জ্বলদর্চি

যে ব্যক্তি কবি হওয়ার জন্য কবিতা লেখে, সে আসলে কবি নয়/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

২০২১ নতুন বছর নতুন লেখা 
যে ব্যক্তি কবি হওয়ার জন্য কবিতা লেখে, সে আসলে কবি নয়

সন্দীপ কাঞ্জিলাল


কবিতা কেন লিখি- এই প্রশ্নের উত্তরে রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি স্মরণযোগ্য। ১৯০৪ সালে কবি অনুরুদ্ধ হয়েছিলেন, তাঁর নিজের জীবনবৃত্তান্ত লেখার জন্য। তাতে তিনি এক জায়গায় লিখলেন, "আমার জীবনের বিস্তারিত বর্ণনায় কাহারও কোনো লাভ দেখি না। সেই জন্য এ স্থলে আমার জীবনবৃত্তান্ত থেকে বৃত্তান্তটা বাদ দিলাম। কেবল, কাব্যের মধ্য দিয়া আমার কাছে আমার জীবন যেভাবে প্রকাশ পাইয়াছে, তাহাই যথেষ্ট সংক্ষেপে লিখিবার চেষ্টা করিব।" বোঝা গেল, রবীন্দ্রনাথ তাহার কাব্য ও জীবন সম্পৃক্ত বলিয়া মনে করিতেন। সত্যি তো কবিরা লেখে জীবন সম্বন্ধে তাদের টুকরো অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করিবার জন্য। আর সেই সব অনুভূতি ছন্দে শব্দে অন্যান্যদের জীবনের সঙ্গে মিশে গেলে, মানুষ তা উপলব্ধির জন্য পড়তে থাকে যুগের পর যুগ। 

  বাংলা ভাষায় একটা প্রবাদ আছে 'পাগলে কিনা বলে.....।' তেমনি যারা বিষয়ী লোক, তারা মনে করেন কবিরা কি- না বকে। তাই যারা কবি হওয়ার জন্য কবিতা লেখেন,তাদেরকে কবি বলে স্বীকার করতে কষ্ট হয়। 
  "কবি শব্দই বিদ্রোহবাচক,কারণ জীবনের ষড়যন্ত্রময় বস্তুসমূহের মারাত্মক অবস্থান যে মেনে নিতে অস্বীকার করে ও বেঁকে বসে সে-ই কবি।" একথা বলেছিলেন কবি 'শৈলেশ্বর ঘোষ'। কবিতা তাঁর কাছে চেতনার সম্প্রসারণ, আত্মার জাগরণ, নৈঃশব্দের উন্মাদনা, অভিজ্ঞতার সমষ্টি। প্রতিনিয়ত জীবন বাজি রেখে এক অনুসন্ধানমূলক যাত্রাই কবিতা। আর ক্ষমতার মূল্যবোধ থেকে মুক্ত রাখতে হবে কবিতার ভাষা। এই পৃথিবীতে জন্মেও যিনি নিজেকে ভিন গ্রহের বাসিন্দা মনে করেন। তাই তো কবি লেখেন, "যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ প্রাণপণে সরাব পৃথিবীর জঞ্জাল।" তাই এ পৃথিবী ও তাকে আপন করে নিতে পারে না। তাঁকে মনে রাখে বিদ্রোহী হিসাবে। তিনি কবি।

  একজন কবি কবিতা লেখেন নিজেকে প্রকাশের উন্মাদনায়। তিনি তখন মনে রাখেন না তাঁর লেখা ক'জন পড়বে বা ক'জন বুঝবে? যদি একটা কবিতা লেখার পর দ্যাখে তাঁর লেখা কেউ প্রশংসা করছে না, বা তাঁর পরিচিতি হচ্ছে না তাহলেও কবি কিন্তু তার লেখা বন্ধ করে দেন না।তাছাড়া এরূপ ভাবনা একজন কবির ভাবনা নয়। কারণ নিজেকে লিখে রাখাই কবির কাজ। 

  ইংরেজ কবি 'পোপ' কেন তিনি কবিতা লেখেন জানাতে গিয়ে বলেছিলেন,- "To help me thro' this long disease, my life।" একজন কবি দেখেন সূর্য ওঠে ভোরে, মানুষ দল বেঁধে কাজে বেরিয়ে যায় সন্ধ্যায় ফেরে। এই যাওয়া আসার পথে মরে যাচ্ছে কত স্বপ্ন শখ আহ্লাদ। তবু মানুষ চলতেই থাকে। এই চলার মধ্যে নেই কোনো সামঞ্জস্য, নেই কোন ছন্দ। চারিদিকে এতো বিশৃঙ্খলা, তখন কবি চলতে চলতে থমকে দাঁড়ান। তার উপর বয়ে যায় এক বিরুদ্ধ স্রোত। তখন নিজেকে মনে হয়, এ পৃথিবীর আমি কেউ না। মনে করে আমি দূরের কেউ। এই আঘাতে জর্জরিত হতে হতে, তাঁর অস্থির মনের শান্তি খুঁজে নিতে গড়ে তুলেন তাঁর সৃষ্টি। তাইতো  কবিদের রাজা 'বোদলেয়ার' মার্কিন কবি 'পো' এর মধ্যে দেখেছিলেন সেই, "আধুনিক কবিকে, যিনি সর্ব মানবের হয়ে দুঃখ পান।" কিন্তু ডুবন্ত সূর্যের ছটা, চকিত নারীর চাহনি, কিংবা ক্লান্ত দুপুরের বটের ছায়ায় বিশ্রাম দেখতে দেখতে, আমি আমার পৃথিবীকে কতটা বাসযোগ্য রাখতে পারবো বা করতে পারবো তার স্থিরতা নেই। 
কবিতা লেখার পেছনে একটা শক্তি কাজ করে, যাকে গ্রীক দার্শনিক প্লেটো বলছেন 'প্রেরণা'। আর এই প্রেরণা এমন এক শক্তি, যার উপর কোনো নিয়ম খাটে না। এই প্রেরণার মুক্তিস্পৃহা এতটাই প্রবল যে সমস্ত নিয়ম শৃঙ্খলা ভেঙে ভূমিষ্ঠ লাভ করে। এই প্রেরণা যতক্ষণ সক্রিয় থাকে তাকে অস্বীকার করার উপায় ও নেই। তাই যিনি প্রেরণার অধিকারী, তিনি আবার প্রেরণার দাস। আর এই প্রেরণাই অশ্রুতকে শোনায়, অদেখাকে দেখায়। প্রেরণা এলেই লিখতেই হবে, যদি হাতের কাছে কাগজ কলম না-ও থাকে, তবে তাকে মনে মনে বা মুখের ভাষায় প্রকাশ করতেই হবে। প্রেরণা দাবী করে না পাঠক, প্রেরণা দাবী করে প্রেরণার আধিকারিককে। সে প্রেরণা শ্লীল কি অশ্লীল কবির দেখার দরকার নেই। 

  এইজন্য বিখ্যাত রুশ লেখক 'বেলিনস্কি' বলেছিলেন, "Do not worry about the incarnation of ideas. If you are a poet, your work will contain them without your knowledge- they will be moral and national if you follow your inspiration freely." আবার রবীন্দ্রনাথ বলেন, তাঁর কাব্য সৃষ্টির পিছনে যে শক্তি তার নাম 'জীবনদেবতা'। তিনি লেখেন- "এই যে কবি, যিনি আমার সমস্ত ভালোমন্দ, আমার সমস্ত অনুকূল ও প্রতিকূল উপকরণ লইয়া আমার জীবনকে রচনা করিয়া চলিয়াছেন, তাহাকেই আমার কাব্যে আমি 'জীবনদেবতা' নাম দিয়াছি।" তাই তিনি 'জীবনদেবতা' কবিতায় লিখলেন- "ওহে অন্তরতম/ মিটেছে কি তব সকল তিয়াস/ আসি অন্তরে মম?" তাহলে বোঝা গেল তাঁর কাব্যরচনা, কাব্য রচনার জন্য নয়, তাঁর জীবন গঠন করিবার জন্য। 

  কবিতা মানে কোনো অলীক কাণ্ড নয়, বা কোনো দৈব সূত্রে পাওয়া ব্যাপার নয়। সাজানো গোছানো চালাকি নয়। জীবনযাপনের সত্য প্রকাশ কবিতা। যে জীবনকে মানুষ এড়িয়ে থাকতে পছন্দ করে, সেই ছবি কবিতায় প্রকাশ করলে মানুষ আর নিজেকে চিনতে পারে না। সে কবি- যিনি প্রতিষ্ঠান ভাঙ্গার সাহস রাখেন। কারণ প্রতিষ্ঠান সব সময় নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে মানুষকে ভুল জীবন চিনতে শেখায়। প্রতিষ্ঠান ভাঙ্গার অপর নাম নতুন সৃষ্টি। তাইতো রবীন্দ্রনাথ 'জীবনদেবতা' কবিতায় লিখলেন, "গলায়ে গলায়ে বাসনার সোনা/ প্রতিদিন আমি করেছি রচনা/ তোমার ক্ষণিক খেলার লাগিয়া-/ মূরতি নিত্যনব।" 
আবার অনেকে অল্পবয়সে প্রতিষ্ঠিত কবির কবিতা পড়তে পড়তে, তিনিও কবিতা লেখা শুরু করেন। কারণ তাঁর মনের কথার সঙ্গে, তাঁর প্রতিবাদের সঙ্গে, তাঁর নিজস্ব জীবন সেই কবিতায় ফুটে উঠতো। সেই কবির উপর নির্ভর করে কবিতা লিখতে এসে দেখেন, পরবর্তীকালে সেই সব কবিদের আর তাদের পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে যুদ্ধরত বলে মনে হয় না। সেই প্রতিষ্ঠিত কবিদের লেখার ভিতর ফুটে উঠছে পরম বশ্যতার ভঙ্গি। প্রতিষ্ঠান ভাঙ্গার নাম করে এসে, তিনিই মিশে গেলেন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। তাঁরা নিজেদের দোষ ঢাকতে দোহায় দেন শিল্পের। তাঁরা তখন বলেন কবিতা মানে শিল্প। তখনই মনে পড়ে কবি 'শৈলেশ্বর ঘোষের' উক্তি- "ঐ শিল্প কবিতার মধ্যে এমন কোনো অভিব্যক্তি দেখতে পাচ্ছি না যা আমাকে, আমার জীবনকে বুঝতে সাহায্য করে, তার মধ্যে এমন কিছু পাচ্ছি না যাকে সত্য,এবং এক নিশ্চিত নিষ্ঠুর আবিষ্কার বলে মেনে নেওয়া যায়, যার কাছে আত্মসমর্পণ করা যায়, বা যে আমাকে শান্ত করতে পারে, দূর করতে পারে দুঃস্বপ্ন দুঃশ্চিন্তা ভয় তাড়না।" কেননা সত্যের মুখকে ভয় পেয়ে তারা শিল্পের নামে মিথ্যা সামাজিক প্রলেপ দেয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠান? প্রতিষ্ঠান মেনে নেয় এই ষড়যন্ত্রময় অবস্থান, আবার প্রতিষ্ঠান চেষ্টা করে বা বাধ্য করে অন্যকে মানাতে। শিল্পের ফাঁদে আটকে দিতে চায় সত্যের মুখ। তাই প্রতিষ্ঠান মানেই বিপদ। প্রতিষ্ঠান মানেই মিথ্যাচার। তাই কবি আলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত লেখেন, "শুধু থেকে থেকে ত্রস্ত হায়নারা/ জোট বেঁধে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা করে ক্ষমতার লোভে/ এবং ধ্বংসাবশেষ রেখে যায়, কবিদের কাজ/ সে সব বিয়োগফল ধরে রাখা।" 
বিখ্যাত রুশ সমালোচক ডঃ জনসন কে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিল- "Sir, what is poetry?" 'জনসন' উত্তর দিলেন- "why, sir, it is much easier to say what it is not. We all know what light is, but it is not easy to tell what it is." আবার অনেক সময় অনেক কবি মিলে নিজেরা একটা গোষ্ঠী গড়ে তুলেন। সেই গোষ্ঠীর মধ্যে তাদের যত হম্বিতম্বি। সেই গোষ্ঠীকে দিয়ে নিজেরা নিজেদের প্রচার চালান, যাঁরা তাদের গোষ্ঠী নয়, তাঁরা তাদের সমালোচনা করেন। তা দেখে অনেক তরুণ কবি ভয় পেয়ে লেখার জগৎ থেকে সরে যান। তাই কবি 'অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত' তাঁর 'শুধু, তবু' কবিতায় বলেন, "অবিবেকী কবি মজলিসে গিয়ে গোষ্ঠী গড়ে/ কাপুরষ দেখে সংগ্রামীরাও লুকিয়ে পড়ে।"

  আবার অনেক সময় কবিতা লেখা হয়, কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য বা অভিপ্রায়কে সামনে রেখে। হয়ত কোনো এমন ঘটনা আমার সামনে ঘটে গেল, বা কাউকে দেখে আমার বিশেষ কাউকে মনে পড়ে গেল তখন তা নিয়ে কবিতা লেখা হয়ে গেল। চারদিকে যে এত বিশৃঙ্খলা, এত মৃত্যু, রক্তারক্তি, তা তো অনুভবী মনকে নাড়া দিয়ে যাবেই, আর জীবনের সেই অনুভব শব্দে ছন্দে লেখাই তো কবিতা। কবিতাটিতে কতটা শিল্প বা পণ্ডিতদের মতে কবিতা কি-না, তার পরিণাম না জেনেই কবিতা লেখা হয়। যেমন মনে করা যেতেই পারে কিশোরী রাণু যে রবীন্দ্রনাথকে কাদম্বরীর কথা মনে করিয়ে দেয়।আর তাই রবীন্দ্রনাথ লিখেলেন, "এই বুঝি মোর ভোরের তারা এল সাঁঝের তারায় বেশে।" 
কারণ কবিকে শেষ পর্যন্ত ভাবতে হয়, কার জন্য লিখি। যেমন আমি যখন বলি, আমাকে সেই ভাষা নির্বাচন করতে হয়, আমার সামনে কারা বা আমি কাদের বলছি। যে সব মানুষের জন্য লেখেন তিনি মহৎ কবি। আর যারা পারেন না, তাঁরা নির্বাচন করে নেন শ্রোতৃসমাজের একটা ছোট্ট অংশ। যেমন সার্ত বলেছিলেন, "আমাদের সামনে ছোট্ট এক পাঠকবৃত্ত পড়ে আছে বেলাভূমির মতো রৌদ্রময়, আর বৃহৎ পাঠকসমাজ ছড়িয়ে আছে দূরের নীলিমায়, অজানা সমুদ্রের মতো। অনেকে ভাবেন, আজকের কেউ আমার লেখার মর্যাদা না দিলেও সময় অর্থাৎ আগামী ভবিষ্যৎ এর সুদেমূলে পুষিয়ে দেবে। তাই তিনি বর্তমানে এক ছোটো পাঠকসমাজ নিয়েই খুশী থাকেন। কিন্তু এই কথাকে আমল না দিয়ে নজরুল লেখেন, "বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই নবী।" আবার একে উপহাস করে সুকান্ত লিখলেন, "ইতিহাস, নেই অমরত্ব লোভ/ আজ রেখে যাই আজকের বিক্ষোভ।"

  আবার এমন অনেক সময় আসে,যে সময় নিজে দাবী করে কবিতা। কবিকেও সেই দাবী মানতে হয়। না হলে সেই সময় তোমাকেও মানবে কেন? কারণ সবার মতো সময়েরও আছে অমরত্বের লোভ। যখন চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, একটা উত্তেজক মুহূর্ত, ভাঙ্গাগড়ার খেলা। তখন পাঠক ভাবতে পারে শিল্পের কি কাজ? রোম যখন পুড়ে যাচ্ছে,কবি কি নীরোর মত বেহাল বাজাবে? না সত্যের অনুগামী হবে? রবীন্দ্রনাথও একসময় প্রমথ চৌধুরীকে লিখেছিলেন, "দেশের কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে হুকুম আসছে যে সময় খারাপ, অতএব বাঁশি রাখো লাঠি ধরো।" প্লেটোও একদিন কবিকুলকে নির্বাসন দিতে বলেছিলেন  কারণ কবিরা সৌন্দর্যের মোহে মানুষকে সত্য থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। আবার ১৯৩৭ সালে স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় কবি অডেন এবং তাঁর সতীর্থরা একটি প্রশ্নমালা তৈরি করে সে দেশের প্রত্যেক লেখকের কাছে পাঠিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, এখন কর্তব্য কি? কারণ অডেন মনে করতেন লেখকেরা- "The most sensitive instruments in nation." তাইতো 'রূপসী বাংলা', 'বনলতা সেন' এর কবিকে চল্লিশের দুঃসময়ে লিখতে হলো, "মানুষ মেরেছি আমি- তার রক্তে আমার শরীর/ ভরে গেছে, পৃথিবীর ওই নিহত ভ্রাতার ভাই আমি....।"
সেইজন্য চল্লিশের সেই দুঃসময়কে আমরা চিনতে পারি এই কবিতার মধ্যে। তাই আমরা এখন এই কবিতা পড়ে, বুঝে নিতে পারছি সেই সময়টা কেমন ছিল। আর সময়টাকে ধরতে পারলে একজন কবি থেকে যান, সেই সময়ের সুখে দুঃখে উত্থানে। 
তাই আমার মনে হয় একজন কবির উচিৎ কিছু হওয়া নয়। কিছু একটা করা।

আরও পড়ুন

Post a Comment

1 Comments

  1. অসাধারণ লিখেছেন। খুবই ভালো লাগল।
    https://writerofbangldesh.blogspot.com/search/label/https%3A%2F%2Fwriterofbangldesh.blogspot.com%2F2021%2F08%2Fblog-post_84.html?m=1

    ReplyDelete