জ্বলদর্চি

ফিরে দেখা ২০২০ স্বাগত ২০২১/ গৌতম বাড়ই

ফিরে দেখা ২০২০ স্বাগত ২০২১

গৌতম বাড়ই

এবারের ফিরে দেখা যেন একটু অন্যরকম, একদম আলাদা।
"আমাদের নীল মৃত্যুকাল
আমাদের সাদা সন্তরণ
আমাদের ঢেউগুচ্ছ" ( জয় গোস্বামী )

  ফিরে-দেখা সত্যি ভালো লাগে, যদি ঐ দেখার মধ্যে অনেক আনন্দ উপকরণ জড়িয়ে থাকে। ২০২০ সাল, শুধু রাজ্য বা দেশ নয়, সারা পৃথিবীর কাছে ইতিহাসে কালো অক্ষরে লেখা থাকবে। বিষময় বিষ-বিশ, সালটা ২০২০। তবুও তো আমরা ফিরে দেখতে ভালবাসি। ফিরে- ফিরে দেখি তাই মৃত্যুর স্তূপ। কপাটে দিয়ে তালা, নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার সেই লক-ডাউন এখনও হৃদয়ে কম্পন জাগায়, মনে পড়লেই। কিছু নতুন শব্দের বহুল ব্যবহার হল। কোয়ারেন্টাইন, অন- লাইন ক্লাস, কোডিং এবং সর্বোপরি কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস। নেট দুনিয়ায় ব্যাপক প্রচলন আর ব্যবহার। তবে চলুন উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনাও ফিরে-ফিরে দেখি ২০২০ সালের।

একটু বিশ্বের দিকে ফিরে তাকানো যাক। 

১. বিশ্ব জুড়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মানুষকে সারা বছর আতঙ্কে রেখেছে।

শেষ হচ্ছে ২০২০ সাল- রীতিমত ঘটনাবহুল একটি বছর। যে বছর জুড়ে ছিল প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মহামারির খবর - যা সারা পৃথিবী তছনছ করে দিয়েছে, এবং বহু মানুষের জন্য বিপুল যন্ত্রণার কারণ হয়েছে।

  চীনা কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, চীনের হুবেই প্রদেশে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ে ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৯য়ে, এবং হুবেই প্রদেশে উহান শহরের একটি সামুদ্রিক খাবার ও পশুপাখির বাজারের সাথে প্রথম সংক্রমণগুলোর সম্পর্ক আছে বলে জানা যায়।

  কিন্তু চীনা গবেষকদের এক জরিপ যা ল্যান্সেট চিকিৎসা সাময়িকীতে প্রকাশিত হয় এবছরের গোড়ার দিকে, তাতে বলা হয় কোভিড নাইনটিন ভাইরাসের উপসর্গ দেশটিতে প্রথম পাওয়া যায় ২০১৯ -র ডিসেম্বরের প্রথম দিকে।

  নতুন এই রোগটিকে প্রথমদিকে নানা নামে ব্যাখ্যা করা হলেও ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগটির আনুষ্ঠানিক নাম দেয় কোভিড-১৯ যা 'করোনা ভাইরাস ডিজিজ ২০১৯'-এর সংক্ষিপ্ত রূপ।

  নতুন এই রোগটিকে প্রথমদিকে নানা নামে ডাকা হচ্ছিল, যেমন: 'চায়না ভাইরাস', 'করোনাভাইরাস', '২০১৯ এনকভ', 'নতুন ভাইরাস', 'রহস্য ভাইরাস' ইত্যাদি।

  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১১ই মার্চ ২০২০ কোভিড-১৯ প্রার্দুভাবকে বিশ্ব মহামারি ঘোষণা করে।

  শ্বাসতন্ত্র ও ফুসফুস আক্রমণকারী এই ভাইরাস পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কেড়ে নিয়েছে বহু জীবন, বহু মানুষ দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক জটিলতার শিকার হয়ে এখনও এই রোগের সাথে যুদ্ধ করছে।


২. বৈরুত বিস্ফোরণ 

লেবাননের রাজধানী বৈরুতের বন্দরে ৪-ঠা অগাস্ট রাসায়নিক পদার্থের এক গুদামে বিস্ফোরণ ছিল এ শতাব্দীর ভয়াবহতম 'অ-পারমাণবিক' বিস্ফোরণ।

  বৈরুতের বন্দর এলাকায় বহু বছর ধরে মজুত রাখা প্রায় ২,৭৫০ টন এ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের বিস্ফোরণে নিহত হন দুশয়ের বেশি মানুষ, আহত হন ৬ হাজারেরও বেশি লোক।

  সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা যায় বিধ্বংসী বিস্ফোরণের ঠিক আগে বন্দরে বিশাল এক শস্যের গুদামে আগুন লাগে। তার ৩০ সেকেন্ড পরেই এক বিশাল ও ভয়াবহ বিস্ফোরণ থেকে প্রথমে সৃষ্টি হয় বিশাল আগুনের গোলা, তার পর বাতাসের ঝাপটায় তৈরি হয় ব্যাঙের ছাতার মতো আকারের জল ও বাষ্পের সাদা মেঘ। তার মুহূর্ত পরই পাক খেয়ে উঠতে থাকে লাল রঙের ধোঁয়ার কুণ্ডলি। সেইসঙ্গে শহরের সর্বত্র বিস্ফোরণের ভয়ানক কান ফাটানো তীব্র শব্দ। পুরো ব্যাপারটা ঘটে মাত্র চার সেকেণ্ডের মধ্যে।

  যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষক দল বলে, ওই বিস্ফোরণের আনুমানিক শক্তি ছিল কমপক্ষে ৫০০ টন টিএনটি বিস্ফোরকের সমান। টিএনটি হচ্ছে যুদ্ধে ব্যবহৃত বোমায় যে বিস্ফোরক ব্যবহৃত হয় - তার সংক্ষিপ্ত নাম।

  গবেষক দলের ড. স্যাম রিগবি বিবিসিকে বলেন, "ওই বিস্ফোরণ ছিল যুদ্ধে ব্যবহৃত 'কনভেনশনাল' বা প্রচলিত অস্ত্রের মধ্যে যেগুলো সবচেয়ে বড় - তার চাইতেও ১০ গুণ বেশি শক্তিশালী।"


৩. জর্জ ফ্লয়েড হত্যা ও ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন 
 
২০২০- র মে-মাসের ঘটনা

  আমেরিকার মিনিয়াপোলিসে পুলিশ হেফাজেতে এক কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর জের ধরে ২০২০-তে  সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন।

  পুলিশের হেফাজতে থাকার সময় মারা যান ৪৬ বছর বয়সী আফ্রিকান আমেরিকান নাগরিক মি. ফ্লয়েড।

  অনলাইনে ভাইরাল হওয়া ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, প্রায় আট মিনিট ধরে মি. ফ্লয়েডের ঘাড়ের ওপর হাঁটু গেড়ে তাকে চেপে ধরে রেখেছেন ৪৪ বছর বয়সী শ্বেতাঙ্গ সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক শভিন। জর্জ ফ্লয়েড দম নিতে না পেরে হাঁপাচ্ছেন, আর কাতর কণ্ঠে বারবার অনুনয় করছেন, "প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ"।

  জর্জ ফ্লয়েড মৃত্যুর আগে যে তিনটি শব্দ উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন, তা তার মৃত্যু পর হয়ে ওঠে বিশ্বজোড়া এক আন্দোলনের মূলমন্ত্র "আই কান্ট ব্রিদ"-  "আমি নি:শ্বাস নিতে পারছি না"।
  ভিডিওতে গোটা ঘটনার ছবি তোলেন পথচারী ১৭ বছরের তরুণী ডারনেলা ফ্রেজিয়ার। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠে নিঃশ্বাস না নিতে পারা জর্জ ফ্লয়েডের উচ্চারিত শেষ তিনটি শব্দ- আই কান্ট ব্রিদ।

  হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হন পুলিশ অফিসার ডেরেক শভিন। তাকে আদালতে নেয়ার পর ১ মিলিয়ন ডলারের জামিনে মুক্তি দেয়া হয়। আগামী বছর মার্চে বিচারের শুনানি হবার কথা। ওই সময়ে সেখানে উপস্থিত থাকা আরো তিনজন পুলিশ কর্মকর্তাকেও বরখাস্ত করা হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে হত্যায় সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়।

  জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর প্রতিবাদে আমেরিকার বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ। করোনা ভাইরাস আতঙ্ক উপেক্ষা করে মানুষ প্রতিবাদ সমাবেশ, মিছিল ও বিক্ষোভে পথে নামে।

  বিক্ষোভকারী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি শহরে জারি করা হয় কারফিউ। যুক্তরাষ্ট্রের সংরক্ষিত সামরিক বাহিনী, ন্যাশনাল গার্ডের সেনা মোতায়েনের ঘটনাও ঘটে।আমেরিকায় ব্যাপক বর্ণবাদ বিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার পর পৃথিবীর নানা প্রান্তে পৌঁছয় এই প্রতিবাদের ঢেউ। জন্ম নেয় বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন - ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার।

  সমাজ ব্যবস্থা থেকে বর্ণবাদসহ সব ধরনের বৈষম্যের অবসানের দাবি তুলতে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ। এর অনুষঙ্গ হিসাবে বিক্ষোভকারীরা যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেক ঐতিহাসিক নেতা বা বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের ভাস্কর্য ভাঙচুর করে কিংবা সেগুলো উপড়ে ফেলে।


৪. ইসরায়েল ও মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে নতুন মোড়

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ১৩ই অগাস্ট ইসরায়েল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ঘোষণা ছিল মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।

  নিউইয়র্ক টাইমসের বিখ্যাত কলামিস্ট টমাস এল ফ্রিডম্যান এই ঘোষণাকে ব্যাখ্যা করেন "মধ্যপ্রাচ্যের একটি ভূ-রাজনৈতিক ভূমিকম্প" বলে।

  ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তিতে মধ্যস্থতা করেছিলেন। পুরো আলোচনাটি চলেছিল এতটাই গোপনে যে, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত নাকি এ বিষয়ে কিছু জানতেন না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে এই ঘোষণা দেয়ার পরপরই ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু হিব্রুতে টুইট করেন, "এক ঐতিহাসিক দিন‍।"

  এক যুক্ত বিবৃতিতে ইসরায়েল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত জানায়, "এই ঐতিহাসিক অগ্রগতি  মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির এগিয়ে থাকবার যাত্রায় সাহায্য করবে" বলে তারা আশা করেন।

  তারা জানায়, দুই দেশের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্কের বিনিময়ে ইসরায়েল পশ্চিম তীরের বিশাল ফিলিস্তিনি এলাকা ইসরায়েলের অংশ করে নেয়ার কাজ আপাতত স্থগিত রাখবে। এর এক মাস পরেই ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ঘোষণা দেয় বাহরাইনও। ইসরায়েলের জন্য এই দুটি আরব রাষ্ট্রের সাথে হাত মেলানো ছিল সত্যিকার অর্থেই এক বিরাট অর্জন।

৫. যুদ্ধের দামামা

নাগোর্নো-কারাবাখ- পূর্ব ইউরোপে দক্ষিণ ককেশাসের বিরোধপূর্ণ এলাকাটিকে কেন্দ্র করে ২৭শে সেপ্টেম্বর আবার যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে। এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুটো দেশের মধ্যে এর আগেও সংঘর্ষ হয়েছে। সমঝোতার মাধ্যমে ছয় বছর ধরে চলা যুদ্ধ ১৯৯৪ সালে থেমে গেলেও তাদের মধ্যে কখনও শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি।

  আন্তর্জাতিকভাবে এই এলাকাটি আজারবাইজানের অংশ বলে স্বীকৃত হলেও, আর্মেনিয়ার সরকারের সমর্থনে জাতিগত আর্মেনীয়রা এটি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। দুটো দেশই এলাকাটিকে তাদের নিজেদের অংশ বলে দাবি করে। রাশিয়ার মধ্যস্থতায় নভেম্বরে একটা শান্তি চুক্তি হলেও তা কার্যকর হয়নি।

  ছয় সপ্তাহের বেশি চলা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে দু পক্ষের ৫ হাজারের বেশি সৈন্য প্রাণ হারিয়েছে।

  আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানকে নিয়ে রাশিয়ার শান্তি চুক্তি ইথিওপিয়া- দেশটির সরকারি বাহিনীর সাথে উত্তরে টিগ্রে'র ক্ষমতাসীন দল টিগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট (টিপিএলএফ)এর মধ্যে তীব্র লড়াই শুরু হয় নভেম্বর মাসে।

  ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যাবি আহমেদ টিগ্রের আঞ্চলিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বলেন টিগ্রেতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সেনা ঘাঁটিতে টিপিএলএফের হামলার জবাবে তিনি সামরিক আগ্রাসনের নির্দেশ দিয়েছেন।

  টিপিএলএফ-এর নেতাদের সাথে মি. আহমেদের তিক্ত সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। সাম্প্রতিক সংঘর্ষে শত শত মানুষ মারা গেছে এবং কয়েক হাজার মানুষ ঘড়ছাড়া হয়েছেন। সরকারি বাহিনী টিগ্রের ওপর স্থল ও বিমান আক্রমণ চালিয়েছে।

  'ইথিওপিয়া থেকে ছোঁড়া' রকেট গিয়ে হামলা চালালো এরিত্রিয়ায়।

৬. প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের আগুন

পৃথিবীর বেশ কিছু দেশ ২০২০ সালে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ দেখেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:

  হংকং- হংকংয়ে গণতন্ত্রপন্থীদের অব্যাহত চীন বিরোধী বিক্ষোভ দমন করতে কর্তৃপক্ষ নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইন আনার প্রস্তাব করলে হংকং-য়ে এর বিরোধিতা করে ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়, পুলিশের সাথে সংঘর্ষ চলে প্রতিবাদকারীদের। গ্রেপ্তার হয় শত শত মানুষ। এরপর ৩০শে জুন চীন দেশদ্রোহিতা, বিচ্ছিন্নতাবাদ, নাশকতা নিষিদ্ধ করে নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইন পাশ করে। সমালোচকরা বলছেন হংকংয়ের সংক্ষিপ্ত সংবিধানে দেশটিকে যে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে এই আইন তা খর্ব করবে।

  থাইল্যান্ড- জুলাই মাস থেকে হাজার হাজার বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রী রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছে থাইল্যান্ডের রাজতন্ত্র আর রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটানোর দাবিতে। থাইল্যান্ডের রাজার অসীম ক্ষমতা খর্ব করার দাবি জানাচ্ছে তারা, রাজার জন্য জনগণের অর্থ ব্যয়েরও সীমা বেঁধে দিতে চায় তারা। থাইল্যান্ডের আধুনিক ইতিহাসে রাজাকে এরকম প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করার উদাহারণ আর নেই। বিক্ষোভ দমনে সরকার সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, জারি করেছে জরুরি অবস্থা। তরুণ প্রজন্ম যেভাবে রাজতন্ত্র এবং এর প্রতিনিধিত্বকারী সবকিছুকেই প্রশ্ন করতে শুরু করেছে তাতে এটি এক দীর্ঘ অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের শুরু বলেই অনেকে মনে করছে।

৭. আমেরিকার নির্বাচন

সারা বছর ধরে বিশ্বের নজর ছিল আমেরিকার ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে, যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৪ঠা নভেম্বর।

  যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০-র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে ছিল নজিরবিহীন সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিভাজন, তিক্ততা ও নোংরামি।

  ফলাফল ঘোষণার পর্বও ছিল চরম নাটকীয়। ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে এগিয়ে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন যখন দাবি করেন তিনি জয়ের পথে রয়েছেন, তখন রিপাবলিকান মি. ট্রাম্প ভোট জালিয়াতি এবং ব্যালট চুরির অভিযোগ এনে দাবি করেন নির্বাচনে তিনিই জয়ী হয়েছেন।

  ভোট প্রচারের  সময়ই ডোনাল্ড ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, নির্বাচনী ফলের ব্যবধান যদি খুব কম হয়, তিনি তার বিজয় ছিনিয়ে নেবার লক্ষ্যে ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে ভোট কারচুপির অভিযোগ আনবেন। কয়েক লাখ বৈধ ব্যালট গণনা বাকি থাকতেই তিনি নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করেন।

  তার ডেমোক্র্যাট প্রতিপক্ষ জো বাইডেনও বলেন "প্রতিটি ভোট গোণা শেষ না হওয়া পর্যন্ত" এই নির্বাচন শেষ হবে না। তিনিও জোর দিয়ে বলেন "ডেমোক্র্যাটরা জয়ের পথে রয়েছে।"

  ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে জো বাইডেনের পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়া নিশ্চিত হয় ১৫ই ডিসেম্বর। মি. বাইডেন পান ৩০৬টি ইলেকটোরাল ভোট আর বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পান ২৩২টি।

  নির্বাচনের পর থেকেই মি. ট্রাম্প হুমকি দিয়েছিলেন যে ফল নিয়ে তিনি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হবেন, আইনি পদক্ষেপসহ নানাভাবে ফল পাল্টানোর চেষ্টা করেন মামলা করার মাধ্যমে।

  তবে ইলেকটোরাল কলেজের ভোটের পর এখনো চুপ করে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যদিও তিনি এখনো পরাজয় স্বীকার করেননি, বরং নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু তার মামলাগুলো একের পর এক বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের আদালতে খারিজ হয়ে গেছে।

  ট্রাম্প শিবির বলছে তাদের আইনি লড়াই চলতে থাকবে, এবং তারা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যাবেন - যদিও সুপ্রিম কোর্টে এরকম কোন আপিল শোনা হবে কিনা এবং তা নির্বাচনী ফল উল্টে দিতে পারবে কিনা - তার কোন নিশ্চয়তা নেই।

  ভোটের ফল এখন ওয়াশিংটন ডিসিতে পাঠানো হবে এবং কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে আগামী ৬ই জানুয়ারি আনুষ্ঠানিক গণনা হবে। এটাই আগামী ২০-শে জানুয়ারি, ২০২১ মিস্টার বাইডেনের শপথ নেয়ার পথ তৈরি করবে।

  আমেরিকার ইতিহাসে এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছেন একজন নারী। শুধু নারী হিসাবেই নয় কমালা হ্যারিস কৃষ্ণাঙ্গ এবং দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভুত ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েও ইতিহাস তৈরি করেছেন।

৮. ভারতবর্ষ এবং পশ্চিমবঙ্গের ২০২০-সালের উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা। 

বর্ষ পরিক্রমা ২০২০ : ফেলে আসা বছরে ভারতে
বাকি দুনিয়ার মতো ভারতেও করোনা ভাইরাস মহামারি এবছর বাকি সব কিছু তছনছ করে দিয়েছে। দেখলাম আমফানের তাণ্ডব। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি। 
বস্তুত গোটা দুনিয়ায় এখনও পর্যন্ত ভারতেই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক কোভিড রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এর পাশাপাশি বছরের শুরুতে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা বছরের শেষে কৃষক আন্দোলনেও উত্তাল হয়েছে ভারত।

  ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় রক্তাক্ত হয়েছে রাজধানী দিল্লি, ভারতীয় সেনাদের রক্ত ঝরেছে লাদাখের চীন-ভারত সীমান্তেও।

  এই প্রতিবেদনে নজর দেওয়া হয়েছে মহামারি-সহ বছরের এমনই পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার দিকে।

নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

করোনাভাইরাসের সঙ্গে তখনও ভারতের পরিচয় হয়নি - এদেশে ২০২০ সাল শুরু হয়েছিল তখন সদ্য পাস-হওয়া নাগরিকত্ব আইন আর প্রস্তাবিত এনআরসি-র বিরুদ্ধে দেশব্যাপী উত্তাল প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে।

  এই উদ্যোগকে অনেকেই দেখেছিলেন সমাজের একটা শ্রেণীকে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা হিসেবে - যারা শপথ নিচ্ছিলেন কিছুতেই সরকারের কাছে নিজেদের পরিচয়ের নথিপত্র পেশ করবেন না, কাগজ দেখাবেন না!

  দিল্লির শাহীনবাগ হয়ে উঠেছিল নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এপিসেন্টার। আট থেকে আশি বছর বয়সী মুসলিম নারীরাই সে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তাঁরা বলছিলেন, "আমাদের দেশদ্রোহী বা পাকিস্তানি বলে চিহ্নিত করার হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও ভারতীয়রা কিন্তু সেই চেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন।" জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার ছাত্রী তবাসসুম বিবিসিকে বলছিলেন, 
"আজ অবশেষে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে সারা দেশের সঙ্গে দিল্লি রাজপথে নেমে এসেছে - আমি এখন কীভাবে ঘরে আটকে থাকতে পারি?"

দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা

ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে এই বিক্ষোভকারীরাই যখন উত্তর-পূর্ব দিল্লির জাফরাবাদে পথ অবরোধ করে অবস্থান বিক্ষোভে বসলেন, পরিস্থিতি দ্রুত অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠল।

  বিজেপির বিতর্কিত নেতা কপিল মিশ্র পুলিশ কর্মকর্তাদের সামনে দাঁড়িয়েই হুমকি দিলেন, ভালোয় ভালোয় রাস্তা খালি না- করা হলে তারা হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন না এবং পরিণতির জন্যও দায়ী থাকবেন না।

  জাফরাবাদে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে পথ অবরোধ তোলার চেষ্টা থেকে হিংসা ছড়িয়ে পড়ে দিল্লিতে। পরবর্তী প্রায় চারদিন ধরে রাজধানীর এক বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে যে সাম্প্রদায়িক তান্ডব চলল, তাতে কম করে ৫৩ জন নিহত হলেন।

  মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তখন দিল্লি সফরে, এরই মধ্যে জ্বালিয়ে দেওয়া হল শহরের অসংখ্য বাড়ি-ঘর। নালা থেকে উদ্ধার হল দাঙ্গায় নিহতদের লাশ।তবে লেখক ও চিন্তাবিদ তিলোত্তমা মজুমদার বলছিলেন, তিনি কিন্তু মনে করেন না দাঙ্গা আর প্রতিবাদের রসায়নটা কখনও একই রকম হতে পারে।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন,  "চরিত্রগতভাবেই প্রতিবাদ আর দাঙ্গা দুটো কিন্তু আলাদা জিনিস।"
"একটা দাঙ্গার পেছনে সামাজিক বা রাজনৈতিক নানা রকম উসকানি থাকতে পারে। ব্যক্তিগত কোনও উদ্দেশ্যও থাকতে পারে দাঙ্গা লাগানোর।" "তবু আমি বলব, দিল্লির দাঙ্গা যে সারা দেশে ছড়ায়নি সেটা প্রমাণ করে যে মানুষের শুভ বোধ এখনও জাগ্রত আছে। বেশির ভাগ ভারতীয় যে দাঙ্গা চান না সেই বিশ্বাসটাই তাতে জোরালো হয়।" "অন্যদিকে যে মানুষের আন্দোলনগুলো - সেটা কখনও কোনও নতুন আইনের বিরুদ্ধে, কখনও সরকারি কোনও প্রকল্প বা পদক্ষেপের বিরুদ্ধে - গণতন্ত্রে কিন্তু তার গুরুত্বই আলাদা।" "যে কোনও সার্থক গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল বিরুদ্ধ মতকেও স্বাধীনভাবে প্রকাশ করার জায়গাটা থাকা, সাহসটা থাকা।" "এ- বছর প্রমাণ হয়েছে যে ভারতে এখনও সেই প্রতিবাদের স্পেসটা আছে এবং এ দেশের গণতন্ত্র নিয়ে এখনও ভরসাটুকু হারিয়ে যায়নি", বলছিলেন তিলোত্তমা মজুমদার।

মহামারি, লকডাউন, টিকা

দিল্লি দাঙ্গার রেশ না থিতোতেই দেশ পড়ল ভয়াবহ মহামারির কবলে। পুলিশ জোর করে উঠিয়ে দিল শাহীনবাগের বিক্ষোভ। আর একশো তিরিশ কোটি মানুষের বিশাল দেশ রাতারাতি পড়ল কঠোর লকডাউনের কবলে।

  ২৪শে মার্চ রাতে মাত্র তিন ঘন্টার নোটিশে সারা দেশে লকডাউন জারির কথা ঘোষণা করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

  মোবাইল ফোনে, টিভিতে প্রধানমন্ত্রীর সে দিনের ভাষণ শোনেন কোটি কোটি ভারতীয়। বললেন, "দেশের প্রতিটি পরিবারকে বাঁচানোর জন্যই এই পদক্ষেপ - ঘর থেকে বেরোনোও পুরোপুরি নিষেধ।"
পরবর্তী কয়েকদিনে দেখা গেল হাজার হাজার দরিদ্র অভিবাসী শ্রমিক গ্রামে ফেরার মরিয়া চেষ্টায় পথে নেমে এসেছেন, জাতীয় সড়ক বেয়ে শত শত মাইল হাঁটতেও শুরু করে দিয়েছেন। কোলের শিশুকে শহরে কিছু খাওয়াতে না-পেরে গ্রামের পথে হাঁটা ছাড়া যে কোনও উপায় নেই, কাজকর্ম হারিয়ে সে কথাই বলছিলেন শ্রমিক বধূরা। বিহারের ট্রেনের টিকিটের ভাড়া আড়াই হাজার টাকা করে, দুজনের ভাড়া কীভাবে জোগাড় করবেন অসহায়ভাবে সে প্রশ্ন তুলছিলেন চম্পারন থেকে দিল্লিতে কাজ করতে আসা মজদুর রাজেন রাম। লকডাউনে জাতীয় সড়ক বেয়ে চলতে শুরু করেন হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক।

 "এই পরিযায়ী শ্রমিকরাও তো ভারতেরই নাগরিক, বিদেশে প্লেন পাঠিয়ে যদি আটকে পড়া ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনা যায় তাহলে এই গরিব মেহনতি মানুষগুলোকে কেন সরকার ঘরে ফেরানোর ব্যবস্থা করবে না?", সে প্রশ্নও তুললেন কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী।

  ওদিকে ভাইরাসের বিস্তার ক্রমশ বাড়তে থাকায় হিমশিম খেতে শুরু করল ভারতের স্বাস্থ্য অবকাঠামো। মুম্বাইয়ের এক হাসপাতালে চিকিৎসকরা বিবিসিকে বলছিলেন, কী অসম্ভব কঠিন এক যুদ্ধ তাদের লড়তে হচ্ছে - রোগী, ডাক্তার, নার্স সবাই এক অচেনা শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন।

  কোভিড টেস্ট করানো কিংবা হাসপাতালে বেড পাওয়ার সমস্যা তো ছিলই,  গ্রামীণ ভারতেও সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর পরিস্থিতি একটা পর্যায়ে প্রায় হাতের বাইরেই চলে গিয়েছিল। বহু মানুষ তখন প্রায় বিনা চিকিৎসায় প্রিয়জনকে হারিয়েছেন। কোভিড-আক্রান্ত মা কীভাবে হাসপাতাল থেকে চিরতরে চোখের আড়ালে চলে গেলেন, বাচ্চা ছেলেকে তার কোনও জবাব দিতে পারেননি অসহায় বাবা। 

  তিলোত্তমা মজুমদার বলছিলেন তাঁর সাক্ষাৎকারে, ভারতবর্ষ যে পথে এই সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে সেই রাস্তাটা কিন্তু একটা চরম অপ্রস্তুতির পরিচয় দিয়েছে। স্বাস্থ্য অবকাঠামোর দিক থেকে আমরা যে এই পরিস্থিতির জন্য বিন্দুমাত্র তৈরি ছিলাম না সেটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে। পাশাপাশি অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিককে এই লকাডাউনে যে করুণ পরিণতির সম্মুখীন হতে হয়েছে তাতেও পরিষ্কার যে খেটে-খাওয়া, দরিদ্র মেহনতি মানুষগুলোর জন্য আমাদের ন্যূনতম পরিকল্পনাও ছিল না।

  অথচ সারা দেশে যখন আধার কার্ডের মতো জাতীয় পরিচয়পত্র চালু হল, তখন বলা হয়েছিল এই একটা নম্বর দিয়েই ভারতীয়রা বিভিন্ন আধুনিক দেশের নাগরিকদের মতো সব সুযোগ-সুবিধা পাবেন।

  সেই বড় বড় প্রতিজ্ঞাগুলো যে কত বড় মিথ্যা ও কত অন্তসারশূন্য, লকডাউনের সময় ভারতের মানুষ কিন্তু তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন।

আশার আলো বছর শেষে

বছর শেষে কিছুটা আশার আলো অবশ্য দেখিয়েছে অচিরেই করোনা ভ্যাকসিন মেলার খবর - এবং বিশ্বের ভ্যাকসিন উৎপাদনে ভারতও সম্ভবত একটি প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠতে চলেছে।

  পুনের সিরাম ইনস্টিটিউটের সিইও আদার পুনাওয়ালার কথায়, "যেহেতু বিশ্বের মোট ভ্যাকসিন উৎপাদন সামর্থ্যের ৭০ শতাংশই ভারতে তাই অবশ্যই এখানে ভারতের বড় ভূমিকা থাকবে।"

  মহামারির প্রকোপ হয়তো একদিন থিতোবে, কিন্তু ভারতীয়দের রোজকার অর্থনীতিতে তা কত বড় আঘাত দিয়ে গেল সেই হিসেব কিন্তু এখনও কষাই শুরু হয়নি - বলছিলেন লেখিকা তিলোত্তমা মজুমদার। তাঁর কথায়, "লকডাউনে কত লোককে যে কত কোম্পানি ছাঁটাই করেছে, কত লোক যে গত সাত-আটমাস ধরে অর্ধেক বেতনে বা কম বেতনে কাজ করছে তার কোনও পরিসংখ্যান কিন্তু এখনও নেই।" "এগুলো পেলেই হয়তো একদিন বোঝা যাবে মহামারি আর লকডাউন কী বিরাট আঘাত হেনে গেল!"

লাদাখে ভারত-চীন সংঘর্ষ

মহামারি যখন তুঙ্গে, তখনই জুন মাসের মাঝামাঝি খবর এল লাদাখ সীমান্তে গালওয়ান উপত্যকায় চীনা সৈন্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে ভারতের অন্তত বিশজন সেনা প্রাণ হারিয়েছেন। গত পঁয়তাল্লিশ বছরের মধ্যে সেই প্রথম চীন-ভারত সীমান্তে রক্তপাতের ঘটনা ঘটল। দেশের নানা প্রান্তে নিহত সৈন্যদের শেষ বিদায় জানানো হল সামরিক মর্যাদায়। লাদাখের এই প্যাংগং লেকেও ভারত ও চীনের সেনারা রয়েছে মুখোমুখি অবস্থানে। লাদাখে বাড়তি সেনা মোতায়েন করে আর একগুচ্ছ চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করে পাল্টা পদক্ষেপ নিল ভারত।

  চীনের সঙ্গে পরবর্তী কয়েক দফা শান্তি আলোচনায় অংশ নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও স্বীকার করলেন, "সীমান্তে শান্তি যখন একবার বিঘ্নিত হয়েছে তখন দুদেশের সম্পর্ক আগের মতোই থাকবে সেটা আর আশা করা যায় না।" তিলোত্তমা মজুমদার মনে করছেন, চীন-ভারত সীমান্ত বিতর্কের নিষ্পত্তি না-হওয়াই এই সংঘাতের মূলে। বিবিসিকে তিনি বলছিলেন, "যেভাবে কাশ্মীর ইস্যুটাকে বছরের পর বছর ধরে অমীমাংসিত রাখা হয়েছে, আমার ধারণা চীন-ভারত সীমান্ত প্রশ্নটাও সেভাবেই বহু বছর ধরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।

  "দুদেশের সীমান্তই এখনও স্পষ্টভাবে চিহ্নিত নয়, কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা কোনও সরকার বা প্রধানমন্ত্রীকেই দেখিনি এই বিষয়টার একটা নিষ্পত্তি করে ছাড়বেন সেই অঙ্গীকারের জায়গায় পৌঁছতে পেরেছেন। "যেমন মহামারিতে যখন অর্থনীতির বিপর্যস্ত দশা, ঠিক তখনই কিন্তু আমরা দেখলাম লাদাখে চীনের সঙ্গে সাঙ্ঘাতিক গন্ডগোল শুরু হয়ে গেল।" "ব্যাস, সারা দেশে সঙ্গে সঙ্গে দেশাত্মবোধের ঝড় বইতে লাগল। হুকুম এল, অমুক অমুক চাইনিজ অ্যাপ ব্যবহার করা যাবে না - কেন না চীন এখন আমাদের শত্রু হয়ে গেছে।"

বছর শেষে কৃষক আন্দোলন

গত ২৬ নভেম্বর থেকে দিল্লির সীমান্তে অবস্থান করছেন হাজার হাজার কৃষক।

  এদিকে চীন সীমান্তে উত্তেজনা আর অশান্তির ঘনঘটার মধ্যেই নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে রাজধানী দিল্লি অবরুদ্ধ করে ফেললেন পাঞ্জাব ও হরিয়ানা থেকে আসা হাজার হাজার কৃষক। তাঁদের দাবি, সম্প্রতি পাস হওয়া তিনটি কৃষি আইন - যা ভারতে কর্পোরেট-নিয়ন্ত্রিত, চুক্তিবদ্ধ চাষের পথ প্রশস্ত করবে বলে বলা হচ্ছে সেগুলো বাতিল করতে হবে এবং মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস বা ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের গ্যারান্টি দিতে হবে। দাবি আদায়ে চাপ দিতে তারা যে বেশ কয়েক মাসের রসদ নিয়েই দিল্লি এসেছেন সে কথাও জানিয়ে দেন পাঞ্জাবের এই কৃষকরা। পাঞ্জাবের কৃষকরা বলছেন দীর্ঘ আন্দোলনের প্রস্তুতি নিয়েই তারা দিল্লিতে এসেছেন।

  এর মধ্যে সরকারের সঙ্গে কৃষক নেতাদের বেশ কয়েক দফা বৈঠক হলেও কোনও সমাধান বেরোয়নি।বড়দিনের মুখেও তারা দিল্লির সিঙ্ঘু ও টিকরি, এই দুটি সীমান্ত অবরোধ করে রেখেছেন। ফলে দিল্লিতে বছর শুরু হয়েছিল শাহীনবাগ দিয়ে, আর শেষ হচ্ছে সিঙ্ঘুতে - যার মাঝখানে পুরো সময়টা জুড়িয়ে জাঁকিয়ে রইল করোনাভাইরাস মহামারি।

অবশেষে আসি পশ্চিমবঙ্গের কথায়

করোনা ভাইরাসের আঘাত সারাবিশ্ব সারাদেশের সঙ্গে এ- রাজ্যেও এসেছে। এখনও আক্রান্তের ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে চলেছে। তবে ঐ অতিমারির মধ্যে আম্ফান ঝড় ( ২০-শে মে, ২০২০) রাজ্যকে বিধ্বস্ত এবং বিপন্ন  করে দিয়েছিল। বিশেষ করে রাজ্যের দক্ষিণ ভাগে। ৭২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় পরদিন। তারপর ত্রাণ বিলি নিয়ে সরকার আর বিরোধীদের চাপান উতোর চলতেই থাকে। বহু পরিযায়ী ফিরে আসতেই ভেঙ্গে পড়ে রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা। সামনের বছর বিধানসভা ভোট। ক্রমে উত্তপ্ত হচ্ছে রাজনৈতিক পরিবেশ। সাধারণ জনগণ হিংসার অশনিসঙ্কেত দেখতে পাচ্ছেন রাজনীতির আকাশে। মাত্র এক বা দুদিন পরে সেই নতুন বছরের শুরু। তার আগে স্মরণ করি ও বিনম্র চিত্তে শ্রদ্ধা জানাই সেইসব রাজ্য, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের বরেণ্য মানুষদের এঁরা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন পেশায় জড়িত ছিলেন এবং তাদের উজ্বল স্বকীয়তা বজায় রেখেছিলেন, আমরা হারিয়ে ফেলেছি তাদের  এই ২০২০ সালেই। তাঁদের কজনের নাম এখানে উল্লেখ করছি।
(১)  প্রণব মুখোপাধ্যায় (প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ) (২)  সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র তারকা, কবি, নাট্য ব্যক্তিত্ব )
(৩)  সুধীর চক্রবর্তী ( লেখক, লোক-সাহিত্য গবেষক) (৪) দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা ( ফুটবল বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়) (৫) ইরফান খান ( চলচ্চিত্র তারকা) (৬) ঋষি কাপুর ( চলচ্চিত্র তারকা ) (৭) চুনী গোস্বামী (খ্যাতি সম্পন্ন ফুটবলার )  (৮) পি কে ব্যানার্জী ( স্বনামধন্য ফুটবলার এবং কোচ ) (৯) আনিসুজ্জামান ( সাহিত্য জগতের দিকপাল ব্যক্তিত্ব) (১০) দেবেশ রায় ( সাহিত্যিক ) (১১) সুশান্ত সিং রাজপুত ( উঠতি চলচ্চিত্র তারকা ) প্রমুখ।

৯. সাহিত্যে নোবেল 
২০২০ সালে সাহিত্যে নোবেল পেলেন লুইজ গ্লাক।

১০. ফিরে-দেখি শেষে 

তাই-তো বলতে চাই ২০২০ তুমি কখন যাচ্ছ? পুরো বিশ্ব জর্জরিত করোনা মহামারি জনিত মৃত্যু, অসুস্থতা, চাকরি হারানো হতাশা ইত্যাদিতে। তুমি কেড়ে নিয়েছ রোগ ব্যাধির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ অনেক দামী চিকিৎসকদের। তুমি দিয়েছ মুখে মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার নতুন মাত্রা। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে যোগাযোগ, প্রশিক্ষণ, ওয়ার্কশপ, শ্রেণী কক্ষের কাজ পরিচালনা করার জন্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে এবং প্রভূত উন্নতিও হয়েছে। 

  পরিশেষে বলতে চাই- বিদায় ২০২০, বিদায় করোনা। স্বাগত ২০২১, স্বাগত ভ্যাকসিন "কোভিশিল্ড"।

(তথ্যসূত্র এবং কৃতজ্ঞতা: বিবিসি, বর্তমান, সংবাদপ্রতিদিন, আনন্দবাজার পত্রিকা ইত্যাদি।)

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments