জ্বলদর্চি

আবৃত্তির পাঠশালা-৩/শুভদীপ বসু

আবৃত্তির পাঠশালা-৩

শুভদীপ বসু

বিষয়- উচ্চারণ:কিছু কথা(প্রথম পর্যায়)
অলংকরণ: ঈশিতা দাস

বাংলা পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম ভাষা। এই ভাষার জন্য আমরা অমর একুশে দেখেছি। কবির কলম জানিয়েছে এই ভাষা উচ্চারণ করলে নিকোনো উঠোনে ঝরে রোদ আর বারান্দায় জ্যোৎস্নার চন্দন লাগে। মাগধি প্রাকৃত থেকে বাংলা ভাষার জন্ম। বর্তমানে এই ভাষার বয়স হাজার পেরিয়েছে।আমাদের গর্বের ব্যাপার এই ভাষাতে দুটি দেশের জাতীয় সংগীত রচিত। এতক্ষণ সবই ঠিক ছিল। কিন্তু এই গর্বের ভাষায় আমরা যখন কথা বলি তখন নিজেদের অসাবধানতার ফলে এই ভাষার মিষ্টতা হারিয়ে ফেলি। আমরা জানি আমাদের বর্ণমালা ও মুখের ভাষায় উচ্চারিত ধ্বনির মধ্যে সম্পূর্ণ মিল নেই। আমাদের স্বরবর্ণ এগারটি কিন্তু আদর্শ কথ্য ভাষায় মৌলিক স্বর সাতটি। বর্ণমালায় দুটি(ঐ,ঔ)যৌগিক স্বরধ্বনি থাকলেও মুখের ভাষায় অন্তত সতেরোটি যৌগিক স্বরধ্বনি আছে। উচ্চারণে অর্ধস্বর থাকলেও বর্ণমালায় এর অস্তিত্ব নেই। ব্যঞ্জনধ্বনির ক্ষেত্রেও মুখের ভাষায় ত্রিশটি ব্যঞ্জনের কথা পাওয়া গেলেও ব্যঞ্জন ধ্বনির সংখ্যা পঁয়ত্রিশ।

 ইংরেজিতে যে  ছাব্বিশটি অক্ষর পাই তার বানান করতে ও উচ্চারণ করতে আমাদের হাবুডুবু খেতে হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মজা করে লিখেছিলেন-'ছেলে ঘুমোলো পাড়া জুড়োলো/ফাস্ট বুক এলো দেশে-/ বানান ভুলে মাথা খেয়েছে/ এক্সজামিন দেবো কিসে।'
অভিধান ও উচ্চারণ: বাংলা বর্ণ সংখ্যায় ইংরেজি থেকেও বেশি। তাই উচ্চারণের সমস্যাও বেশি। দুঃখের বিষয় এই ইংরেজিতে উচ্চারণ করার জন্য কোথাও অসুবিধা হলে যেকোনো অভিধান খুললেই উক্ত শব্দটির উচ্চারণ সম্পর্কিত অসুবিধে দূর হয়। কিন্তু বাংলা অভিধান খুললেই উক্ত শব্দটির উচ্চারণ সম্পর্কিত অসুবিধা দূর হয় না। বাংলা উচ্চারণ অভিধান এতদিন ছিল না। বাংলা ভাষার উল্লেখযোগ্য অভিধান তিনটি একটি শ্রী জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাংলা ভাষার অভিধান, দ্বিতীয়টি শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ এবং তৃতীয়টি শ্রী রাজ শেখর বসুর চলন্তিকা। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বঙ্গীয় শব্দকোষ এর ভূমিকায় জানান- 'শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের  অভিধান, শ্রীযুক্ত জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস মহাশয় এর অভিধান এবং শ্রীযুক্ত রাজ শেখর বসুর চলন্তিকা বাংলা ভাষার যথাক্রমে বৃহৎ, মধ্যম ও লঘু অভিধান বলিয়া পরিগণিত হইবে।' এই কথানুযায়ী বলতে পারি সর্বশ্রেষ্ঠ মধ্যম অভিধানে উচ্চারণ সম্পর্কে কিছু বলা আছে। সম্প্রতি প্রকাশিত সংসদের উচ্চারণ অভিধানটি প্রশংসার দাবি রাখে। এইবার আমরা উক্ত বর্ণগুলির কিছু সঠিক নিয়ম ও উচ্চারণ ঠিক করার উপায় নিয়ে আলোচনা করব।

'অ'-এর তিন রকম উচ্চারণ দেখা যায়-
১) অ-এর মত উচ্চারণ।
২) ও এর মত উচ্চারণ।
৩) হসন্ত-র মত উচ্চারণ অর্থাৎ অ-কারের উচ্চারণ লোপ।

১) অ-এর উচ্চারণ প্রথমে যখন অ-এর মত-
এক) শব্দের প্রথমে 'না'অর্থে 'অ' বা 'অন' থাকলে-অস্থির(asthir) অনিত্য(anityo),অধীর(adhir)অনুদার(anudar)
দুই) শব্দের প্রথমে 'সহিত'বা 'সম্পূর্ণ'অর্থে অথবা 'সম'বা'স'থাকলে- সম্পূর্ণ(shampurno)সক্ষম(shakhom)সমৃদ্ধি(shamriddhi) সম্প্রীতি(shampriti)
তিন) একাক্ষর শব্দ হলে- ফল(phal) জল(jal) ঘর(ghar)
চার) প্রথম বর্ণে'অ'ও দ্বিতীয় বর্ণে'অ' বা 'আ'থাকলে- সকল(shakol) করা(Kara) বলা(bala)
পাঁচ) ধন্যাত্মক শব্দ হলে-কচ কচ(kach kach)
২) অ-এর উচ্চারণ প্রথমে যখন ও-এর মত-
এক) পরের বর্ণে ই,ই,উ,ঊ হলে।(ব্যতিক্রম-উপসর্গ যোগ হলে-অ-পূর্ব,অসীম)-অতি(ওতি) অতিশয় (ওতিশয়) সমুদ্র (সোমুদ্রো) পরীক্ষা (পোরীক্ষা)
** অনিমা-সঠিক উচ্চারণ ওনিমা, কিন্তু তা এখন অমার্জিত শোনায়।
দুই) পরের বর্ণে'্য-ফলা' যুক্ত হলে (ব্যতিক্রম: সদ্যোজাত (সোদ্যোজাত নয়)মদ্যপ(মোদ্যপ নয়)-সত্য(সোত্য)অত্যাচার (ওত্যাচার) নব্য (নোবব্য)
তিন) ক্ষ পরে থাকলে-লক্ষ্য (লোক্ষ্যো) অক্ষর (ওক্ষর)
চার) পরের বর্ণে ঋ-ফলা যুক্ত হলে-বক্তৃতা(বোক্তৃতা) মসৃণ (মোসৃণ)
পাঁচ) র-ফলা যুক্ত বর্ণের সাথে অ-যুক্ত থাকলে-শ্রম(শ্রোম) ভ্রমর (ভ্রোমর) প্রশান্ত (প্রোশান্ত) কিন্তু 'য়'পরে থাকলে-ক্রয়(ক্রোয় নয়)
ছয়) প্র- আগে থাকলে-প্রণাম(প্রোণাম) প্রবেশ (প্রোবেশ) প্রথম (প্রোথোম)
 অথবা র-ফলা যুক্ত ব্যঞ্জনের ঠিক পরে বসলে: ব্রত (ব্রোত) শ্রদ্ধা (শ্রোদ্ধা) শ্রবণ (শ্রোবোণ)।
সাত) একাক্ষর শব্দের শেষে 'ন'বা'ণ'থাকলে-মন(মোন)বোন (বোন)
আট)বড় শব্দকে উচ্চারণের সুবিধার জন্য ভেঙ্গে নিলে অথবা তিন অক্ষরের শব্দ দুই অক্ষরের মতো উচ্চারণ করলে ও শেষে'অ' থাকলে মাঝের ও শেষের অক্ষরের' অ'- এর উচ্চারণ-শ্রাবণ(শ্রাবোণ) পাথর (পাথোর) অনন্য (অনোন্যো) অনবরত (অনোবরোতো)
নয়)১১ থেকে ১৮ সংখ্যাগুলোর শেষের অ-এর উচ্চারণ-১১(এগারো),১২(বারো)
দশ) দ্ব্যক্ষর শব্দের শেষে 'হ' 'ড' 'ঢ''ং' 'য-ফলা'-বাক্য(বাক্কো) গাঢ়(গাড়হো) বিদ্রোহ (বিদ্রোহো)।মনে রাখা দরকার বাংলায় প্রায়ই শব্দের প্রথম সিলেবেলে শ্বাসাঘাত পড়ে আর তার প্রভাবে  পরের সিলেবেলটি' অ' 'ও' হয়ে যায়।
এগারো) দ্ব্যক্ষর শব্দের প্রথম অক্ষরে'ঋ-ফলা','ঐ','এ' থাকলে শেষে অ-এর উচ্চারণ ও-এর মত হবে-বৃষ(বৃষো) তৃণ (তৃণো) মৌল (মৌলো) শ্রেয় (শ্রেয়ো)
বারো) শেষে 'তর' 'তম'থাকলে অ-কার ও-কার এর মত উচ্চারণ হয়-গুরুতর(গুরুতরো) প্রিয়তম (প্রিয়তমো)
তেরো) বিশেষ শব্দের আদ্যক্ষর 'ও' হবে-মন্দ(মোন্দ) মঙ্গল (মোঙ্গল)
৩) যেখানে অ-এর উচ্চারণ লোপ পায়
এক) শেষে অ থাকলে এবং তুচ্ছার্থে ,সম্ভ্রমার্থে-হাত(হাত্) ভাত (ভাত্) পরিহাস (পরিহাস্)
দুই) ত-বর্ণ বিশেষ্য হলে-গীত(গীত্) মত(মত্)
তিন) শব্দের মধ্যে অ-ধ্বনি থাকলে-বাজনা(বাজ্না) বেগুনি (বেগ্ নি)

অল্পপ্রাণ ও মহাপ্রাণ বর্ণের উচ্চারণ:
অল্পপ্রাণ ও মহাপ্রাণ বর্ণের উচ্চারণের ধ্বনিবিজ্ঞান মেনে না চললে এই বিভ্রান্তি ঘটে-
১) কখন শোনা যাবে ককন
২) যখন হবে যকন
৩) ঝঞ্ঝা হবে জন্জা।
৪) যাচ্ছি হবে যাচ্চি।
৫) বাঘ হয়ে যাবে বাগ।
৬) মুক হয়ে যায় মুক।
৭) ব্যথা ব্যতা তে পরিণত হয়।
৮) কথিত শোনা যায় কতিত।
৯) দুঃখিত হয়ে যেতে পারে দুক্কিত।

*নাসিক্য বর্ণের উচ্চারণ:
নাসিক্য বর্ণের স্পষ্ট উচ্চারণ না হলে শব্দের অর্থই পাল্টে যায়-
১) কাঁদা-- কাদা হয়ে যায়।
২) বাস --বাঁশ হয়ে যায়।
৩) ফুলের কুঁড়ি- হয়ে যায় সংখ্যার কুড়ি।
৪) ছাদ হয়ে যেতে পারে ছাঁদ।
৫) শাঁখা,বৃক্ষের শাখা হয়ে যেতে পারে।
৬) আবার অতিরিক্ত সচেতন ও তার দরুন পরের বর্ণটি ও সংক্রামিত হয়-তাঁহারা হয়ে যায় তাঁহাঁরা, চাঁদ হয়ে যায় চাঁদঁ।

(উচ্চারণ বিষয়ে আলোচনা দুটি পর্বে শেষ হবে।)
জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments