জ্বলদর্চি

তিনটি অণুগল্প /শ্যামাশ্রী চৌধুরী মজুমদার

তিনটি অণুগল্প 

শ্যামাশ্রী চৌধুরী মজুমদার

ফোটোগ্রাফি - সৈয়দ স্নেহাংশু 
মায়াভুবন

সবে সন্ধে সাতটা। ঘুমের রাত এখন ঢের বাকি।অনুপমার কাজ শুরু হয় এখন। অতীত ভ্রমণ। ভাবছেন কল্পবিজ্ঞান?টাইম মেশিন?মোটেও তা নয়। অনুপমা এই সময় পুরোনো অ্যালবাম নামিয়ে বসেন খাটে। কোনোদিন ছোটবেলা, কোনোদিন কলেজ-ইউনিভার্সিটির এক্সকারশন, পিকনিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কখনও আবার নিজের বিয়ের,ছেলের অন্নপ্রাশন, জন্মদিনের,ভাইবোনেদের জমায়েত, সহকর্মীদের সঙ্গের জমাটি আড্ডার... পাতায় পাতায় ছড়িয়ে কত গল্প। বরাবরই ছবি তুলতে ভালোবাসতেন অনুপমা। বেড়াতে গিয়ে জয়ন্ত কত রাগ করেছে এই নিয়ে। বেড়ানোর অ্যালবামগুলো সবচেয়ে প্রিয় তাঁর।
জয়ন্ত বলত,"মনে ধরে রাখো।ছবিতে বড় সস্তা হয়ে যায় মহার্ঘ্য মুহূর্ত।"

কখনও বলত প্রকৃতির কৌমার্য নাকি নষ্ট হয় ওতে।
ভাগ্যিস  অনুপমা শোনেননি সেই কথা।কি হত তবে এখন?

এই যে এক একদিন এক একটা অ্যালবামে ঢুকে পড়েন আর হৈ হৈ করে জেগে ওঠে এক একটা সময় তার বেলা? নিজের ছবি দেখতে তাঁর ভারি বয়েই গেছে। তিনি ডেকে নেন চিরকালের মতো হারিয়ে যাওয়া কিংবা অনেক দূরে থাকা আপনজনেদের। ছবিগুলো বের করে ছড়িয়ে রাখেন বিছানার চারপাশে। তারপর তাদের সঙ্গে গল্প করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়েন তিনি।আজ ছেলেবেলা।রাত গভীর হলেই আজ অনুপমাকে ঘিরে থাকবে মা, বাবা, ন'ঠাকুমা, রাঙা পিসি, নিতাই কাকা, কুট্টিমামু, ছোড়দিদারা। গম গম করে উঠবে বাড়ি।আর নিশ্চিন্তে ঘুম নামবে অনুপমার চোখে। নাহলে একলা এই প্রাসাদোপম বাড়িতে তিনি থাকতে পারতেন না  কক্ষনো।

তস্কর

-না না এ ভারি অন্যায়।এ ও তো একরকম চুরি। রিমির গলায় ছদ্ম রাগ।
-ধুস্, পাগল নাকি তুমি? কিসের চুরি? আমি কার কোন জিনিস নিয়েছি বল?কেউ বলতে পারবে? রিমির মনোভাব ঠাওর করতে না পেরে উষ্মা ফোটে সমীরের কন্ঠে।
-এ ও তো একরকম নেওয়া।ভুলে গেছ নাকি না বলিয়া পরের দ্রব্য লইলে...
-তোমার যদি সত্যিই তেমন মনে হয় তবে পুলিশে খবর দাও।
গজগজ করতে করতে খাট থেকে নেমে যায় সমীর জানলাটা বন্ধ করতে।
-উফ্ এত রাগ কর কেন?নয় টবেই হত।কি আর করা যাবে!
-তাতে এই দৃশ্য আসত না, রিমি।
সত্যিই যে আসত না তা রিমি স্বীকার না করে পারে না। বাড়ির সামনে একফালি জায়গাও নেই। অথচ সমীরের ঘন গোলাপি বোগেনভেলিয়ার ভীষণ শখ। ঠিক পাশেই অজয় কাকুর বাড়ির গেটে উপচে পড়ছে রাশি রাশি ঘন গোলাপি পাতা। সমীর গতকাল সামনের ঘরের কাঠের জানালাটা বদলে কাঁচ লাগিয়েছে। তখনও কারণটা বোঝেনি রিমি।আজ ঘুম ভেঙে বিছানায় শুয়েই যখন চোখ গেল ভেতরে খোলা জানলার কাঁচে চমকে উঠল ও। দেখল তাদের বাইরের দরজার উপরেই আলো হয়ে ফুটে আছে ঘন গোলাপি পাপড়িরা। হ্যাঁ, কাঁচের জানলায় সমীর চুরি করেছে প্রতিবেশীর  বোগেনভেলিয়ার ছবি।

তোমাকে চাই

কাগজটা ব্যালকনিতে পড়তে যতক্ষণ। অসীমবাবু পারলে লুফে নেন। তারপর গোগ্রাসে গিলতে থাকেন সেটা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড ভুলে।এ নিয়ে গিন্নী রুনুর সঙ্গে নিত্য খিটিমিটি। বাড়িতে মাত্র দুটি প্রাণী।তা একজন যদি ঘুম ভাঙতেই হুমড়ি খেয়ে পড়েন খবরের কাগজের উপর তো আর একজন কি করেন!
-কি গো,চা যে জুড়িয়ে  জল হয়ে গেল।
-হুম। বলে অসীমবাবু হাত বাড়ান চায়ের কাপের দিকে।
-আ মল যা।কাগজ থেকে মুখটা তুললে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হবে শুনি?
-আহা, একটু থামবে তুমি।
-হ্যাঁ,দিন রাত্তির মুখে কুলুপ এঁটেই তো আছি। সারাদিন তো আর পিছু পিছু ঘুরি না।এই সকালটাই একটু কাছে  এসে বসি দুটো কথা বলব বলে!
-সবে একটা ইন্টারেস্টিং খবরে মন দিয়েছি অমনি তুমি...
-রাখো তো তোমার খবর।এই বয়সে এত খবর জেনে করবেটা কি?আরে আরে পড়ে যাবে তো কাপটা! উফ্ এটাও আমাকে হাতে ধরিয়ে দিতে হবে?
তিরিশ বছরের অভ্যস্ত হাত এগোয় চেনা দূরত্বের প্রায় ঠান্ডা হয়ে আসা উষ্ণতার দিকে।
কাপটা ভেঙে যায় সশব্দে। অগত্যা অসীমবাবুকে উঠতেই হয়।এক কাপ চা এখন থেকে তাঁকেই এখন বানিয়ে নিতে হবে অনভ্যস্ত হাতে। রজনীগন্ধার মালায় ঘেরা ফটো ফ্রেমের অসহায় রুনু তাকিয়ে থাকেন নীরবে।

জ্বলদর্চি পেজ-এ লাইক দিন।👇

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments