জ্বলদর্চি

দুটি অণুগল্প / প্রতিমা রায়

দুটি অণুগল্প 

প্রতিমা রায় 

ফোটোগ্রাফি - সৈয়দ স্নেহাংশু 

দৃষ্টি দান


‘ দৃষ্টিদান' আই হসপিটাল । চোখের চিকিৎসা করাতে চোখের দৃষ্টি ফেরাতে এখানে মানুষ আসে। আমিও ওখানে যাতায়াত শুরু করেছি- বাবার ছানিপড়া দুটো চোখে দৃষ্টি ফেরানোর জন্য । আগে থেকে ডেট নিয়ে  যথা দিনে কাউন্টারের  সামনে  লাইনে দাঁড়িয়েছি  । ডাক্তারের ফিস জমা , অপারেশনের রুম নম্বর সব এখান থেকে নিতে হবে ।
লম্বা লাইন । বেশ ভীড় । লাইনে দাঁড়িয়ে ভাবছি – এতো মানুষের চোখের অসুখ ! দৃষ্টি ফেরানোর প্রয়োজন ! যাক্ বাবা এতদিন পর্যন্ত আমার কোন চোখের অসুখ হয়নি ।
পায়ের উপর পা পাড়িয়ে যেতেই সামনে দেখি লোকটাকে । ঠিক করে দাঁড়াতে পারেন না ? বিরক্ত হয়ে বলি ।
স্যরি । যা ভীড়  !
ভীড় তো গায়ে পড়বেন !
লোকটার মুখে একরাশ লম্বা সাদা দাঁড়ি,  মাথায় ফাটা মুসলমানি ক্যাপ , পরনে আধময়লা লুঙ্গি কুর্তা । লোকটা আমাদের স্টেটাসে বিলঙ করে না স্পষ্ট । লোকটাকে দেখে নাক সিঁটিয়ে  আমি নিজেই সরে দাঁড়ালাম ।
কাউন্টার থেকে স্লিপ নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে করিডর হয়ে দোতলা । লাউঞ্জে রোগীরা বসে। পাশে চোখের প্রবলেম অনুয়াযী বিভিন্ন রুমে বিভিন্ন ডাক্তার রোগী দেখছেন । বাবার রুম নম্বর একুশ । লোকটাকে দেখলাম আঠারো নম্বর রুমের সামনে, মানে আই চেক আপে এসেছে ।  বাবার চোখে আই ড্রপ দিয়ে লাউঞ্জে বসাতে প্রেসক্রাইব করা ওষুধ কটা কিনতে হসপিটালের বাইরে এলাম । 
ওষুধ পেতে কিছুটা সময় গেল । ওষুধ নিয়েই বাবার কাছে এসে দেখি---ওই লোকটার একটা হাত বাবা মুঠো করে ধরে আছে , আর লোকটা অন্য হাত দিয়ে ধীরে ধীরে বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে । আমাকে দেখে বাবাকে বলে ---ছেলে এসে গেছে আর ভয় নেই। জানতে পারলাম আমি বেরিয়ে যাবার পরই বাবার শরীরটা খারাপ লাগে, হাত পা কাঁপতে থাকে, বাবা সিটে বসেই পড়ে যাচ্ছিলেন । তখন ঐ লোকটাই বাবাকে ধরে ,,,,ডাক্তার – নার্স ডেকে,,,,,। 
নমস্কার, এবার আসি সাব -বলে লোকটা চলে যেতেই, আপনা আপনি আমার হাতটাও কপালে উঠে গেল , মুখে বললাম—নমস্কার ।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাবার চোখের অপারেশন হয়ে গেল । এখন বাবার চোখে ব্যান্ডেজ । সাতদিন পরে নেক্সট চেক আপ। ডাক্তারবাবু বাবাকে বললেন –- আবার দৃষ্টি ফিরে পাবেন ।
বাবার চোখের অপারেশন সাকসেসফুল কিনা কদিন পরেই জানা যাবে, তার আগেই আমার  দৃষ্টি ফিরে এল ।
আমারও যে চোখের অসুখ ছিল জানতাম না ।।

---------------------------------------
জ্বলদর্চি পেজ-এ লাইক দিন।👇


চর  কথা


সম্পর্কটা  দশ বছর আগে ভেঙ্গে   গিয়েছিল । মেয়েটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিল সে ভাঙন । না কোনো অভিযোগ দোষারোপ বা চোখের জলের ছাপ ছিল না তার মুখে । বেঁকে যাওয়া রাস্তায় সে পার হয়েছিল কত বন জঙ্গল পাহাড় আগ্নেয়গিরি, শুধু নদীর কাছে এসে থেমে গিয়েছিল, তাকে অতিক্রম করতে পারেনি, সঙ্গে নিয়েই চলতে থাকল । ছেলেটির কথা জানে না ,সেও নদী নিয়ে চলে ছিল কিনা খবর রাখেনি ।
সময়ের স্রোতে প্রযুক্তি এলো । মেয়েটিকে কেউ একদিন এফ বি তে নিয়ে এল । তার অ্যাকাউন্ট খুলে দিল । ক্রমশ মেয়েটির অনেক বন্ধু হলো । মাকড়সার জালের মতো বন্ধুত্বের নেটওয়ার্কে একদিন দেখল একজনের ফ্রেন্ডলিস্টে ছেলেটিকে । মাঝবয়েসি, মাথার চুল উঠে ফাঁকা ময়দান , চোখে পুরু চশমা । মেয়েটি সেদিন অনেকক্ষণ রইলো ফেসবুকে ।
কিছুদিন পর মেসেজ বক্সে মেয়েটি একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টের মেসেজ দেখে প্রোফাইলটা খুলল । আর অবাক হয়ে গেল । দীর্ঘ কুড়ি বছর পর একটা ঠান্ডা শিরশিরানি বাতাসে সে কাঁপতে লাগলো । সেদিন সে তার বাড়ির খোলা ছাদে এলো , উন্মুক্ত নীল আকাশ,নক্ষত্ররা জ্বলজ্বল করছে, ওই তো অশ্বিনী,কৃত্তিকা রোহিণী,,  ফিসফিসিয়ে বলল—তোদের নিয়ে নদীর বুকে সাঁতার কাটি চল । ডুব সাঁতার,  চিৎ সাঁতার অনেকদূর ভেসে যাব। সাঁতার কাটতে গিয়ে দেখল নদীর বুকে পলি জমে জমে একটা চর গড়ে উঠেছে । নদীতে স্রোত ও আগের মতো নেই । চরটার কাছে গিয়ে দেখল তার উপর একটা বাড়ি, কী সুন্দর সাজানো গোছানো । তাতে বসে রয়েছে তার ছেলে মেয়ে স্বামী, তার জন্য ও রয়েছে একটা সিংহাসন । চরটার উপরে ফলকে লেখা  -–‘সংসার ‘। চরটার নাম । চরটায় অদ্ভুত একটা মায়া জড়ানো,সঙ্গে ভালোবাসাও । তাদের হাত ধরেই পায়ে পায়ে মেয়ে চরের দিকেই এগিয়ে চলল ।
পেছনে পড়ে রইলো আস্ত নদীখানা । অন্তঃসলিলা হয়ে । তার বুক থেকেই যে চরের জন্ম।
জ্বলদর্চি পেজ-এ লাইক দিন।👇


Post a Comment

2 Comments