জ্বলদর্চি

পারিপার্শ্বিক, পরিবেশ ও সাহিত্যে প্রভাব/অগ্নিমিত্র

২০২১ নতুন বছর নতুন লেখা
পারিপার্শ্বিক, পরিবেশ ও সাহিত্যে প্রভাব
  
অগ্নিমিত্র 

  সাহিত্য হলো আপনার মনের কথা । বা বলা যায় লেখকের অনুভবের বা অভিজ্ঞতার কথা । সাহিত্যকে মনের আয়না বলা যায় । লেখকের পারিপার্শ্বিক বা পরিবেশ তাই অবশ্যই যেকোন সাহিত্য রচনা করার ক্ষেত্রে বিরাট প্রভাব ফেলে। তার কারণ লেখকের মনোভাব বা মননের উপর সেই পারিপার্শ্বিকের একটা বড় প্রভাব পড়ে । মানুষ আর প্রকৃতি ও পরিবেশ তো ভিন্ন নয়; যদিও মানুষ তা সব সময়ে মনে রাখে না। 
   কেউ  যদি এমন পরিবেশে  থাকে যেখানে নিত্যনৈমিত্তিক ঝগড়া, মারামারি, রাহাজানি, শঠতা, প্রবঞ্চনা ইত্যাদি হয়েই চলে, তাহলে সে হয় লিখতেই পারবে না, নয়তো তার লেখায় সেই সব ঘটনারই একটা প্রভাব থাকবে। তখন স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কলম থেকে নেতিবাচক বা বিয়োগান্তক লেখা তৈরী হবে । শহরের ইঁট কাঠ কংক্রিটের জঙ্গলে থেকে সাহিত্য রচনা করলে নাগরিক জীবনের সংগ্রামের প্রতিফলনই ঘটবে তার লেখায়। এটাই মোটামুটি স্বতঃসিদ্ধ ও স্বাভাবিক । স্বাধীনতার সময় ও তার পরবর্তী অশান্ত সময়ের প্রভাব তাই ভালোভাবে দেখা যায় কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকদের লেখায়। 
 আবার কেউ যদি শান্ত, ছায়াসুনিবিড় গ্রাম্য পরিবেশে থাকে ও লেখালেখি করে, তবে তার লেখায় তেমন পরিবেশের প্রতিফলন ঘটতে পারে। বা তার মন শান্ত থাকাতে ভালো লেখা সৃষ্টি হবে।  তেমনই মনোরম নৈসর্গিক সৌন্দর্যময়, নির্মল পরিবেশে লিখতে বসলে লেখকের মনে দারুণ সব ভাব আসতে পারে, নতুন চিন্তার উদয় হতেও পারে । মনে নব উদ্যম ও আনন্দের সঞ্চার হতে পারে। তখন লেখা তো নিজে থেকে সুন্দর হয়ে উঠবেই । 
  কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহে তাঁদের জমিদারীতে পদ্মার ধারে বা শান্তিনিকেতনে সুন্দর বিজন পরিবেশে বসে গল্প ও কবিতা লিখতেন । ' গল্পগুচ্ছ '-তে নানা গল্পে আমরা সেই সব জায়গার ও সেখানকার জনজীবনের বিবরণ পাই । কলকাতার জোড়াসাঁকোতেও বসে তিনি অনেক লেখা লিখেছেন। এখানে একটা কথা বলতেই হবে, যে তাঁর বাড়ির পরিবেশ সাহিত্যের অত্যন্ত  অনুকূল ছিল; পিতা, দাদা , বৌদি, দিদি সকলেই ছিলেন সাহিত্যের গুণগ্রাহী ও পৃষ্ঠপোষক । দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর তো নিজেও স্বনামধন্য লেখক ও সুরকার ছিলেন । তাঁদের জোড়াসাঁকোর বাসায় সাহিত্যচর্চার জন্য ' খামখেয়ালি সভা 'ও বসতো। প্রকাশিত হতো মাসিক ' ভারতী' পত্রিকা।
  কখনো রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন বিদেশে বসে বা যাত্রাপথেও, বা উত্তরবঙ্গের মংপুর বাড়িতে বা দার্জিলিংয়ে বসে । সেসব জায়গার দারুণ নিসর্গ নিশ্চয়ই তাঁর লেখায় এক সুদূরপ্রসারী  প্রভাব বিস্তার করেছিল। ' শেষের কবিতা '-য় শিলং পাহাড়ের নিসর্গের অনন্য বিবরণ পাই আমরা। আবার তাঁর জীবনের নানা দুঃখের ঘটনা ও স্বজনবিয়োগের প্রভাবও দেখা যায় তাঁর অনেক কবিতায়, গল্পে ও গানে । কবি জসিমউদ্দিনের কবিতাতেও এই গ্রাম্য জীবনের প্রভাব ও বর্ণনা পাওয়া যায় ।
   এমনই পরিবেশের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় সেযুগের দুই অমর কথাসাহিত্যিক, বনফুল ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখাতেও, যাঁরা বিহারে বা ' পশ্চিমে ' জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছিলেন । শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যৌবনে বর্মাতে বা ব্রহ্মদেশে কাজও করতেন। তার প্রভাব আছে তাঁর লেখা ' পথের দাবী 'তে। পশ্চিমে ছোটবেলায় থাকার প্রচ্ছন্ন  প্রভাব দেখা যায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ' শ্রীকান্ত' উপন্যাসে, বা তাঁর ' দেওঘর ভ্রমণ'-এও । ' লালু' সিরিজের গল্পগুলিতেও পশ্চিমের বাঙালিদের জীবনযাত্রার আভাস দেখতে পাওয়া যায় । 'পল্লীসমাজ'-এ তাঁর দেখা বাংলার গ্রামীণ জীবনযাত্রা ও গ্রাম্য কূটকচালির বর্ণনা আমরা দেখতে পাই।  আবার কালজয়ী লেখক শ্রী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্মসূত্রে সাঁওতাল পরগণার ঘাটশিলা ও অন্যান্য জায়গায়  থেকেছিলেন অনেকদিন , যার প্রভাব লক্ষ্য করা যায় তাঁর ' আরণ্যক' উপন্যাসে প্রকৃতির অনুপম বর্ণনায় । হয়তো এভাবেই বিভূতিভূষণের প্রকৃতি প্রেমিক সত্তা জাগ্রত হয়ে উঠেছিল । আর এক সুমহান লেখক, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় তাঁর বাসস্থান, রাঢ় বাংলার রূক্ষ কিন্তু সুন্দর প্রকৃতির প্রভাব ও বর্ণনা  ছিল। 'হাঁসুলি বাঁকের উপকথা' ও অন্যান্য লেখায় আমরা তা দেখতে পাই । এখনকার লেখকদের মধ্যে প্রখ্যাত সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহর ' সাসানডিরি', ' কোয়েলের কাছে' প্রভৃতি লেখায় তাঁর সাঁওতাল পরগণার বনাঞ্চলে থাকা ও ভ্রমণের সুস্পষ্ট প্রভাব বেশ লক্ষণীয় । তাই পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি একজন সাহিত্যিককে গভীরভাবে প্রভাবিত করে, একথা ঠিকই । 
  তবে সবসময়ই যে শুধু পরিবেশই বিরাট ভূমিকা পালন করে লেখার ক্ষেত্রে, তা নয়। সব নিয়মেরই তো আখেরে ব্যতিক্রম হয় ! লেখকের উপরও অনেক কিছু নির্ভর করে । তিনি কতটা নিজের চারপাশের পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হবেন, সেটি তাঁর মননের বা মানসিকতার  উপরও নির্ভর করে । তাঁর সাধারণ জ্ঞান বা পড়াশোনার উপরেও অনেক কিছু নির্ভর করে । মাইকেল মধুসূদন দত্ত বা কাজী নজরুল ইসলাম কঠিন জীবনে বা কঠিন সময়েও দারুণ সব সাহিত্য সৃষ্টি করে গিয়েছেন । তাঁদের পরিবেশ বা অবস্থা বা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি  সব সময়ে তাঁদের সাহিত্য সৃষ্টির অনুকূল ছিল না। তাও তাঁরা থেমে থাকেননি । অতুলনীয় সব লেখা লিখে গিয়েছেন ।
 বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ' চাঁদের পাহাড় ' এবং ' হীরা মানিক জ্বলে '-র মতো অপ্রতিম  অ্যাডভেঞ্চারধর্মী লেখা উপহার দিয়েছেন বাংলা সাহিত্যকে । অথচ তিনি নিজে  কখনো দেশের বাইরেই যাননি । পড়াশোনা করে ও সাধারণ জ্ঞানের বা অনুমানের উপর ভিত্তি করেই লিখেছিলেন এই দুটি কালজয়ী উপন্যাস । তাই পরিবেশ বা পরিস্থিতি সব সময়ে শেষ কথা বলে না ।।

আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments