জ্বলদর্চি

সেই অল্পদূরের স্বপ্নপুরে:ভৈরবচন্দ্রপুরে/গৌতম বাড়ই

সেই অল্পদূরের স্বপ্নপুরে:ভৈরবচন্দ্রপুরে

গৌতম বাড়ই


সময়ের কথা মেপে মেপেই চলি। সময়ের কিছু কথা মনে লেগে থাকে, কিছু মন থেকে হারিয়ে যায়। কিছুর চর্চা অবিরত চলে। কিছু কখনও মনে পড়ে কচ্চিৎ।

ভৈরবচন্দ্রপুর। কেউ কখনও ঐ গ্রামের নাম হয়ত না শুনেও থাকতে পারে। রাণাঘাট পেরিয়ে যে রেললাইন গেদে স্টেশনের দিকে গিয়েছে ঐ লাইনে বগুলা স্টেশনের পরে ছোট্ট একটি হল্ট স্টেশন ছিল ময়ূরহাট বলে। নেমেছি। নদীয়া জেলা। আমার তরুণ বয়সের গোড়ায়।যখন হুট বললেই বোঁচকা কাঁধে বেরিয়ে পড়া। সবার ভেতরেই তো থাকে দিকশূন্যপুরে হারিয়ে যাওয়ার টান। একদম গন্ডগ্রাম। স্টেশনে নেমে গ্রামবাংলার সেই আদি অকৃত্রিম ঘ্রাণ পেলাম। এখান থেকে চার কিলোমিটার পথ হেঁটে ভৈরব গ্রামে পৌঁছাবো। সঙ্গে রয়েছে এক কাকা, সমবয়সী বলে বন্ধুর মতন কিছু কথা তো বলা যায়, কিছু রঙ্গ রসিকতা। এক দিগন্ত বিস্তৃত বিল।শীতের শুরু বিলের যে পথে হেঁটে চলেছি অসমান, সদ্য বিদায়ী বর্ষার কাদামাটি শক্ত হয়ে আছে।সাবধানে চলেছি।অসাবধানে হোঁচট খাচ্ছি। সারি সারি মৌনীবক, মাছরাঙা বিলের শুকনো পানায়। ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকো উল্টে রাখা আছে। এখানে নাকি নৌকোছেঁচা মাছ জলের দরে বিক্রি হয়। আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগের সেই জলের দর কী?

ছোট-ছোট পুঁটি, ট্যাঙরা, খলসে, মৌরালা, কই, মাগুর,
শিঙ্গি দশটাকা কিলো। আবার কখনও ভাগায় কেনা।সেখানে এক কিলো বা বেশিও হতে পারে। কখনও একটু আধটু কম। কাকার অভিজ্ঞতার এ গল্প শোনালেন। বিল বলতেই মোতিবিলের নামটি মনে পড়ে। সহজপাঠে পড়া। এভাবে এসে গেলাম জলঙ্গী নদীর পাড়ে।শীতের রুকোসুকো জলের শীর্ণধারা। তবে এমন একটি গ্রাম দেখে মন আনন্দে ভরে  উঠলো। হলদে রঙের সর্ষে খেত। তবে সন্ধে হওয়ার মুখে হালকা হলুদে দেখলাম। পর দিনের সেই কিশোরী সর্ষেখেত উজ্জ্বলতায় আমার মন এমন ভরিয়ে দিয়েছিল যে আজও ধরা আছে মনের ক্যামেরায়। সর্ষেখেত আগেও দেখেছি, তবে এত আগুন দেখিনি। হয় এক একদিন এমনি হয়।নৌকো পড়ে আছে।ঘাটোয়াল নেই। প্রায় অন্ধকার কাকা লগি দিয়ে ঠেলে ওপারে নিয়ে গেল।নৌকাযাত্রাও মনে আছে। আজ শুনি সেই বিল ছোট হয়ে গিয়েছে দৈর্ঘ্যে এবং প্রস্থে।সেই কাদামাটির রাস্তাও নেই। নদীর ওপরে পাকাসেতু।
হাঁসখালির হাটে পরদিন গেলাম। একটাকায় তিনটে বাঁধাকপি। মুরগী হাঁস দেদার বিকোচ্ছে। একজন ছাগল বিক্রি করতে এসেছিলেন, অমনি দুটো ষণ্ডামার্কা লোক শাসিয়ে গেল দালালকে ফাঁকি দিসনা। আইসক্রিম বিক্রী হচ্ছিল গান বাজিয়ে- বলি ও ননদী আর দু-মুঠো চাল ফেলে দে হাঁড়িতে, ঠাকুরজামাই এল বাড়িতে। লুকিয়ে চুরিয়ে পঁচিশ পয়সার প্লেন চারমিনার আর কাঠের ধোঁয়ার গন্ধ ওঠা চা।এক বাউল হাটে ঘুরে ঘুরে গান গাইছিল চেনা পরিচিত জনপ্রিয় গান, গোলেমালে গোলেমালে পিরীত করো না। একটা গ্রামীণ সমাজ, একটা গ্রামীণ হাট।কিন্তু মূল কাঠামোগুলো ইন্টারনেটের যুগেও হয়ত এক আছে। সেই সুদূরের ডুয়ার্সের হাট বা মেদিনীপুরের হাট। কেনাবেচা সওদা আর লোকেদের মিলনস্থল। তারপর ঘরে ফিরে টিভি নিয়ে চর্বিত- চর্বণ।

আমি দেখছি একঠেলা মূলা নামল আবার সেই ঠেলাতে উঠে গেল। সামনে গিয়ে দেখি একজন লোক মাথায় হাত দিয়ে বসে।জানলাম--পাইকার যা দাম দেবে তাতে ঠেলার ভাড়া উঠবে না। বাড়ি ফিরে গোরু ছাগলকে খাওয়াবে।

খেয়েছিলাম ভৈরবচন্দ্রপুরে সদ্য পেড়ে আনা খেজুর রস। স্পাউটের জলে স্নান আর খোলা আকাশের নিচে বাহ্যক্রিয়া।সেদিন মনে হয়েছিল এই প্রকৃতি এই আকাশ এই স্থান আমার অতি নিজের কাছের।

এক ভাইপো বললে-কাকা কী ভাবছ?
আমি বললাম- তোমাদের গ্রাম কত সুন্দর। কত কত ভাত খেয়ে নিচ্ছি গো এখানে।
ভাইপো বললে---ওটা ক্ষণিকের কাকা।এর ভেতরেও আছে অনেক দুঃখ, শোক, কষ্ট, না পাওয়ার আর্তি।বর্ষায় এসো, দেখবে জীবন কত গ্লানিকর। শহুরে জীবনে গেলে চাষী আর ফিরতেই চায়না। কেন?
সুখ তো শহরেই। চাষার ছেলে কী আর চাষী হয়?জেলা শহর আর বড় শহরগুলো তো গ্রামের লোকেরাই ভরে ফেলছে। নাগরিক জীবন আমাদের চেতনায়।শহরে বসেই গ্রামকে ভালবাসি। দিস্তে দিস্তে গল্প-কবিতা লিখে ফেলেছি।

আমি সেই দিগন্ত বিল (আমি নাম দিলাম)পাশে রেখে যখন ফিরছিলাম ময়ূরহাটে, ভাবছিলাম উপলব্ধি, এক বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যে হয়। ময়ূরহাটে একটুকরো টিনের ঘরে একজন‌ রেলের এজেন্ট আছেন টিকিট বিক্রি করেন। তিনি দূরে তাস খেলছিলেন। ডেকে এনে টিকিট কাটলাম। গেদে লোকাল ডিজেল ইঞ্জিন টেনে নিয়ে আসছিল বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে। ফিরে এসেছিলাম শহরে। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের সেই স্মৃতি এখনও অমলিন। এখনও মনে হয় সত্যি জীবন বলতে যা বুঝি তার কিছু কিছু এখনও পড়ে আছে গ্রামে।

সেই সুদূর নয় অল্পদূরের স্বপ্নপুরে। ভৈরবচন্দ্রপুর।


আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments