জ্বলদর্চি

ইনফিনিটি এবং শ্রীনিবাস রামানুজন / পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ― ০৪

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


ইনফিনিটি এবং শ্রীনিবাস রামানুজন 


অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি সহযোগী বন্ধু। দূর পুটনিতে। দূর বিদেশ বিভূঁই-এ সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ বন্ধুটি জীবন সম্পর্কে ঈষৎ বিতৃষ্ণ। একরাশ কু-চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। তাকে দেখতে তড়িঘড়ি হাসপাতাল ছুটলেন হার্ডি। লন্ডন থেকে ভাড়া করলেন একটি ক্যাব-ট্যাক্সি। ট্যাক্সি নম্বর ১৭২৯। নজরে রাখলেন নম্বরটি। তবে বেশি গুরুত্ব দিলেন না। 

হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা  বন্ধুটি অবশ্য একজন ভারতীয়। হেপাটিক অ্যামোবায়াসিস নামক আন্ত্রিক (আমাশয়)-এর জটিল ক্রনিক রোগে আক্রান্ত সে। শরীরে উদোম জ্বর থার্মোমিটারের পারদবিন্দুকে তীব্র উঁচুতে নিয়ে যায়। মুখ থেকে রক্তবিন্দু মাঝেমধ্যে বেরিয়ে আসে কাশির সঙ্গে। চোখের নীচে হালকা কালো ছোপ ছোপ দাগ। ভীষণ অসুস্থ বন্ধুকে দেখতেই এতদূর ছুটে আসা হার্ডির। সেটা ১৯১৭ সাল। 

দরজা খুলে রুগীর রুমের ভেতরে ঢুকলেন হার্ডি। ঢুকে দেখলেন, বন্ধুটি হেলান দিয়ে অসুস্থ শুয়ে আছেন হাসপাতালের বেডে। মাথা সামান্য আনত। চোখ বন্ধ। কাছে গেলেন হার্ডি। নির্লিপ্ত চোখ তুলে তাকাল সে। যৎকিঞ্চিৎ হায়, হ্যালো বিনিময় হল। অভ্যর্থনার পালা সাঙ্গ করে শরীরের খবরাখবর নিলেন হার্ডি। দেরি করে আসার কারণ ব্যক্ত করতে গিয়ে এ-কথা সে-কথার প্রসঙ্গে উঠে এল ট্যাক্সি নম্বর ১৭২৯। সংখ্যাটি নিয়ে নিজের হতাশা গোপন করেননি হার্ডি। অসুস্থ বন্ধুর সম্মুখে ১৭২৯ সংখ্যাটিকে বলে বসলেন 'Dull Number'।

'না বন্ধু, এটা কোন Dull Number (গুরুত্বহীন সংখ্যা) নয়?'― হাসপাতালের বেডে শুয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তর দেয় তাঁর বন্ধু।

'মানে?'― আঁতকে উঠলেন হার্ডি। ভাবলেন ঘটনাটি কোন খারাপ পূর্বাভাসের ঈঙ্গিতবাহী নয় তো? অথবা কোন অমৃতের সন্ধান লুকিয়ে আছে এর ভেতর; কে জানে?

'আসলে ১৭২৯ সংখ্যাটি খুব আকর্ষণীয় একখান সংখ্যা। দুটি ধনাত্মক পূর্ণ সংখ্যার ঘণের সমষ্টি এই ১৭২৯ সংখ্যাটি সব চেয়ে ছোট সংখ্যা। দুটি ভিন্ন উপায়ে।' অসুস্থ শরীরে দৃপ্ত কণ্ঠে উত্তর দেয় পীড়িত বন্ধুটি।

'কীভাবে?' বিস্ময় প্রকাশ করে হার্ডি। তারপর হেসে উঠলো দুজনে।
'ধরা যাক, তোমার ট্যাক্সি নম্বর ১৭২৯। তাহলে,
          ১৭২৯  = (১^৩ + ১২^৩)    = (৯^৩ +১০^৩)'

শুধু ১৭২৯ নয়, এমন আরও অনেক সংখ্যা আছে যারা একাধিক উপায়ে দুটি ধনাত্মক সংখ্যা অথবা একটি ধনাত্মক ও একটি ঋণাত্মক সংখ্যার ঘনফলের সমষ্টির সমান। যেমন,

          ৪১০৪   =  (১৬^৩ +২^৩)   =  (১৫^৩ + ৯^৩)
          ১৩৮৩২ =  (২০^৩ + ১৮^৩) =  (২৪^৩ + ২^৩)
          ২০৬৮৩ =  (১০^৩ + ২৭^৩) = (১৯^৩ + ২৪^৩)
          ৩২৮৩২ =  (৪^৩ + ৩২^৩)  = (১৮^৩ + ৩০^৩)         
          ৩৯৩১২ =  (২^৩ + ৩৪^৩)  =  (১৫^৩ + ৩৩^৩)
          ৪০০৩৩ =  (৯^৩ + ৩৪^৩) =  (১৬^৩ + ৩৩^৩)      
          ইত্যাদি।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, অসুস্থ বন্ধুর কথাই সঠিক। তাই এ হেন অসুস্থ বন্ধুর নামানুসারে সংখ্যাগুলোর নামকরণ করা হয় 'রামানুজন সংখ্যা'। এছাড়া সংখ্যাগুলি 'ট্যাক্সি-ক্যাব সংখ্যা' নামেও পরিচিত। কিন্তু কে এই রামানুজন? যার নামে এ হেন সংখ্যার নামকরণ। যাকে দেখতে অনেক দূর হাসপাতালে ছুটে এলেন প্রখ্যাত ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ জি. এইচ. হার্ডি।

পুরো নাম শ্রীনিবাস রামানুজন আইয়াঙ্গার। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষের মাদ্রাস প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত ছোট্ট শহর ইরোডে। এই ইরোডে'র ১৮ আলাহিরি স্ট্রিটে তার মামা বাড়ি। সেখানেই তামিল ব্রাহ্মীণ আইয়েঙ্গার পরিবারে তার জন্ম ১৮৮৭ সালের ২২-শে ডিসেম্বর। বাবা কুপ্পুস্বামী শ্রীনিবাস আইয়েঙ্গার থাকেন থান্জভুর জেলার মধ্যে কুম্বকোনম মফস্বল শহরের সরাঙ্গপানি সন্নিধি স্ট্রিটে। সেখানে একটি শাড়ি দোকানে ক্লার্কের কাজ করতেন তিনি। 

           

তার মা কোমলাটাম্মাল একজন সাধারণ গৃহবধূ। সকাল সন্ধ্যায় স্থানীয় একটি মন্দিরে ভজন গীত পরিবেশন করতে যেতেন তিনি। সঙ্গে যেত ছোট্ট রামানুজন। মায়ের গাওয়া ভক্তি সংগীত শুনে শুনে নিজের খেয়ালে রেওয়াজ করত সে। পরবর্তীকালে একটু বড় হতে ঐ মন্দিরে অধিকাংশ সময় কাটে কিশোর রামানুজনের। এবং সেখানে আপন খেয়ালে ভজন গায়। স্কুলে পাড়ায় তার বন্ধুবান্ধব খুব একটা ছিল না। অবশ্য তার আগে খুব ছোটবেলায় (প্রায় দু'বছর বয়সে) সে একবার স্মল-পক্সে আক্রান্ত হয়। সে-সময় হামেশাই স্মল-পক্সে আক্রান্ত হচ্ছিল শিশুরা। শুধু থান্জভুর জেলায় ৪০০০-এর বেশি শিশু স্মল-পক্সে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তখন। আক্রান্ত আরও বেশি। এর কিছু দিন আগে তার এক সদ্যজাত ভাই তিন মাস বয়সে মারা যায়। ১৮৯১ ও ১৮৯৪-তে প্রথম জন্মদিনের আগে আরও দুই ভাই-এর অকাল মৃত্যু হয়। তাই মায়ের মন অজানা ভয়ে শঙ্কিত। এবার আর নয়! অনাগত বিপদের কথা আন্দাজ করে ছোট্ট রামানুজনকে নিয়ে মাদ্রাজের (বর্তমানে চেন্নাই) সন্নিকটে কাঞ্চিপূরমে বাপের বাড়ি রওনা দিলেন তিনি। ভাগ্যদেবী এবার বোধহয় সুপ্রসন্ন হলেন। স্মল-পক্স থেকে সেরে উঠল সাত রাজার ধন এক মানিক রামানুজন। দু'বছর পার হয়ে গেল কাঞ্চিপূরমে। ১৮৯২ সালের ১-লা অক্টোবর মামা বাড়ির কাছে একটি স্কুলে হাতেখড়ি হল। কিন্তু পিতার মৃত্যুর পরে নিরুপায় হয়ে স্বামীর কাছে ফিরলেন কোমলাটাম্মাল।
          

কুম্বকোনমে ফিরে কঙ্গায়ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হল রামানুজনকে। এবার নিজের দাদু মারা গেলে পুনরায় মাদ্রাজে মামা বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল তাকে এবং সেখানে স্কুলে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু মাদ্রাজের স্কুল তার পছন্দ ছিল না। সে-জন্য বিদ্যালয়ে প্রায়শই গরহাজির। ছ'মাস পরে আবার কুম্বকোনম প্রত্যাবর্তন।

সেখানে তার বাবা সবসময় কাজে ব্যস্ত। পুত্রের সঙ্গে সময় অতিবাহিত করার অবকাশ নেই। মায়ের সান্নিধ্যে তার অধিকাংশ সময় কাটাত। সংসারের কাজ সামলে মা তার যত্ন নিত, পরিচর্যা করত। ফলে মায়ের সঙ্গে তার এক মধুর বন্ধন তৈরি হয়ে গেছিল ছোটবেলা থেকে। মায়ের কাছ থেকে মিলেছিল প্রকৃত শিক্ষা। ঐতিহ্য ও পুরাণ শিক্ষা। ধর্মীয় সংগীতের অনুশীলন। মন্দিরের পূজার্চনায় অংশগ্রহণ ও ভক্তি। প্রকৃত ব্রাহ্মীণ সংষ্কৃতি। নিরামিষ ভোজন। এ হেন পরম্পরার অনুশীলন, তাঁর মতে, পরবর্তী জীবনে বিভিন্ন গাণিতিক সূত্র উদ্ভাবনে তাঁর কাছে আসল শক্তি স্বরূপ হয়ে দেখা দিয়েছিল।

এমন স্বাস্থ্যকর পরিমণ্ডলে দশ বছর বয়সের আগে প্রাথমিকে সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে উত্তীর্ণ হল সে। সেখান থেকে ১৮৯৭ সালে টাউন হায়ার সেকেণ্ডারি স্কুল। এখানে প্রথম বারের মতো সাধারণ গণিতে হাতেখড়ি। মাত্র এগারো বছর বয়সে হাতে এল এস. এল. লোনেই-এর 'অ্যাডভান্সড ত্রিকোণমিতি'। শুরু হল তার গণিতচর্চা। এ সময় থেকে দু'জন কলেজ ছাত্র তার বাড়িতে থাকতে শুরু করে। আবাসিক দুজনের সঙ্গে গণিতের জ্ঞান নিয়ে তুমুল স্বাস্থ্যকর তর্ক বিতর্ক হত রামানুজনের। তেরো বছর বয়সে গণিতের কয়েকটি অবিশুদ্ধ সূত্র আবিষ্কার করে ফেলে সে। সেই সঙ্গে জিতে নেয় স্কুলের স্কলারশিপ সংক্রান্ত বেশ কিছু পুরস্কার। জ্যামিতি ও অসীম সিরিজ (Infinite Series)-এ বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে।

১৯০৩ সালে যখন তার বয়স মাত্র ১৬ বছর, এক বন্ধু মারফৎ জি. এস. ক্যার-এর 'A Synopsis of Elementary Results in Pure and Applied Mathematics' লাইব্রেরি বইটি তার হাতে আসে। বইটি ৫০০০ টি সূত্রে ঠাসা। গোগ্রাসে সেটি পড়তে শুরু করে রামানুজন। যত্ন সহকারে যুক্তি-প্রতিযুক্তির তীক্ষ্ণ ঘেরাটোপে অধ্যয়ন সমাপ্ত হয়। এ হেন বইটি পরবর্তীকালে তাকে জিনিয়াসে পরিনত করতে বিশেষ অবদান রাখে। পরের বছর সে আলাদাভাবে বার্নোলি সংখ্যার বিকাশ ও অনুসন্ধান করে। ১৫ দশমিক স্থান পর্যন্ত আসন্নমানে Euler Mascheroni Constant-এর মান গণনা করে।
        
১৯০৪ সালে টাউন স্কুল থেকে হায়ার সেকেণ্ডারি পরীক্ষায় পাশ করার পর প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণস্বামী আইয়ার তাকে 'কে. রঙ্গনাথ রাও পুরস্কার' প্রদান করে এবং আউটস্ট্যান্ডিং স্টুডেন্ট-এর স্বীকৃতি দেয়। ১৯০৫-এ র আগস্টে বাড়ি থেকে সে বিশাখাপত্তনমে পালিয়ে যায়। রাজামুন্দ্রিতে এক মাস কাল অবস্থান করে। ফিরে এসে মাদ্রাজের পাচাইয়াপ্পা কলেজে ভর্তি হল। সেখানে গণিতের পরীক্ষায় সম্মানের সঙ্গে কৃতকার্য হল। কিন্তু ইংরেজি, ফিলোসফি ও সংষ্কৃতে ডাহা ফেল! একমাত্র গণিতে তার মেধার প্রকৃত স্ফুরণ ঘটে। বাকি সব বিষয়ে তার জ্ঞান সূঁচের ডগায় তিল ধারণের নামান্তর মাত্র। নেই বললেই হয়! ফলে ১৯০৬ সালের ডিসেম্বরে তিনি F.A. (Fellow of Art) সামগ্রিক পরীক্ষায় ফেল করে বসলেন। পরের বছর আবার ফেল! F.A. পরীক্ষায় পাস না করে অগত্যা কলেজ ছেড়ে দিলেন। তবে গণিতে স্বাধীন ও পৃথকভাবে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ বা রসদ জোগাড়ের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। তীব্র আর্থিক সংকট তখন তার নিত্যসঙ্গী। এসময় প্রায়শই অভুক্ত থাকতে হোতো তাকে।

গোদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মতো ১৯০৯ সালের ১৪-ই জুলাই তিনি শুভ পরিণয়ে আবদ্ধ হন। মা কোমলাটাম্মাল এক বছর আগে পাত্রীর সন্ধান করে রেখেছিলেন। বিবাহের সময় পাত্রী জানকি আম্মাল-এর বয়েস সবে মাত্র দশ। তাই রীতি অনুযায়ী বিয়ের পর অপ্রাপ্তবয়স্ক নববধূকে তার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বিবাহের তিন বছর পর শাশুড়ির সঙ্গে নববধূ মাদ্রাজে রামানুজনের কাছে ফেরত আসে। 

বিবাহের পর মাদ্রাজে বাড়ি বাড়ি চাকুরীর খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরতে হয় রামানুজনকে। রাত্রি যাপন এক বন্ধুর বাড়িতে। হাত খরচের জন্য মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রদের টিউশনি পড়ানো। তাদের F.A. পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি ক‍রা ছিল কাজ।
           

এতকিছুর পরেও মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটিতে গণিত নিয়ে রিসার্চ করা তার তীব্র বাসনা। এভাবে কিছুদিন চলার পর ১৯১০ সালে তার সাক্ষাৎ হয় Indian Mathematical Society -এর স্থাপক কর্ণধার রামাস্বমী আইয়ার-এর সঙ্গে। ভদ্রলোক আবার ডেপুটি কালেক্টর। রামানুজন সরাসরি তাঁকে নিজের নোটবুক দেখায়। অসাধারণ গাণিতিক ফলাফলে সমৃদ্ধ নোটবুকটি দেখে মি. আইয়ার ঈষৎ হতবাক। তিনি যুবক ছেলেটার গণিতের পাণ্ডিত্য অনুধাবন করে তাকে নেল্লোরের ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর আর. রামাচন্দ্র রাও-এর কাছে পাঠিয়ে দেন। মি. রাও তখন Indian Mathematical Society-র সম্পাদক। মূলত তাঁর হস্তক্ষেপে মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটিতে গবেষণার সুযোগ আসে। ঐ বছরের ৭-ই এপ্রিল মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার গবেষণার বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসে। পাঁচ দিন পর গবেষণার অনুমতি মেলে। সেই সঙ্গে ৭৫ টাকা বৃত্তি। তিন মাসের মধ্যে ন্যুনতম একটি পেপার প্রকাশ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্ধারিত সময়ের আগে মি. আইয়ার-এর সহায়তায় তার গবেষণালব্ধ কাজ Indian Mathematical Society-এর জার্নালে প্রকাশিত হয়। 

এরপর ১৯১২ সালের প্রথম দিকে মাসিক ২০ টাকার বিনিময়ে মাদ্রাজ অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল অফিসে একটি অস্থায়ী কাজের বন্দোবস্ত করে ফেলে সে। ক'সপ্তাহ পর মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাষ্টের চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট পদের জন্য আবেদন করে। তার বদলে ৩০ টাকা মাসিক ক্লাস-III চতুর্থ গ্রেডের একটি চাকুরী তার জন্য বরাদ্দ হয়।সেখানে মনের আনন্দে কাজ করতে থাকে। যে কাজ দেওয়া হয়, খুব অল্প সময়ে সেগুলো তার সারা হয়ে যায়। বাকি সময়ে গণিতের সমীকরণে ডুবে থাকে।

তার এ হেন গবেষণার ফলাফল ইংল্যান্ডে গণিতের পণ্ডিতদের নিকট প্রেরণ করা হল। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন-এর প্রফেসর এম. জে. এম. হিল তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। হাল ছেড়ে না দিয়ে পুনরায় সে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে পাঠাল তার পেপার। কেমব্রিজের প্রথম দুজন প্রফেসর বেকার এবং হবসন মন্তব্য না করেই পত্রপাঠ ফেরৎ পাঠিয়ে দেয় সেগুলো।

কিন্তু তিন বারের চেষ্টায় বিখ্যাত গণিতজ্ঞ জি. এইচ. হার্ডি'র নজরে পড়ে তার গবেষণা। বিশেষ করে 'Infinite Series'-এর ওপর তার কাজে হার্ডি মুগ্ধ হন। এরপর তিনি রামানুজনের ইংল্যান্ড গমনের সব বন্দোবস্ত করেন। ১৯১৪ সালের ১৭-ই মার্চ এস. এস. নেভাসা জাহাজে চড়ে ইংল্যান্ডে রওনা হয় সে। লন্ডনে পৌঁছয় ১৪-ই এপ্রিল। চারদিন বাদে হার্ডি ও লিটলউডের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটে। নিজের নোটবুক খুলে দেখায় দু'জনকে। দু'জনেই নোটবুক দেখে ও পড়ে মোহিত হয়ে যান। এরপর থেকে রামানুজনের গবেষণা লব্ধ ফলাফল কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির দিকপাল গণিতজ্ঞদের গোচরে আনেন হার্ডি। দুটো সমস্যার আবির্ভাব হল। এক, রামানুজনের কম শিক্ষাগত যোগ্যতা, কারণ তিনি গ্র্যাজুয়েট হননি। দুই, সূত্র গুলোর বাস্তব প্রমাণ তখনও পর্যন্ত ছিল না। সেজন্য কেমব্রিজের পণ্ডিতগণ এমনকি হার্ডিকেও অপমান করতে পিছপা হয়নি। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র নয় প্রফেসর হার্ডি। 
         

তাঁর অক্লান্ত জেদের কাছে হার মানল London Mathematical Society। তারা রামানুজনের একটি পেপার ছাপে। পেপারের বিষয় ছিল 'Highly Composite Numbers'। এই পেপারের সৌজন্যে তাকে Bachelor of Arts ডিগ্রিতে সম্মানিত করে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯১৬ সালের মার্চে।

যদিও তখনও অধরা রিসার্চ ফেলোশিপ। বাধা অধিকাংশ প্রফেসর। একদিন গণিতের একজন প্রফেসর ক্লাসে ব্ল্যাকবোর্ডে লিখিত সমস্যার সমাধান করতে ডাকে রামানুজনকে। ক্লাসে সবাইকে অবাক করে দিয়ে রামানুজন তার সঠিক সমাধান করলেও সেদিন খুশি হননি সংশ্লিষ্ট অধ্যাপক। বরং ক্ষুণ্ণ হন। শাস্তি হিসেবে তাকে ক্লাস থেকে বহিষ্কার করে।

এমন আকাশ সমান প্রতিকুল পরিস্থিতিতে ১৯১৭ সালের ৬-ই ডিসেম্বর রামানুজন London Mathematical Society -তে মনোনীত হলেন। একদা রিসার্চ ফেলোশিপ দিতে অস্বীকার করা গণিতের তাবড় তাবড় প্রফেসররা পরের বছর ২-রা মে তাকে রয়্যাল সোসাইটির ফেলো (FRS) ঘোষণা করে দেয়। মাত্র ৩১ বছর বয়সে তিনি রয়্যাল সোসাইটির ইতিহাসে কনিষ্ঠ ফেলো নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস তৈরি করলেন। তিনি ১৯১৮ সালের ১৩ অক্টোবর ট্রিনিটি কলেজের প্রথম ভারতীয় ফেলো নির্বাচিত হলেন।

কিন্তু এর মাঝে তিনি টিউবারকিউলোসিসে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। হাসপাতালে ভর্তি হতে হল। সেখানে কোন একটি সাক্ষাতে 'Taxicab Numbers'-এর ঘটনাটি ঘটে। যা প্রথমে উল্লেখ করা হয়েছে।

কোনক্রমে একটু সুস্থ হতে দেশে ফেরা মনস্থির করে ফেলুন। এতে হার্ডি কিঞ্চিত অবাক হয়েছিলেন। তিনি আরও কিছুদিন একসঙ্গে কাজ করতে চেয়েছিলেন। যদিও তা আর হবার নয়। ইংল্যান্ডে অতিবাহিত পাঁচ বছর  আপাত তিক্ত কাল অতিবাহিত করে ফেরার জাহাজ ধরলেন ১৯১৯-এ। জাহাজে পুনরায় শরীর খারাপ হতে শুরু করে। ঐ অসুস্থ অবস্থায় ১৯১৯-এ কুম্বকোনমে প্রত্যাগমন করলেন। কিন্তু বেশি দিন বাঁচলেন না। কুম্বকোনমে ১৯২০ সালের ২৬-শে এপ্রিল এই মহান বিজ্ঞানীর প্রয়াণ ঘটল। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৩২ বছর।

এতদূর পড়ার পর প্রিয় পাঠক জানতে উৎসাহী হবেন নিশ্চয়― গণিতে রামানুজনের অবদান কতখানি? আসলে তিনি সমকালীন গণিতজ্ঞদের তুলনায় গাণিতিক ধ্যান-ধারণায় কয়েক দশক এগিয়ে ছিলেন। গণিতে Infinite Series, Improper Integrals, Continued Fractions, Partition Function ও Number Theory আবিষ্কারে তাঁর অবদান ও নাম স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করা থাকবে। শুধু তা নয়, বর্তমানে পদার্থবিজ্ঞানে বহুল চর্চিত 'ব্ল্যাকহোল তত্ত্ব'-এর ওপর অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমীকরণের উদ্ভাবন করেছেন তিনি। মাত্র ৩২ বছর বয়সকালের মধ্যে ৩৯০০ সমীকরণ ও সম্পর্ক আবিষ্কার করেছেন।

একবার ব্রিটিশ গণিতবিদ সহযোগী হার্ডি দিকপাল গণিতজ্ঞগণের তুলনামূলক আলোচনা করছিলেন। তাতে সব সূচকের পূর্ণমান ছিল ১০০। এই ১০০ নম্বরের মধ্যে তিনি নিজেকে ২৫, বিখ্যাত জার্মান গণিতজ্ঞ হিলবার্টকে ৮০ এবং শ্রদ্ধেয় রামানুজনকে ১০০ নম্বর দিয়েছিলেন। এখানেই বোধহয় রামানুজনের বিশেষত্ব। 

বেশ কিছু দিন ধরে প্রফেসর হার্ডি জানতে চান, কীভাবে রামানুজন গণিতের যুগান্তকারী সব ফরমুলা উদ্ভাবন করছেন? প্রত্যুত্তরে রামানুজন একবার বলেন― দেবী নামাগিরী'র ঐশ্বরিক ক্ষমতার আশির্বাদে গণিতের কঠিন থেকে কঠিনতর সূত্রগুলি অনায়াসে তাঁর মাথায় আসে যখন তাঁকে আমি স্মরণ করি।
         

আরও বিস্ময়কর ঘটনাটা ঘটল তাঁর মৃত্যুর পাঁচ দশকের অধিক সময় পর। ১৯৭৬ সালে আমেরিকান গণিতবিদ জর্জ অ্যান্ড্রিউজ বহু কষ্টে রামানুজনের একটি অপ্রকাশিত নোটবুকের হদিস পেলেন। জীবনের শেষ এক বছর ১৯১৯ থেকে ১৯২০-র মধ্যে এই নোটবুকটি রামানুজন লিখেছিলেন। এ হেন নোটবুকটি ৬০০-এর বেশি গণিতের অত্যাশ্চর্য সূত্রে ঠাসা।

একদা সহযোগী লিটলউড হার্ডিকে লেখা রামানুজনের চিঠি ও নোটবুক প্রথম দেখে খুব সুন্দর একটি মন্তব্য করেছিলেন, 'Every positive integer is one of Ramanujan's personal friends'।

তাই এই মহান মানুষটিকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে  ২০১২ সাল থেকে প্রতি বছর ভারতে তাঁর জন্মদিন ২২-শে ডিসেম্বরকে 'জাতীয় গণিত দিবস' হিসাবে পালন করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন 
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments