জ্বলদর্চি

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান -১২/ অনিন্দ্যসুন্দর পাল

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান
(Ancient India, History & Science)

অনিন্দ্যসুন্দর পাল
অলংকরণ- শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য 

দ্বাদশ পর্ব -"সাহিত্য"

গত সমস্ত পর্ব জুড়ে এখনও পর্যন্ত ইতিহাস কি, কয়প্রকার, উৎস ও উত্থানের একটি সার্বিক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এই সার্বিক ধারণা দিতে গিয়ে বেশ কিছু বিষয় নজরহীন হয়ে বাতিল হয়েছে কিংবা কারণ অথবা অকারণ বশত ব্রাত্যও হয়েছে বলা যায়। এতদপরেও আমি আলোচনা শুরু করার প্রথম পর্যায় থেকেই বলে আসছি এখনও পর্যন্ত আলোচিত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে পরবর্তীতে সুযোগ পেলে আলোচনায় আসব। তাই, পূর্বের কথা রাখার ভিত্তিতে এখনের সমস্ত আগাম পর্যায় জুড়ে ধীরে ধীরে সাহিত্য, ধর্ম, বিজ্ঞান, দর্শন শিল্পকলা প্রভূত বিষয় নিয়ে ব্যাখ্যায় আসব। সেহেতু, মনস্থির করেছি বিশেষভাবে সাহিত্য বলতে যা বোঝায় তা দিয়েই এই ধারাভিত্তিক পর্যায়ের পরবর্তী অধ্যায়গুলো শুরু করব। এই পর্যায়ের মূল বিষয় প্রাচীন সাহিত্যের ভিন্ন গতি ও প্রকৃতির খুঁটিনাটি।

প্রাচীন ভারতের আলোচনা করতে গেলে সর্বপ্রথমে নাবিকদের কথা আসবে। কেন না তাদের সেই ভগবানের প্রতি নিবেদন- "আমার জাহাজ এর ক্ষুদ্র আর তোমার সমুদ্র এত বৃহৎ" (যা পূর্বের এই আলোচনাভিত্তিক পর্যায়ে উল্লেখ আছে), যা কিনা মনে করিয়ে দেয় ওই নাবিকদের অন্তরতম প্রদেশের কথা। এই প্রাচীন সাহিত্যে ইতিহাস লিখতে গেলে এইটুকু অস্বীকার করার জায়গা নেই যে, বানভট্ট, আলবিরুনী প্রভূত পরিব্রাজক ও ঐতিহাসিক থেকে শুরু করে এখনও অব্দি যাঁরা বা যে জনেরা ইতিহাস বা সাহিত্য নিয়ে বর্তমানে ভীষণ তৎপর তাদের প্রত্যেকেই সম্পূর্ণ জ্ঞানলাভ যেমন করেছেন, ঠিক তেমনই তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন গত্যন্তরও হয়েছে, যা ভালোভাবে বললে জ্ঞান লাভের পিপাসায় ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় পরিভ্রমন করেছেন বলা যায়। যদিও আগেও উল্লেখ করেছিলাম অশেষ রাষ্ট্রবিপর্যয়, বহু বৈদেশিক আক্রমণ যার ফলে অনেক বৌদ্ধমন্দির, হিন্দুমন্দির, পুস্তক এবং অজস্র পাণ্ডুলিপি নষ্ট হয়েছে, এতদপরেও যেটুকু পুস্তকের বা প্রামাণ্যের উদ্ধার সম্ভব হয়েছে, সেইটুকুর উপর করেই বর্তমান বা প্রাচীন লেখকদের ইতিহাস সাধনা করার দুঃসাহস দেখানো সম্ভব হয়েছে নিঃসংকোচে।

প্রসঙ্গত, এই পুঁথিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঊনবিংশ শতাব্দীর কাম্বেতে দুই জৈন বিহারের ত্রিশ হাজার ও তাঞ্জরের সরস্বতী ভান্ডারের বারো হাজার পুস্তক। তাঞ্জর, মাদ্রাজ, পুণে, কাশী কলকাতা এবং অক্সফোর্ডের বডলিন লাইব্রেরির যথাক্রমে বারো হাজার ও দশ হাজার পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেছিলেন ম্যাকডোলেন ও বিউহলারের মতো প্রাচ্যবিদরা। এতকিছুর পরও আমাদের ভাবতে কষ্ট হয়, কত হাজার হাজার পাণ্ডুলিপি, ঐতিহাসিক সম্পদ অতল গর্ভে চলে না গেলে হয়ত বহু কল্পনাপ্রসূত ধারনার হয়ত সঠিক মূল্যায়ণ হলেও হতে পারত।

যেমন কালিদাসের উল্লেখিত ভাস, সৌমিল্ল ও কবিপুত্রের নাম। যদিও এই বিষয়ে বেশ কিছু মতবিরোধ রয়েছে। সেগুলো বলে রাখা ভালো। এই ভাসের নাট্যসমূহ বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে আবিষ্কৃত হলেও সবকটিই নাটক ভাসের কিনা সে বিষয়ে মতদ্বন্ধ রয়েই গেছে। এছাড়াও এটাও উল্লেখযোগ্য এখনও পর্যন্ত সৌমিল্ল ও কবিপুত্রের কোনোপ্রকার নাটক কিন্তু এখনও উদ্ধার করা যায় নি। এরসাথে আরো উল্লেখযোগ্য পাণিনির পূর্ববর্তী চৌষট্টিজন বৈয়াকরনিকের পুস্তক, পদ্মনাভ ও শ্রীধরাচার্যের বীজগাণিতিক পুস্তক প্রভৃতির কোনো আবিষ্কার সম্ভব হয় নি। এই অনুসন্ধানের গতিপ্রকৃতি দেখে এটুকু ধারণা করাই যায় শুধু সংখ্যার দিক থেকে নয় গুণের দিক থেকেও ভারতীয় সাহিত্য ইউরোপীয় আধুনিক উৎকৃষ্ট কাব্য ও নাট্যের সাথে শুধু পাল্লা দিতেই পারে তাই নয় মাধুর্য ও প্রগাঢ়তার দিক দিয়ে বিচার করলে সমকক্ষে আসন দিতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হওয়ার কথা নয়। অর্থাৎ একথায় বললে ভারতীয় সাহিত্য ব্যাপকভাবে পরিপূর্ণ।

ভিটারনিটসের মতে ভারতীয় কাব্য ও নাটক, মাধুর্য ও প্রগাঢ়তার দিক দিয়ে ইউরোপীয় আধুনিক উৎকৃষ্ট কাব্য ও নাটকের সঙ্গে স্থান পেতে পারে। এথেকেই পরিষ্কার ধারণা করা যায় ভারতীয় সাহিত্য মহাকাব্য, কাব্য, গীতিকাব্য, নাটক, গল্প, দর্শন, বিজ্ঞান, রাষ্ট্র্বনীতি, ধর্মশাস্ত্র, ব্যাকরণ, অভিধান, শিল্পকলা, সঙ্গীত, নৃত্যকলা সম্বন্ধীয় পুস্তকে যেমন সমৃদ্ধ ঠিক তেমন অন্যদিকে একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুন্দর জিনিস সূত্র-সাহিত্যও এককভাবে অলংকৃত। বলাই বাহুল্য, ভারতীয় সাহিত্য শুধু সংস্কৃত সাহিত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বিস্তৃতভাবে পালি তামিল বাংলা ইত্যাদি ভাষাতেও এর সমান অগ্রাধিকার পেয়েছে। তাই আমি মনে করি সংস্কৃত পালি তামিল সাহিত্য আলোচনা এই মূহুর্তে অত্যাবশীয় ও আবশ্যক। সেহেতু, এই পর্যায়ভিত্তিক আলোচনায় সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে কতটুকু আলোচনা রাখতে পারব জানি না, তবুও চেষ্টা রাখব যতটুকু পারা যায় তার আভাস রাখার।
সংস্কৃত সাহিত্য:- উল্লেখ আছে, প্রাচীন ভারতে সমস্ত কাজের উৎস ছিল ধর্ম। এই ধর্ম-সাহিত্যের এক প্রাচীনতম সৃষ্টি ঋগ্বেদ। সাম, যজু, অথর্ব নামক আরো তিন বেদ, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ প্রভৃতি বৈদিক ধর্মগ্রন্থের কোনো কোনো গ্রন্থে কাব্যশক্তির মাহাত্ম্য খুঁজে পেলেও, কাব্যহিসাবে রামায়ণ মহাভারতই এই দুই কাব্যকেই ভারতবর্ষের মহাকাব্য হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। যদিও এই ভাবমূর্তি তৈরী হওয়ার পাশ্চাৎএ বেশ কিছু কারণ আছে। যেমন-

এক, বহু ভাবধারার স্রোত ভারতবর্ষের উপর দিয়ে চলে যাওয়ার পরও, রামায়ণ মহাভারতের অদ্ভুত মোহিনীশক্তির অব্যাহতি আড়াইবছর পরও একই, যার কারণে আজও ভারতের আবালবৃদ্ধবনিতার মন্ত্রমুগ্ধবৎ সমানভাবে পাঠ্য ও শ্রবণযোগ্য।
দুই, রামায়ণ মহাভারতে উক্ত চরিত্রগুলোর উপস্থাপনা এতটাই গোছানো ও যুক্তি ভিত্তিক যেমন, দশরথ ও কৌশল্যার নিকট বিদায়কালীন বর্ননা, ভীষ্মের হস্তিনাপুরের সিংহাসনের প্রতি দায়বদ্ধতা, কুন্তী ও দ্রৌপদীর সংলাপ ইত্যাদি পাঠ ও শ্রবণ করতে করতে কন্ঠরোধ ও ভারাক্রান্ত করতে দেখা গেছে এমন এমন সমালোচকদের যারা কিনা অতীতের প্রতি রেখে গেছেন গভীর অশ্রদ্ধা শুধু নয় বাকতর্কের মাধম্যে সবজিনিসকেই সমালোচনার চর্বিত বস্তু ভেবে থাকেন সর্বদা। এই দিক থেকে মহাভারত রামায়ণ অতুলনীয়।
তিন, রামায়ণ ও মহাভারত, এই দুইয়ের মধ্যে রামায়ণই বেশি জনপ্রিয় হলেও এই দুই মহাকাব্যের নির্মাণ ভাষা এতটাই সহজ সরল প্রাঞ্জল ও মধুর যে সমগ্র পাঠ্যকুলকে আন্তরিক ভঙ্গিতে আকর্ষণ করে।
সর্বশেষ চার, এই দুই মহাকাব্যই ভারতবর্ষের প্রাণের মূর্তবিগ্রহ ও জাতি এবং প্রাণের নির্যাস। জানানেই এই কাব্যদুটি উচ্চাঙ্গের কিনা, তবুও বৈজ্ঞানিকদের মতো মানুষ জাতির ও প্রাণের নির্যাস নির্মাণে অপরাগ। তবুও বাল্মীকি ও ব্যাস নামক মহাকবি বা মহাবৈজ্ঞানিক যে সুন্দর নিপুণ শৈলীর দ্বারা অদ্ভুতভাবে ভারতবর্ষের প্রাণের নির্যাসটুকু গ্রন্থের স্তরে স্তরে অসম্ভব দক্ষতায় বুনে গেছেন একথা স্বীকার করতে বিন্দুমাত্র কোথাও দ্বিধা নেই।

(ক্রমশ....)

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments