতে পারিনি, মন খারাপের কোনো বিষণ্ণ সন্ধ্যায়। লকডাউনের সময় থেকেই মাঝে মধ‍্যে সন্ধেবেলায় গিয়ে চেষ্টা করেছিলাম প্ল‍্যাটফর্মে ঢোকার, পুলিশের অনুমতি পাইনি। অগত্যা পেছনের সাইকেল স্ট‍্যান্ডের পাশ দিয়ে গিয়ে, সিঁড়িতে উঠে ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে প্রায় জনমানবহীন, ট্রেনহীন ফাঁকা স্টেশন দেখে, গাছের ডালে বসে থাকা পাখিদের কিচিরমিচির প্রাণ ভরে শুনে বাড়ি ফিরেছি।
   আজও সেই আশায়, দীপাবলির আগের সুন্দর সন্ধেটা স্টেশনে বসে কাটাবো ভেবে, বৃথা চেষ্টা করে ফিরে এলাম; ঝুলিতে যা জমা হল সেটাই বা কম কিসের! সন্ধে সাতটার সময় স্টেশনে পৌঁছে দেখলাম, হাওড়া যাওয়ার শেষ লোকাল ট্রেনটি দাঁড়িয়ে আছে প্রায় শূন‍্য শুনশান স্টেশনে। টিকিট কাউন্টারের সামনের চত্বরে, দূরত্ব বজায় রেখে গোল গোল দাগের মধ‍্যে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটার ব্যবস্থা করা হয়েছে। চৌকো বাক্সের দাগ দেওয়া আছে, লাইন দিয়ে প্ল‍্যাটফর্মে প্রবেশ করে ট্রেন ধরার জন্য  আর তিনজন আরপিএফ কর্মী দাঁড়িয়ে আছেন গেটের মুখে। অনুমতি চাইলাম মেয়েকে নিয়ে ভেতরে যাওয়ার। অনুমতি মিলল না; কাউন্টারে গিয়ে জানলাম প্ল‍্যাটফর্ম টিকিট দেওয়া বন্ধ। লোকাল ট্রেনে মেদিনীপুর থেকে খড়্গপুর যাওয়ার  টিকিট কাটলেই প্ল‍্যাটফর্মে যেতে পারতাম, কিন্তু এই অন্যায়ে  মন সায় দিলো না। রেল কর্তৃপক্ষ যে নিয়ম চালু করেছেন, দেশের একজন সুনাগরিক হিসেবে সেগুলো মেনে চলা অবশ‍্য কর্তব‍্য মনে করে, নিজের আবেগ সংযত করলাম। নিত‍্যযাত্রী আমার মান্থলি টিকিট শেষ হতে দুমাস বাকি ছিল ট্রেন বন্ধ হওয়ার সময়। রেলদপ্তরের উদারতায় ওই সময়ের জন‍্য অব‍্যবহৃত মান্থলি টিকিট এক্সটেনশন করার ব‍্যবস্থা হয়েছে শুনেছিলাম। তাই কাউন্কারে গিয়ে দাঁড়াতেই খুব যত্ন সহকারে, হাত বাড়িয়ে দিলেন রেলকর্মী বন্ধু। কিন্তু আদ্রা লাইনে যাতায়াত করি শুনে দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং ওই দিকের ট্রেন চলাচল এখনও শুরু হয়নি বলে মেদিনীপুর থেকে শালবনি যাওয়ার মান্থলি টিকিট এক্সটেনশন হবে না জানালেন বিনয়ের সুরে। কবে থেকে ওই লাইনে  ট্রেন চলবে, সেই খবর এনকোয়ারিতে দিতে পারলেন না রেলকর্মী বন্ধু; খবরের কাগজেই জানতে পারবো বলে জানালেন।
       স্টেশনের ডিজিটাল ঘড়িতে তখন 19:13। ট্রেন ছাড়তে আর দু মিনিট বাকি। মন ছটফট করছিল ট্রেনের চলে যাওয়াটুকু দেখার জন‍্য, তাই দেখতে ছুটে উঠে গেলাম স্টেশনের বাইরের সেই সিঁড়ি দিয়ে ওভারব্রিজের ওপর। সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে ওভারব্রিজে ওঠার মুখে গিয়ে দেখলাম 'নো এন্ট্রি ' লেখা। অগত্যা ওখানে দাঁড়িয়েই দুচোখ ভরে দেখলাম ---- চলে যাচ্ছে হাওড়াগামী শেষ লোকাল; ধীরে ধীরে  মিলিয়ে গেল দৃষ্টিসীমার বাইরে। চোখে পড়লো, ট্রেনে যাত্রী সংখ্যা একেবারেই নগণ‍্য। ফিরে এলাম আরপিএফ বন্ধুদের কাছে। তাঁদের মুখে শুনলাম , বিকেলের পর থেকে ট্রেনগুলোতে যাত্রী প্রায় নেই বললেই বলে। সেই কারণে, সন্ধে 7:15  এর পরেও রাতে যে লোকাল ট্রেনগুলো হাওড়া যেত আগে, সেগুলো বন্ধ আছে। করোনাজনিত স্বাস্থ্যসচেতনতার নিয়ম কতটা পালন করা হচ্ছে, সেই খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, ট্রেনের কামরায় সিটে দাগ দেওয়া নির্ধারিত জায়গায় বসছেন যাত্রীরা পুলিশের সামনে। একটু পরে ট্রেন ছেড়ে দিলে দূর থেকে দেখতে পাচ্ছেন তাঁরা, জায়গা থেকে সরে এসে গল্প করছেন যাত্রীরা অথবা মাস্ক খুলে দিচ্ছেন। স্টেশনে ঢোকার মুখে থার্মাল স্ক্রিনিং অথবা স‍্যানিটাইজ করার কোনোরকম ব‍্যবস্থা চোখে পড়লোনা। সব মিলিয়ে সেই কারণে আরপিএফ বন্ধুরা আতঙ্কিত। ভালো লাগলো রেলকর্মী ও আরপিএফ বন্ধুদের মানুষকে সচেতন করার প্রয়াস দেখে। আমিও সহমত হয়ে বললাম, নিয়ম আইন-কানুন দিয়ে কোনো কিছুই করা যায় না, যতক্ষণ না মানুষ নিজে সচেতন হয়।

   আমরা বহুদিন পর অচল পৃথিবীকে কিছুটা সচল করতে সক্ষম হয়েছি। এরপর  সাধারণ মানুষ যদি সঠিক নিয়ম পালন করে, তবে এই রেলগাড়ির চাকার গতি নিশ্চয়ই আবার রুদ্ধ হয়ে যাবেনা। দীপাবলীর আগের  রাতে, তাই একটাই প্রার্থনা --  বাইরের অন্ধকার নয়, সবার আগে মানুষের মনের যাবতীয় অন্ধকার দূর হোক।আলোয় আলোয় ভরে উঠুক সকলের মন, আলোকিত হোক সমাজ, আলোকিত হোক সারা পৃথিবী।

Post a Comment

0 Comments