জ্বলদর্চি

বাংলা ব্যাকরণ ও বিতর্কপর্ব ৮/ অসীম ভুঁইয়া


Bengali grammar and debate
বাংলা ব্যাকরণ ও বিতর্ক
পর্ব ৮

অসীম ভুঁইয়া

শব্দের গঠন ও অর্থের মেরুকরণ 

এই মুহূর্তে আমরা শব্দ নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা করতে চাই। ধ্বনি সম্পর্কে ধারণা আগেই দেওয়া হয়েছে। তবুও আরেকবার বলে নিচ্ছি। ধ্বনি হল, মানুষের বাকযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত অর্থের সম্ভাবনাযুক্ত আওয়াজ (sound)।  যেমন অ, আ, ক, খ প্রভৃতি। এই ধ্বনিই ভাব বিনিময়ের ক্ষুদ্রতম মাধ্যম। আর এই ধ্বনিগুলো পাশাপাশি বসে কোনো অর্থপূর্ণ ভাব প্রকাশ করলেই তাকে শব্দ বলা হয়। তবে একটি ধ্বনিও অর্থ প্রকাশে সক্ষম হলে তাকেও শব্দ বলতে পারি। এ বিষয়ে আগেই আলোচনা করা হয়েছে। মূলকথা, অর্থযুক্ত একক ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টিই শব্দ। যেমন- বেদনা, পৃথিবী, আলো, এ, ও প্রভৃতি।  

এক হিসেবে বাংলা শব্দের দুটি দিক রয়েছে। এক, গঠনগত দিক ও দুই, অর্থগত দিক। 
  
   শব্দ তৈরির নানাদিক আলোচিত হয় গঠনগত শ্রেণিতে। গঠনগত শ্রেণি সাধারনত দু ধরনের হয়ে থাকে।১. মৌলিক বা সিদ্ধ শব্দ ও ২. যৌগিক বা সাধিত শব্দ। 
 
আগে  মৌলিক শব্দ সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। ধরা যাক, হাত, পাখা, বাবা,মা, চেয়ার, টেবিল: এই শব্দগুলো বাংলা নিজস্ব উৎস বা বিদেশি কোনো ভাষার উৎস থেকে বাংলা শব্দভান্ডারে এসেছে। এই শব্দগুলোকে যদি বিশ্লেষণ করতে চাই তাহলে কী হয় দেখা যাক। হাত= হা+ত। এই হা ও ত আলাদা করে কোনো অর্থই প্রকাশ করছে না।  এরা ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছ মাত্র। একইভাবে অন্যান্য শব্দগুলিকেও  আলাদা করতে চাইলে কোনো সুস্পষ্ট অর্থই পাওয়া যাবে না। এরাই মৌলিক শব্দ। অর্থাৎ যে সমস্ত শব্দ অর্থপূর্ণভাবে বিশ্লেষণ করা যায় না, তাকেই মৌলিক শব্দ বা সিদ্ধ শব্দ বলে। অনেকে আবার একে স্বয়ংসিদ্ধ নামেও অভিহিত করে। তবে আমাদের মত, মৌলিক শব্দ এই একটি শ্রেণিনামই থাকুক। 

   মৌলিক শব্দ দু ধরনের হয়ে থাকে। ১. নাম বা সংজ্ঞাবাচক  মৌলিক শব্দ ও ২  ক্রিয়াবাচক মৌলিক শব্দ।
 যে মৌলিক শব্দগুলো সাধারণত কোনো নামকে নির্দেশ করে তাকেই নাম- মৌলিক শব্দ বলে।যেমন- ভাই, বাবা, কাকা, জল প্রভৃতি। আর কোনো ক্রিয়াকে নির্দেশ করলে তা ক্রিয়াবাচক মৌলিক শব্দ। যেমন- বল, চল, খা প্রভৃতি।

   এবার আসি সাধিত বা যৌগিক শব্দে। এই শব্দগুলোকে অর্থপূর্ণ ভাবে ভাঙ্গা যায়। যেমন- পিতামাতা=  পিতা ও মাতা। ঐতিহাসিক=  ইতিহাস ও ইক। এক্ষেত্রে একটি শব্দের ভেতর থাকা দুটি শব্দ বা ধ্বনিগুচ্ছের আলাদা করে অর্থ রয়েছে। এরা আবার  দু ধরনের হয়ে থাকে। একটি প্রত্যয় যোগে, অন্যটি সমাস যোগে। যেমন:  নিভ+ অন্ত= নিভন্ত, বৃৎ+ শানচ= বর্তমান। এরা প্রত্যয় যোগে গঠিত। আর ছাত্রছাত্রী= ছাত্র ও ছাত্রী। জলচর= জলে চরে যে। এরা সমাস যোগে গঠিত । 
আবার, বিদ্যালয়= বিদ্যার আলয়, বিদ্যা + আলয়।  এরা সমাস ও সন্ধি দুভাবেই গঠিত। 

   এবার অর্থগত শ্রেণিটি দেখা যাক। সময়ের পরিবর্তনে অনেক শব্দ তার প্রচলিত অর্থ থেকে বেরিয়ে এসে নতুন অর্থের পোশাক পরে। অনেক শব্দ আবার চালু অর্থেই সুখ খুঁজে পায়। কখনো তো দেখা যায়, শব্দ তার বৃহৎ অর্থের জায়গা ছেড়ে অনেক সংকুচিত হয়ে গেছে। কখনো বা প্রসারিতও হয়ে যায়। তাই অর্থগত ভাবেও শব্দের নানা শ্রেণি এসে পড়ে। 

   এই শ্রেণিটি নিয়েই মূলত বিতর্ক  আছে। শ্রেণিটিকে প্রথাগত ভাবে তিনটি ধরনে দেখানো হয়। ১.অপরিবর্তিত যৌগিক শব্দ,২.রূপান্তরিত যৌগিক শব্দ ও ৩.সংকুচিত যৌগিক শব্দ। এদের আরো পুরনো ব্যাকরণে যোগিক, রূঢ় ও যোগরূঢ় শব্দ বলা হত। নামের অর্থের সঙ্গে এদের সম্পর্ক খুবই দুর্বল, তাই পশ্চিমবঙ্গ মধ্য শিক্ষাপর্ষদ এদের পরিমার্জন করে বেশ যুক্তিসঙ্গত ও সহজ নামকরণ করেছে। 
   
     যাইহোক, কয়েকটি শব্দ আমরা উদাহরণ হিসেবে নিলাম।  মিতালি, পাঠক। এদের উৎস বা ব্যুৎপত্তি-  মিত+আলি। আর পঠ্ +অক।  অর্থ যথাক্রমে "বন্ধুত্বের ভাব" ও "পাঠ করে যে।" 
যাদের অর্থ শুরুতে যা ছিল এখনও তাই আছে। এরাই অপরিবর্তিত যৌগিক শব্দ। আর পরিবর্তিত যৌগিক শব্দ হল , যাদের অর্থ শুরুতে যা ছিল তা প্রচলিত কথায় পরিবর্তিত হয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ গ্রহণ করেছে। যেমন- চিনি।  চিন + ঈ। যার উৎসে অর্থ ছিল চিনদেশের জিনিস, এখন তা পরিবর্তিত হয়ে, হয়েছে মিষ্টি জাতীয় দ্রব্য। "মহাজন"কে  মহৎ ব্যক্তি হিসেবে দেখা হত শুরুতে। এখন সুদখোর লোককেই বোঝায়। 

   প্রথাগত ব্যাকরণে তিন নম্বর শ্রেণিটি হল সংকুচিত যৌগিক শব্দ। যেমন- পঙ্কজ= পঙ্ক+ জন+ ড। অন্ন= অদ+ ত।
 "পঙ্কজ"-  উৎসে অর্থ ছিল, যা কিছু পাঁকে জন্মায়। কিন্তু এখন শুধু পদ্মকেই বোঝায়। অন্ন বলতে যেকোনো খাদ্যকেই বোঝাত, এখন শুধু ভাতকেই বোঝায়। 
এখানে লক্ষ করার বিষয়, শব্দগুলির ব্যুৎপত্তি অনুযায়ী অনেকগুলো অর্থ হয়। বা সার্বিক কোনো বিস্তৃত অর্থকেই প্রকাশ করে। কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে অনেকগুলো অর্থের যেকোনো একটিই প্রযোজ্য। অর্থাৎ প্রসারিত অর্থের সংকোচন হয় এখানে। এরাই সংকুচিত যৌগিক শব্দ।
 
 
  প্রথাগত এই শ্রেণিটিতে সামান্য একটু ত্রুটি থেকে গেছে। এখানে আরও একটি স্পষ্ট শ্রেণি বাদ পড়ে গেছে। যাকে অর্থবিস্তার ও অর্থের উৎকর্ষ বলা হয়। যেমন- "অপার"। যার আদি অর্থ পারহীন। কিন্তু এখন অর্থ প্রসারিত হয়ে নতুন অর্থ হয়েছে অনন্ত বা অসীম। "কালি" বলতে আগে শুধু কালো রঙের তরলই বোঝাত। এখন প্রসারিত হয়ে যেকোনো রঙের তরলকে বোঝায় যা লেখার কাজে লাগে। যেমন- নীলকালি, লালকালি প্রভৃতি। তাই এই শ্রেণিটিকে নতুন ব্যাকরণে অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এর সঙ্গতিপূর্ণ একটি নামও দিতে চাই আমরা। আমাদের প্রস্তাব, এর নাম "প্রসারিত যৌগিক শব্দ" হোক।

  তবে তা সত্বেও অর্থগতভাবে প্রথাগত শ্রেণিটির আমরা নতুন নামকরণ প্রস্তাব করতে চাই। এতে করে উৎস থেকে শব্দগুলি যেভাবে  পরিবর্তিত হয়েছে তা আরো স্পষ্ট হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। 
অর্থগত ভাবে শব্দের তিনটি নয়, চারটি শ্রেণি। ১. উৎস অপরিবর্তিত যৌগিক শব্দ। ২  উৎস পরিবর্তিত যৌগিক শব্দ। ৩. উৎস সংকুচিত যৌগিক শব্দ ও ৪. উৎস প্রসারিত যৌগিক শব্দ। 
তবে "যৌগিক" কথাটি না দিলেও ক্ষতি নেই। কারণ এখানে শব্দের গঠন তো দেখানো হচ্ছে না, শুধু অর্থ নির্ভরতা দেখানো হচ্ছে।       

   গুণীজনের মতামতের অপেক্ষায় আজ এখানেই শেষ করছি।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments

  1. অসাধারণ, স্যার।

    ReplyDelete